
ওড়িশার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে গঠিত এক অনন্য স্থান হলো রত্নগিরি। ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই প্রাচীন বৌদ্ধ তীর্থক্ষেত্রটি আজও ইতিহাস, ধর্ম এবং শিল্পকলার সন্ধানীদের আকৃষ্ট করে রাখে। নীলাচল পর্বতের পাদদেশে, নদী ব্রাহ্মণী ও বিরূপার সঙ্গমের কাছাকাছি অবস্থিত রত্নগিরি যেন প্রাচীন ভারতের আত্মার এক নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি।
️ ইতিহাসের প্রেক্ষাপট
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে রত্নগিরি ছিল মহাযান ও বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম কেন্দ্র। গুপ্ত যুগের শেষদিকে রাজা নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য এই স্থানটি প্রতিষ্ঠা করেন বলে ধারণা করা হয়। পরে সোমবংশী রাজারা এই মঠ ও স্তূপগুলির প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নেন।
রত্নগিরি, ললিতগিরি ও উদয়গিরি—এই তিনটি স্থান মিলে গঠিত “ডায়মন্ড ট্রায়াঙ্গেল অব ওড়িশা”, যা প্রাচীন বৌদ্ধ শিক্ষা ও স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই ত্রয়ীর মধ্যে রত্নগিরিকেই সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও অলংকৃত বলে মনে করা হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার
১৯৬০-এর দশকে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (ASI) এই স্থানে খননকাজ শুরু করলে, উন্মোচিত হয় একের পর এক বিস্ময়। আবিষ্কৃত হয় একাধিক স্তূপ, মঠ, প্রার্থনাগৃহ, মূর্তি, ফলক ও পাথরের শিলালিপি।
রত্নগিরির প্রধান আকর্ষণ হলো এর দুটি বিশাল বৌদ্ধ বিহার (মঠ), যেগুলিতে রয়েছে অলংকৃত দরজা, খোদাই করা বুদ্ধমূর্তি এবং পাথরে গাঁথা দালান। একাধিক স্তূপের মধ্যে একটি বড় স্তূপ বিশেষভাবে বিখ্যাত, যার ভিতরে পাওয়া গেছে পবিত্র অবশেষ (রেলিক) — যা প্রমাণ করে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল।
এখানকার অমিতাভ বুদ্ধ, অবলোকিতেশ্বর, তারা দেবী, বজ্রপাণি প্রভৃতি মূর্তিগুলি অসাধারণ নৈপুণ্যে গড়া, যা তখনকার বৌদ্ধ শিল্পকলার শীর্ষস্থানীয় উদাহরণ।
️ প্রাকৃতিক পরিবেশ
রত্নগিরির আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেন মনকে প্রশান্ত করে। সবুজ পাহাড়, ঝর্ণার মিষ্টি সুর, আর পাথরে গাঁথা মঠগুলির নিঃশব্দ স্থিতি — সব মিলিয়ে এক আধ্যাত্মিক আবেশ ছড়িয়ে থাকে চারপাশে। গ্রীষ্মে গরম কিছুটা বেশি হলেও শীতকালে বা বর্ষার শেষে এই জায়গাটি হয়ে ওঠে ভ্রমণের জন্য আদর্শ।
পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে তাকালে দেখা যায়, কৃষ্ণা ও ব্রাহ্মণী নদীর উপত্যকা দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, যেন প্রকৃতিও এখানে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে।
♀️ আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতি
রত্নগিরি কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের স্থান নয়, এটি ছিল ধ্যান ও শিক্ষা কেন্দ্র। এখানে বহু ভিক্ষু ও পণ্ডিত আসতেন ধ্যান, পাঠ ও তর্কবিতর্কের জন্য। অনেক গবেষকের মতে, বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বশান্তি স্তূপ-এর সঙ্গে রত্নগিরিরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
রত্নগিরি মহাযান বৌদ্ধধর্মের ‘বজ্রযান’ শাখার অন্যতম ভিত্তিস্থল হিসেবে পরিচিত। এখানকার স্তূপ ও মূর্তিগুলিতে বজ্রযান দর্শনের প্রতীক ও মন্ত্র খোদাই করা আছে, যা আজও স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
️ স্থাপত্যশৈলী
রত্নগিরির স্থাপত্য অনন্য। এর পাথরের কাজ, মূর্তির নকশা, এবং স্তম্ভের বিন্যাসে দেখা যায় গুপ্ত যুগের উন্নত শিল্পরীতি। মঠের প্রধান প্রবেশদ্বারগুলিতে সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা লোটাস, ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ, সিংহ, ও পৌরাণিক চিত্র দেখা যায়।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো রত্নগিরি মঠের প্রবেশদ্বার, যেখানে একটি বিশাল বজ্রপাণি মূর্তি পাহারা দেয়, আর তার পাশে দুই দেবী—পদ্মপাণি ও তারা—স্থিত আছেন। এই দৃশ্য যেন এক পাথরে খোদাই করা ধর্মীয় কাব্য।
কীভাবে পৌঁছানো যায়
- নিকটতম শহর: ভুবনেশ্বর (প্রায় ৯০ কিমি)
- নিকটতম রেলস্টেশন: জাজপুর-কেয়নঝর রোড (৪০ কিমি দূরে)
- নিকটতম বিমানবন্দর: ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর
ভুবনেশ্বর বা কটক থেকে ট্যাক্সি বা বাসে সহজেই রত্নগিরি পৌঁছানো যায়।
️ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
রত্নগিরিতে পা রাখলেই মনে হয়, সময় যেন থমকে গেছে। পাথরের মঠের ছায়ায় দাঁড়িয়ে যখন প্রাচীন স্তূপের দিকে তাকাও, তখন এক গভীর নীরবতা ঘিরে ধরে। যেন শোনা যায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রার্থনার ধ্বনি, আর দেখা যায় প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ও সাধনার চিত্র।
এখানে সূর্যাস্তের দৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর—সূর্যের শেষ আলো যখন স্তূপের মাথায় পড়ে, তখন রত্নগিরি যেন সত্যিই এক ‘রত্নের পাহাড়’ হয়ে ওঠে।
উপসংহার
রত্নগিরি কেবল ওড়িশার নয়, সমগ্র ভারতের এক গৌরবময় ঐতিহ্য। এখানে ইতিহাস, ধর্ম, ও শিল্পের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে এক চিরন্তন শান্তির প্রতীক। বৌদ্ধ দর্শনের “মৈত্রী” ও “অহিংসা”র মন্ত্র যেন এখনো প্রতিধ্বনিত হয় এই প্রাচীন গিরিপথে।
যারা ভ্রমণের সঙ্গে ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া খোঁজেন, তাদের জন্য রত্নগিরি নিঃসন্দেহে এক স্বপ্নের গন্তব্য।












Leave a Reply