ভিন্ন স্বাদে জীবন : সামসুন নাহার।

0
510

আজ সব শেষ হয়ে গেল । শেষ তার টুকুও ছিঁড়ে চলে এলো অনন্যা। একটু একটু করে পুরনো স্মৃতিগুলো কেবলই ভেসে ওঠে ঝাপসা চোখে । বছর চারেক আগে একই অফিসে চাকরি করতো অনন্যা ও অনিমেষ। আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, আর তারপর  অনিমেষের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গিয়েছিল মেয়েটি।

বিয়ের পর সম্পর্ক গুলো যে এভাবে তিলে তিলে হারিয়ে যায় তা জানা ছিলোনা তখন অনন্যার। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির পাঁচজনের মন রাখতে রাখতে একে একে সবই খোয়াতে হলো তাকে। খুব কেঁদেছিল সেদিন, যেদিন অনিমেষ বলেছিল,

— মা যখন চান না তার বৌমা ড্যাং ড্যাং করে অফিসে যাক, তখন কি দরকার তোমার চাকরিটা করার!

গলার কাছে অনেকগুলো কথা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেদিন অনন্যার। কিন্তু কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি । অনেক কষ্টে সেটাও মেনে নিয়েছিল সে।

চাকরিটা ছেড়ে ঘরের লক্ষী বউ হয়ে সংসার ভালোই করছিল সে। বাধ সাধল সেদিনের সেই দুর্ঘটনা।

অনন্যার প্রেগনেন্সির খবরে বাড়ির সবাই এমনকি অনিমেষও ভীষণ  উৎফুল্ল হয়েছিল । অনন্যাকে কি খাওয়ালে বাচ্চা সুস্বাস্থের অধিকারী হবে, কোন ডাক্তার দেখালে, কোন নার্সিংহোমে ভর্তি করলে নিরাপদে ডেলিভারি হবে, এসব পাগলামি দেখে প্রথমবারের মা হওয়ার অভিজ্ঞতাটা বেশ এনজয় করছিল অনন্যা ।

কিছুদিন যেতেই একদিন হঠাৎ বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেল অনন্যা। রক্তে ভেসে গিয়েছিল  বাথরুমের মেঝে।  সঙ্গে সঙ্গে নার্সিংহোমে ভর্তি করেও মিসক্যারেজটা আটকানো যায় নি ।

তারপর থেকেই অনন্যা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল । ঘটনাটির জন্য সে পুরোপুরি নিজেকেই দায়ী করত সব সময়। অনিমেষও আজকাল অফিস থেকে অনেক রাতে ড্রিঙ্ক করে বাড়ি ফেরে। শাশুড়ি মায়ের সব সময় একই কথা ,

–নাতি নাতনির মুখ দেখা আর বোধ হয় এ জন্মে হবেনা ; অলক্ষ্মী,  বাচ্চাটাকে তো খেলো ; পুরুষ মানুষকে বশ করতে জানেনা, কি রকম মেয়ে মানুষ কে জানে !

সারা দিন চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে, এসব কথা শুনতে শুনতে অনন্যাও কিছুদিন যাবত কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল । নিজেই একদিন অনিমেষকে বলল ,

–আমি মুক্তি চাই ; আর ভালো লাগছেনা।
অনিমেষ ও আটকালো না। হয়তো সেও মনে মনে এটাই চাইছিল!

অনন্যার বাপের বাড়ির অবস্থা নিম্নমধ্যবিত্ত গোছের । স্বল্প পেনশনে খুবই কষ্ট করে সংসারটা চলে । প্রত্যেক মাসে মা- বাবার অনেক টাকার ওষুধ লাগে ।

কিছুদিন  নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অনন্যা সবসময় ভাবতে থাকে, কিভাবে শ্রীহীন সংসারটার হাল ফেরাবে!

একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে সে ভাবলো,  বিয়ের আগে যখন  চাকরিটা পায়নি, তখন কিছুদিনের জন্য সে একটি কুকিং ক্লাস করেছিল। তাই কেক,পেস্ট্রি, মুজ  এগুলো খুব সহজেই সে বানিয়ে ফেলে ।

নিজের  বিয়ের সময়কার গহনাগুলো পরের দিনই অসীম কাকুর দোকানে গিয়ে বিক্রি করে দিল অনন্যা । এইভাবে  কিছু টাকা পুঁজি হিসেবে পেয়ে গেল । এরপর নিজের ইচ্ছার কথা বাড়িতে জানালে মা বলেন,

—   বিয়ে করে অমন ভালো চাকরিটা হারিয়েছ। এখন আবার ব্যাবসা করতে চাইছো । দেখো কদিন চালাতে পারো! আমার আর কিছু ভালো লাগে না বাপু! তোমাদের যা মন চায় তাই করো।

বাবা বললেন ,
— আহা, করতে চাইলে করুক না। কাজের মধ্যে থাকলে ও ভালো থাকবে।

পরদিন থেকেই লেগে পড়ল অনন্যা। তার বাপের বাড়িতে রাস্তার দিকে একটা ছোট ভাঁড়ার ঘর ছিল, সেখানে একটি কারিগরকে সঙ্গে  নিয়ে অনন্যা ফাস্টফুডের দোকান খুলে ফেলল। কারিগর হিসাবে রতনের ভাজাভুজির হাত  খুব ভাল । সন্ধ্যার পর চপ,বেগুনি, রোল,চাউমিনের খদ্দেরে পা রাখার জায়গা থাকে না একটুও। বিয়ে বাড়ি, জন্মদিন ,বড়দিনে কেক,  পেস্ট্রির অর্ডার নেয় অনন্যা নিজে।

একদিন একটি আট দশ বছরের বাচ্চা ছেলে দোকানে এসে বলল,

— খুব খুদা পাইছে ! কিছু খেদ দাও না গো বাবু!
রতন বললো,

— দোকানের সামনে ভীড় বাড়াস না। ভাগ এখান  থেকে।
অনন্যা ভেতর থেকে শুনতে পেয়ে  বলল,

— কাকে ভাগাচ্ছিস রে  রতন?
— ও কিছুনা দিদি ,ওসব  রাস্তার বদমাশ ছোকরা ।

অনন্যা বেরিয়ে এসে দেখল,

দোকানের সামনের ডাস্টবিনটা থেকে ছেলেটি তখন খাবার হাতড়াচ্ছে।অনন্যা   ছেলেটিকে কাছে  ডাকল,

–এই শোন ।

ছেলেটি চমকে উঠল।চোখেমুখে তার ক্ষুধা ,ক্লান্তি ও দৈন্যতার ছাপ স্পষ্ট । ছেলেটিকে দেখে খুব মায়া হল অনন্যার। ক্ষণিকের জন্য তার ভেতরের  মাতৃসত্ত্বা যেন জেগে উঠল। তাকে অনন্যা জিজ্ঞেস করল,

— কি নাম তোর? কোথায় থাকিস ?
–আমার নাম রামু । ওই রেললাইনির ধারে থাকতুম আমরা।
–তোর মা-বাবা কোথায়?
–বাপডা অনেক দিন আগেই আমাদের থুয়ে চলি গে । আর মারে একদিন এসে পুলিশি ধরি নি গেল । আমি লুকিয়ে পড়িলাম। তাই আমারে আর ধরতি পারিনি।

–তুই  এখানে  একটু বস ।
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে বলল,আচ্ছা ।
অনন্যা রতনকে বলল,
–বাচ্চাটাকে কিছু খেতে দে রতন।
রতন ছেলেটিকে  এক প্লেট চাউমিন এনে দিতেই গোগ্রাসে সে ওগুলো এক নিমেষে খেয়ে ফেলল।

দৃশ্যটি দেখে অনন্যা ভীষণ ব্যথিত হল।
সে ভাবল এইসব  দীন দুঃখীদের জন্য কিছু করা দরকার । পরদিন থেকেই রেস্টুরেন্টের সামনে  একটি  দানবাক্স রাখল সে এবং বাক্সের গায়ে লিখে দিল,

— ‘ আপনার একটু মানবিকতা অনেক অসহায়ের পেট ভরাতে পারে।’

প্রত্যেক দ্রব্যের উপর অনন্যা নিজেও ছাড় দিয়ে  দাম ধার্য করলো। যেমন, যে চপের দাম পাঁচ  টাকা সেটার দাম এখন থেকে চার টাকা হল।

কাস্টমাররাও অনেকেই বেশ খুশি মনে সেই দানবাক্সে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু পয়সা রাখতে লাগল ।

এরপর  থেকে প্রত্যেক দিন অনন্যার দোকানে বিশ-পঁচিশ জন ক্ষুধার্ত বাচ্চা,রাস্তার পাগল,বয়স্ক ভিখারী এমনকি রাস্তার কুকুরগুলো ও খাবার খায়।

দিনে দিনে  অনন্যার ব্যবসা যেমন তরতরিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠল, তেমনি তার এই  ফ্রিতে খাবার বিতরনের আইডিয়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে পাশাপাশি অনেক দোকানে চালু হয়ে গেল এই বিষয়টি । বর্তমানে  আর অসহায় ক্ষুধার্তরা খাবারের  দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে না ।

অনন্যার এখন কেবলি মনে হয়, সেদিন সমস্ত ছিন্ন করে বেরিয়ে এসে মোটেই ভুল করেনি সে। বিয়ে, ডিভোর্স,  সম্পর্কের ভাঙ্গন, এগুলোই জীবনের সব  নয়।এর বাইরেও অনেক বড় জগৎ আছে। তিক্ত সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাওয়ার থেকে একটু অন্যরকম করে স্বপ্ন দেখলে ক্ষতি কি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here