প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী— এক আশ্চর্য্য মহাজীবন কথা (পর্ব-১৫) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এসেছেন কাশীতে । উদ্দেশ্য ব্রাহ্মধর্ম প্রচার । অবস্থান করছেন লোকনাথ মৈত্রের বাড়ীতে । লোকনাথ মৈত্র ডাক্তার ছিলেন পেশায় । কাশীতে বিজয়কৃষ্ণ যে কয়দিন অবস্থান করেছিলেন, তার প্রায় প্রতিদিনই অধিকাংশ সময় তিনি তৈলঙ্গস্বামীর কাছে থাকার চেষ্টা করতেন । তৈলঙ্গস্বামী তখন কাশীতে হঠযোগ সাধনা করতেন । কথাবার্তা বিশেষ কারোর সাথে বলেন না বলেই চলে । মৌনী বাবা হয়েই তাঁর বিরাজ । প্রতিদিন অসিতে ডুব দেন আর মণিকর্ণিকার ঘাটে ভুস্ করে উঠতেন অলৌকিক ভাবে। অত বড় দীর্ঘকায়, স্থূল শরীর নিয়ে বেনারসের গঙ্গার ঘাটের সিঁড়িগুলো এক দৌড়ে নিমেষে পার করে দিতেন ওঠার সময় । বিজয়কৃষ্ণ প্রতিদিন তৈলঙ্গস্বামীর অনুগমন করতেন, যদিও তেমন কিছু কথা হত না তাঁদের মধ্যে । তৈলঙ্গস্বামী কিন্তু দেখতেন সব অর্থাৎ, সঙ্গপ্রাপ্ত হবার জন্য এই যে বিজয়কৃষ্ণের সর্বদা তাঁর পিছন পিছন অনুগমন-অনুসরণ করা বা পাশে বসে থাকা নিঃশব্দে—–এসবই নজর করতেন তিনি ।
একদিন মণিকর্ণিকার ঘাটে তৈলঙ্গস্বামী নিজের সাধনায় মগ্ন আর বিজয়কৃষ্ণ বসে আছেন অদূরে । সারাদিন ধরে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার কার্য্যের জন্য এখানে-সেখানে ছোটাছুটিতে বেশ ক্লান্তি লাগছে তাঁর। এখন ঘাটে গঙ্গার ধারের শীতল মলয় শরীরে লাগছে আর অপূর্ব এক প্রশান্তিতে দেহ মন জুড়িয়ে যাচ্ছে । কোলাহলহীন, নিস্তব্ধ, পবিত্র পরিবেশে মনে এক অন্য দিব্যভাবও কাজ করছে যেন ।
হঠাৎ এক আশ্চর্য‍্যকর ঘটনা ঘটল । তৈলঙ্গস্বামী নিজের সাধনা ভঙ্গ করে আসন ছেড়ে উঠে বিজয়কৃষ্ণের সামনে এসে দাঁড়ালেন । বিজয়কৃষ্ণ হকচকিয়ে গেলেন এমন অভূতপূর্ব ঘটনায় । তৈলঙ্গস্বামী কোন কথা না বলে ইঙ্গিতে বোঝালেন, “ডুব দিয়ে, স্নান করে আসো ।” বিজয়কৃষ্ণ তো স্বতন্ত্র পুরুষ, নিজ মর্জি মত চলতে ভালোবাসেন। কারোর নির্দেশ এককথায় মেনে নেবার পাত্র তিনি নন ; বললেন, “আমি খুব ক্লান্ত । পারবো না এখন স্নান করতে ।” কিন্তু, তৈলঙ্গস্বামী সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বারংবার ইঙ্গিত করতে থাকলেন যাতে বিজয়কৃষ্ণ স্নান করে আসেন । অথচ, বিজয়কৃষ্ণও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ; স্নান তিনি করবেনই না । অবশেষে স্বামীজী মুখ খুলতে বাধ‍্য হলেন , বললেন—-“যাও, স্নান করে আসো । আমি তোমায় মন্ত্র দেবো ।”
বিজয়কৃষ্ণ—-“মন্ত্র আমার চাই না । আমার মন্ত্র পাওয়া হয়ে গিয়েছে ।”
স্বামীজী— “কে দিয়েছে ?”
বিজয়কৃষ্ণ—– “আমার মা ।”
স্বামীজী—“বাহ্ । খুব ভালো কথা । কিন্তু আমিও তোমায় মন্ত্র দেবো ।”
বিজয়কৃষ্ণ—- “আমি ওসব মন্ত্রে-টন্ত্রে বিশ্বাস করি না । জানেন না আমি ব্রাহ্ম সমাজের মানুষ !”
স্বামীজী—- “তাহলে তো খুবই ভালো ব‍্যাপার । আমিও ব্রাহ্ম সমাজের লোক ।”
কিন্তু, বিজয়কৃষ্ণ অনড় নিজের সিদ্ধান্তে । তিনি ব্রাহ্ম। তাই দীক্ষা বা বিগ্রহ সেবা—- এসব কিছুতে তাঁর কোন কৌতুহল বা আকর্ষণ কিছুই নেই। দীক্ষাগ্রহণ প্রসঙ্গ তো অনেক দূরের কথা । ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে বসে রইলেন তিনি। তৈলঙ্গস্বামী নিজের আসন ছেড়ে যে উঠে এসেছেন বা মৌনতা ভেঙ্গে কথা বলেছেন—- এসবে কোন তাপ-উত্তাপও খেলা করলো না তাঁর মনে ।
তৈলঙ্গস্বামী বুঝে গেছেন যা বোঝার । কথায় আছে সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকা করতে লাগে । তিনিও তাই করলেন । অর্থাৎ, নিজের আঙ্গুলখানা বাঁকা করলেন । হঠাৎ বিজয়কৃষ্ণের আরো কাছে এগিয়ে এসে চুলের মুঠি ধরে ফেললেন বিজয়কৃষ্ণের। তারপর হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন গঙ্গাবক্ষে। বিজয়কৃষ্ণের অবস্থা তখন বিড়ালের হাতে ইঁদুর ধরা পরার মতন । এক নয়, দুই নয় ; পরপর চার ডুব দেওয়ালেন ওই মুঠি ধরা অবস্থাতেই নিজের হাতে বিজয়কৃষ্ণকে । বিজয়কৃষ্ণের অবস্থা তথৈবচ তখন । তিনি যেন কাঠের বা কলের পুতুল এক । কিছু করার বা কথা বলার—-কোন কিছুরই সামর্থ‍্য নেই তাঁর । এরপর তৈলঙ্গস্বামী দীক্ষামন্ত্র প্রদান করলেন বিজয়কৃষ্ণের কর্ণে । সেটি ছিল শিবমন্ত্র । মন্ত্র প্রদানের পর স্বগোতোক্তির মত বললেন, “বসন্তের দাওয়াই হ্যায় ইয়ে। বসন্ত যেমন, তেমন মন্ত্র দিলাম । অন্য কথা কানে লাগবে না । বিষয়তৃষ্ণা থাকবে না । পর ইয়াদ্ রাখ্ হাম তুমহারা গুরু নেহী ।”
এরপর হনহন করে জল থেকে উঠে গিয়ে নিজের সাধনার আসনে বসে চক্ষু নিমীলন করে পুনরায় ধ‍্যনস্থ হয়ে গেলেন তৈলঙ্গস্বামী। অর্থাৎ, তিনি (স্বামীজী) বুঝিয়ে দিলেন যে, বিজয়কৃষ্ণকে এখন শিবমন্ত্র প্রদান করা হলেও, বিজয়কৃষ্ণের প্রকৃত গুরু কিন্তু অন্য কেউ যাঁর নির্দেশে সাধনা করবেন বিজয়কৃষ্ণ, গুরুকরণ বাকী তখনও । তৈলঙ্গস্বামীর ওপর যতটুকু ভার প্রদত্ত হয়েছে, ততটুকুই করলেন তিনি । উপযুক্ত সময়ে বিজয়কৃষ্ণের দীক্ষা হবে পুনরায়।
এ ঘটনার বেশ অনেকদিন আগে, বিজয়কৃষ্ণের এক অদ্ভুত স্বপ্নদর্শন হয়েছিল এই দীক্ষাপ্রসঙ্গে শ্রীমন্ মহাপ্রভুকে নিয়ে । জানবো আগামীদিন সেই বিচিত্র স্বপ্নের কথা আমরা ।

–—ক্রমশঃ
ভক্তানুগ্রহ-প্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *