” আমায় দেখে যদি ‘মা’ বলে জড়িয়ে ধরে সেই ভয়ে পর্দার আড়াল থেকে দেখি আমার ছোট সানার মুখ”….. বিশ্ব কাঁপানো দানব ” কোভিড 19″ কাঁপাতে পারেনি মহুয়া দেবনাথে মানবিকতার মমতাময়ী হাত।

0
1202

কলকাতা, সৌগত রাণা কবিয়ালঃ-প্রতিটি দিন শেষে আজকের ছবিটি মানুষের জন্য এক অজানা আতঙ্ক “কোভিড 19”..! সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ছে ভারতের বুকে অদৃশ্য দানবের এই আস্ফালন…!
রোজ সকালে ছুটে চলা মানুষগুলো চুপচাপ টিভি বা ইন্টারেনেট চোখ রেখে দিন শুরু করে..ঠিক কতোটা প্রাণের স্পন্দন অসহায় চোখের সামনে থামলো আজ…! অযাচিত মৃত্যু ভয়ে মানুষ মানুষকে অছ্যুৎ করে দিচ্ছে..কি আপন..কি পর…!
তার মাঝেও “মহুয়া দেবনাথ” এর মতো কিছু মানুষ, মানুষের সেবায় নিজের দায়বদ্ধতাকে না ভুলে ঠিক কর্ম-ধর্মে মানবিকতার মনটা কিন্তু জড়িয়ে রেখেছেন তাদের পেশায়, যাতে অন্তত পৃথিবীর বুকে এই অভিশপ্ত ২০২০ সালটাকে দ্রুত সরিয়ে দেয়া যায় মানব সভ্যতার পাতা থেকে…!

বারাসাত নার্সিং স্কুলের শিক্ষিকা কলকাতা কেষ্টপুরের অহনা আবাসনের একজন হাস্যোজ্জ্বল মুখ “মহুয়া দেবনাথ”…! তার মুখেই জেনে নেয়া যাক সময়ের যুদ্ধটা আসলে ঠিক কতোটা গল্পের আর কতোটা সত্য-কঠিন….!

” আমি মহুয়া দেবনাথ, পেশায় একজন সরকারী রেজিস্টার প্রাপ্ত নার্স এবং বারাসাত নার্সিং স্কুলের শিক্ষিকা…! আমার স্বামী একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমান কোভিড১৯ এর এই পরিস্থিতিতে আমরা দুজনেই তৈরি ছিলাম কবে আমার আদেশ আসবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার, এবং একজন কোভিড যোদ্ধা হিসেবে
ওদের পাশে দাঁড়ানোর । যেদিন ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু চোখের জল ফেলিনি। যদিও আমি অল্পতেই কেঁদে ফেলি কিন্তু সেদিন কাঁন্না আসেনি। সেদিন শুধু মনে হয়েছিলো এই যুদ্ধটা আমার একার নয়, এটা আমাদের সবার..!ইতিহাসের বিরল এই মহামারীতে আক্রান্ত মানুষের অসহায় ভীত চোখে ভালোবাসায় ভরসার চোখ রেখে দীর্ঘ ১৭ দিন যুদ্ধ করে গেলাম রাজারহাট কোভিড হসপিটালে..! আর আমার আড়ালে বাড়িতে যুদ্ধ করলো আমার ছোট দুই শিশু ও ওদের বাবা..! “ইনফেকশন কন্ট্রোল” আমাদের অস্থি মজ্জায় থাকলেও প্রথম দিন যেন সবকিছুই অজানা লাগলো। মনে হচ্ছিল অজানা শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হবে, যাকে এর আগে কোনোদিন দেখিনি..! ওখানে আমার দায়িত্ব ছিল সিস্টার-ইন-চার্জ হিসেবে..! এতদিন “পি পি ই” পরে থাকার কষ্টটা কানে শুনেছি, এবার নিজের চোখে দেখলাম অনুভব করলাম । সেদিন মনে হলো এই যুদ্ধে সামিল হতে পারাটা কতটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই যুদ্ধের পোশাক একজন নার্সকেই সবচেয়ে বেশী সময় পরে থাকতে হয়। কারণ ২৪ ঘন্টা যদি কেউ রুগীর কাছে থাকে সেটা হলো নার্স।
যাই হোক , বড়দের আশীর্বাদ বন্ধুদের শুভেচ্ছায় এই যাত্রা যখন শেষ পথে তখন আর এক অন্য আশংকা এলো মনের মধ্যে। বাড়ি ফিরে কোথায় থাকবো, কিভাবে থাকবো? কারণ নিয়ম অনুযায়ী আমাকে ১৪ দিন আলাদাভাবে থাকতে হবে। আরো একটা চাপা ভয় কাজ করছিল মনের মধ্যে, সমাজ আমায় দূরে সরিয়ে দেবে নাতো…! এটাও ভাবছিলাম যে গেটে ঢুকতে পারবো তো ! সবাই আমায় আটকাবে নাতো..! ফিরে যেতে হবে নাতো আবার হসপিটালে..! এর কারণ অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর সাথেই এটাই হয়েছে…! আর ঠিক তাই আমাকেও গেটে আটকেছিলো সবাই… তবে ফিরিয়ে দেবার জন্য নয় বরং বিজয়ী বরণ করার জন্য…! আমি সত্যি অবাক হয়ে দেখছিলাম সবাইকে..! সবাই যখন ফুল দিয়ে বরণ করেছিল, আমার স্বপ্নের মতো লাগছিলো..! এদিন আনন্দে আর চোখের জল আটকাতে পারলাম না। মাইতি দা (আমাদের সবার প্রিয় দাদা) সযত্নে আমার ব্যাগগুলো বাড়ি পৌঁছে দিলেন..! আমি আবার একবার গর্বিত হলাম আমাদের অহনা পরিবারের কাছে…! এই সম্মান আমি আমার সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে ভাগ করে নিলাম..!
যুদ্ধ এখনো শেষ করতে পারিনি আমি। এখন নতুনভাবে আর এক যুদ্ধ শুরু হলো আমার…! নিয়ম অনুযায়ী ১৪ দিন আলাদা ভাবে থাকতে হবে আমায় । তাই এপার্টমেন্টের কমিউনিটি ফ্ল্যাটে শুরু হলো আমার হোম কোয়ারেন্ট …!
ফলস্বরূপ ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পেয়েও না পাবার কষ্ট, সন্তান দের বুকে জড়িয়ে ধরতে না পারার বুক ফাটা হাহাকার । জানালার ফাঁকে লুকিয়ে একটু দেখতে পাই আমার ছোট সানা কে.. ভয়ে সামনে যেতে পারি না,পাছে আমায় মা বলে জড়িয়ে ধরে…! আর এক মানুষ যার কথা বলে শেষ করতে পারবো না সে হলো আমার প্রিয় বন্ধু অভিজিৎ( আমার স্বামী)..! পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অভিজিৎ আমাদের দুটো বাচ্চা, নিজের অফিস সামলে রান্না করে আমার জন্য ঠিক ঠিক সময়ে খাবার দিয়ে যাচ্ছে..! এই অভিজ্ঞতা যে কতটা সুখ যন্ত্রণার মিশেল সবাই সেটা অনুভব করতে পারবে কিনা আমার জানা নেই…!
আশা রাখছি পৃথিবী আবার শান্ত হবেই, আমরা সবাই সবার কাছে থাকবো। এখনো আমি ভালো আছি, কারণ আমার প্রিয় বন্ধু-স্বামী, আমার প্রতিবেশীরা-স্বজনরা আমার হাতটা ধরে আছে। যুদ্ধটা আমরা একসাথে করছি…! ”

আসলেই কি অদ্ভুত ভাবে আমরা নিজেরা বেঁচে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি..আর এই মহুয়া দেবনাথ রা আমাদের বাঁচাতে নিজের জীবন-পরিবারের কথা ভুলে গিয়ে দিন-রাত এক করে লড়ে যাচ্ছেন এই পৃথিবীর পাতায় কালো দাগটাকে মানুষের জীবন থেকে দ্রুত সরিয়ে দিতে আপ্রাণ লড়াই কিরে যাচ্ছেন…!

দেশের সামাজিক সেবামূলক কাজে এই রকম কিছু মানুষের অকুতোভয় সংগ্রামের ছবি দেখে মনে ভরসা ফিরে আসে.. মনে মনে অহংকার হয়.. এইতো আমার দেশ..আমার প্রিয় ভারত মাতা….!

সৌগত রাণা কবিয়াল
( কবি সাহিত্যিক ও কলামিস্ট )