বাচিকশিল্পী : উজ্জ্বল সামন্ত।

0
539

অহনা তখন স্কুলে পড়ে তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নয় একজন বাচিক শিল্পী হওয়ার। ব্রততী বন্দোপাধ্যায় ওর আদর্শ ছিল অন্ধভক্ত ও বটে। টিভিতে ওর কোন অনুষ্ঠান হলে চোখ ফেরাতো না।

অহনা এখন ক্লাস ইলেভেন , নতুন কো-এড স্কুলের ছাত্রী। সুশ্রী মিষ্টভাষী অনন্যা ক্লাসের সবার প্রিয়। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সঞ্চালিকার ভূমিকায় দায়িত্ব বর্তায় । নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হল সেদিন। ওর মধুর কন্ঠে আবৃত্তি জীবন্ত হয়ে ওঠে। কবিতা পাঠের শেষে হাততালিতে অনুষ্ঠান হল মুখরিত।

সৌরিশ দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। খুব লাজুক ছেলে। মনে মনে হয়তো ভালোবাসতো ওকে কিন্তু কোনদিন সাহস করে বলতে পারেনি। অফ পিরিয়ডে অহনার ক্লাস রুমের বাইরে গাছের তলায় বসে থাকতো যেখান থেকে আড়চোখে দেখা যায় অহনাকে। ক্লাসের বেঞ্চে বরাবর জানলার ধারে বসত। অহনার সামনাসামনি হলে কেমন যেন বাক রুদ্ধ হয়ে যেত। তবুও অনেক চেষ্টা করে একবার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল মিষ্টু, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
অহনা ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলেছিল : পাগল একটা।

১২ বছর পর হঠাৎ একদিন ডিসপেন্সারি সৌরিশ বসে রুগী দেখছে। বর্তমানে একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। একজন মহিলা প্রেসেন্ট অ্যাপয়নমেন্ট না নিয়েই দেখা করতে চাইছেন কম্পাউন্ডার জানালেন। সঙ্গে বাবা , এসেছেন অনেক দূর থেকে।

সৌরিশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললেন। দরজা ঠেলে যখন ভদ্রমহিলা যখন চেম্বারে এলেন সৌরিশ তখন মন দিয়ে অন্য পেশেন্টের প্রেসক্রিপশন লিখছেন। আড়চোখে দেখে বলল বসুন। এবার সৌরিশ মহিলাটির দিকে তাকালেন। খুব চেনা চেনা লাগছে। সৌরিশ জিজ্ঞেস করেন আপনার কি সমস্যা?

মহিলা তখন কোন কথার উত্তর না দিয়ে আকার-ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করছে। কথা বলতে পারেনা। লেডি এটেনডেন্ট ডেকে পেশেন্টের বাবাকে ডেকে পাঠালেন।
মেয়েটির দিকে এক দৃষ্টে সৌরিশ তাকিয়ে আছে। ওর বাবা বললেন আমার মেয়ের মাস ছয় আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে মাথায় আঘাত পায়। সেই থেকে ও কথা বলতে পারে না। ও একজন প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী। একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিল। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথেই বিপত্তিটা ঘটে।

পেশেন্টের নাম জিজ্ঞেস করলে, অহনার বাবা উত্তর দেয়, অহনা চ্যাটার্জী। বাড়ী ? বাড়ি কোথায়? অহনার বাবা বললেন তিন নম্বর, শাখারী লেন, সোদপুর। সোদপুর স্কুলের পাশে।

আচ্ছা।কয়েকটা টেস্ট লিখে দিচ্ছি । পরের সপ্তাহে রিপোর্ট নিয়ে আসুন।প্রেসক্রিপশনে কয়েকটা মেডিসিন লিখে দেন।
অহনা ও ওর বাবা নমস্কার জানিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে যায়।

সোদপুর স্কুল, অতীতের কিছু স্মৃতি এক পলকে চোখের সামনে। বুঝতে অসুবিধা হলো না এই সেই মেয়ে যাকে সে একদিন স্কুল লাইফে ভালোবেসেছিল। যাই হোক সৌরিশ প্রানপন চেষ্টা করবে, ভালোবাসার কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনার।

সপ্তাহ খানেক পরে রিপোর্ট নিয়ে অহনা ও ওর বাবা আসে চেম্বারে। কিছুক্ষণ রিপোর্ট গুলো দেখার পর সৌরিশ জানায় একটা মেজর অপারেশন করতে হবে ভোকাল কডে। খরচ একটু ব্যয় সাপেক্ষ। আমার নিজস্ব একটি বড় নার্সিংহোম আছে ওখানে পেশেন্টকে ভর্তি করবেন। যত শীঘ্র সম্ভব অপারেশন করতে হবে।
ব্যয়বহুল অপারেশনের কথা শুনে অহনা আকার-ইঙ্গিতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু অহনার বাবা সৌমিত্র বাবু বলেন ঠিক আছে আমি চেষ্টা করছি টাকা যোগারের।

অপারেশনের দিন প্রেসেন্ট কেবিনে আছে। কয়েক ঘন্টা পর অপারেশন। রিসেপশন থেকে সৌমিত্র বাবু কে জানান আপাতত ১ লক্ষ টাকা ডিপোজিট করে দেবেন অপারেশনের আগে।

সৌরিশের অনুরোধে বিদেশ থেকে আর ও একজন ডাক্তার আসেন অহনার ওটি করার জন্য ।
নির্দিষ্ট সময় অপারেশন শুরু হয়। ঘন্টা ৩ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে সৌরিশ বের হয়ে জানায় অপারেশন সাকসেসফুল। তিন দন অবজারভেশনে আপাতত থাকবে। তারপর পরীক্ষা করে দেখা হবে পেশেন্টের কণ্ঠস্বর ফিরে এসেছে কিনা। বাকি দশ লাখ টাকা অহনার বাবা জোগাড় করতে পারেননি এত তাড়াতাড়ি । মেয়েকে পারি বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন কি করে? টাকা না মেটালে পেশেন্ট কে ছাড়বে নার্সিংহোম।
সৌমিত্র বাবু হাত জোর করে আর্থিক অক্ষমতার কথা জানায়। সৌরিশ বলে আপনি চিন্তা করবেন না। আর টাকা লাগবে না। যে এক লক্ষ টাকা জমা দিয়েছিল রিসেপশনে সেটা বিদেশি ডাক্তারের চার্জ। না সৌরিশ এক পয়সাও নেয় নি।
কিছুটা অবাক হন সৌমিত্র বাবু। চোখের জল যেন থামতে চায় না।

গত তিনদিন সৌরিশ বাড়ি ফেরেনি। নার্সিংহোমে একটা গেস্ট রুমে থেকেছে।
থাকা বলতে ৩ বি এইচ কে একটা এক্সিকিউটিভ ফ্ল্যাটে একাই থাকে। সৌরিশ এখনো বিয়ে করেনি। কাউকে তার পছন্দও হয়নি। টিভিতে দু একবার গানের প্রোগ্রাম করেছে সৌরিশ নিতান্ত শখে।

বাচিক শিল্পী হিসেবে অহনার খুব নামডাক হয়েছে। কয়েকবার টিভিতেও প্রোগ্রাম করেছে। গুঞ্জন বলে একটি আবৃত্তির স্কুল রয়েছে। আবৃতি ছাড়াও গান শেখায় অহনা।অহনার বাবার কাছেই জানতে পারে তৃতীয় দিনেই পেশেন্ট ভিজিটের সময় অহনার বাবা বলেছিল।

অহনা এখন লিকুইড বা তরল খাচ্ছে।সাত দিন পর অহনার ব্যান্ডেজ খোলা হল। কথা বলতে পারল খুব আস্তে ক্ষীণ স্বরে। আরো কিছু মেডিসিন প্রেসক্রাইব করে অহনাকে ছুটি দিয়ে দিল।

মাস ছয়েক পর একটি বড় ক্লাবের অনুষ্ঠানে সৌরিশ এর ডাক পড়লো। প্রধান অতিথি। অহনা সঞ্চালনায় ছিল ‌। ঠিক আগের মতোই তার মধুর কণ্ঠস্বর গোটা অনুষ্ঠানটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। অহনার আবৃত্তি পাঠ মন্ত্রমুগ্ধ করছিল দর্শককে। প্রধান অতিথি ডক্টর সৌরিশ মুখার্জি কে কিছু বক্তব্য রাখার অনুরোধ করা হল। ডক্টর সৌরিশ মাইক হাতে গীতাঞ্জলির ৫০ নম্বর কবিতাটি আবৃতি করলেন। এই কবিতাটি অহনার সব থেকে প্রিয় ছিল। যেকোনো অনুষ্ঠানে এই কবিতাটি আবৃতি করতো। সৌরিশ এর কন্ঠে এই কবিতাটি শুনে অবাক হল অহনা।

অনুষ্ঠান শেষে সৌরিশ গাড়িতে ওঠার আগে অহনাকে বলে গেল কেমন আছিস মিষ্টু ?
মিষ্টু? অহনা অবাক হয়ে বলল আপনি কি করে জানলেন ? আমাকে মিষ্টি নামে একজনই ডাকত স্কুলে
ডঃ সৌরিশ মুখার্জি: আমিই সেই একজন…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here