মেঘালয়ের নংরিয়াট রুট ব্রিজ – প্রকৃতির সৃষ্ট এক আশ্চর্য সোপান ।

 

পৃথিবীতে কিছু স্থান আছে যেগুলি মানুষের কল্পনাকে হার মানিয়ে দেয় প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টিতে। মেঘালয়ের নংরিয়াট (Nongriat) গ্রামে অবস্থিত “ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ” বা জীবন্ত শিকড়ের সেতুটি তেমনই এক অবিশ্বাস্য সৃষ্টি। শিলং থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে চেরাপুঞ্জির অন্তর্গত এই গ্রাম যেন প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এক জাদুকরী রাজ্য।


জীবন্ত শিকড়ের সেতুর ইতিহাস ও বিস্ময়

নংরিয়াট গ্রামের এই সেতুটি তৈরি হয়েছে ভারতের খাসি জনগোষ্ঠীর প্রাচীন জ্ঞান ও প্রকৃতি-নির্ভর কারিগরির ফলস্বরূপ। প্রায় ১৮০ বছরের পুরোনো এই সেতু কোনো পাথর বা লোহা দিয়ে তৈরি নয়—এটি গঠিত হয়েছে রাবার গাছের (Ficus elastica) শক্ত ও নমনীয় শিকড় দিয়ে।

খাসি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে থেকে নদী পারাপারের সহজ উপায় হিসেবে এই জীবন্ত সেতু নির্মাণ করেছে। তারা গাছের শিকড়গুলো বাঁশের ফাঁকা টানেলের মাধ্যমে বিপরীত তীরে ছড়িয়ে দেয়, আর ধীরে ধীরে শিকড়গুলি বড় হতে হতে একটি মজবুত প্রাকৃতিক সেতুর আকার নেয়।

নংরিয়াটে এমন এক নয়, দুটি স্তরে গঠিত “ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ”, যা বিশ্বের একমাত্র দ্বিস্তরীয় জীবন্ত সেতু।


️ চেরাপুঞ্জির পথে যাত্রা

নংরিয়াট পৌঁছানোর জন্য প্রথমে যেতে হয় চেরাপুঞ্জি শহরে, যাকে পৃথিবীর অন্যতম বৃষ্টিপ্রবণ স্থান বলা হয়। সেখান থেকে ট্যাক্সি বা জিপে করে পৌঁছানো যায় তির্না গ্রামে (Tyrna Village)। এখান থেকেই শুরু হয় প্রকৃত অভিযান।

তির্না থেকে নংরিয়াট গ্রামের পথে প্রায় ৩,৫০০ ধাপের সিঁড়ি নামতে হয়। পথটি জঙ্গলে ঘেরা, পাশে ঝরনার কলকল ধ্বনি, পাখির গান, আর মাঝেমধ্যে বৃষ্টি যেন পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বোঝা যায়, প্রকৃত সৌন্দর্য শুধু গন্তব্যে নয়, পথের প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে থাকে।


নংরিয়াট গ্রামের স্বর্গীয় রূপ

নংরিয়াটে পৌঁছেই যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা জীবনের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। নিচে ঝুলছে জীবন্ত শিকড়ের সেতু, তার নিচে স্বচ্ছ নীলচে নদী, চারপাশে পাহাড়ের সবুজে মোড়া বৃষ্টি ভেজা জঙ্গল।

এই সেতুর উপর দিয়ে হাঁটলে মনে হয় যেন আমরা প্রকৃতির বুকে ভেসে আছি। এর পুরু, শক্ত শিকড়গুলো এতটাই স্থিতিশীল যে একসঙ্গে ৫০ জন পর্যন্ত সহজে পার হতে পারেন।

সেতুর পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর জল এতই স্বচ্ছ যে নিচের পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। অনেক পর্যটক এখানে এসে নদীতে স্নান করেন বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন প্রকৃতির নীরবতায়।


স্থানীয় সংস্কৃতি ও আতিথেয়তা

নংরিয়াট গ্রামের মানুষরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ও অতিথিপরায়ণ। এখানে কিছু হোমস্টে ও ছোট কটেজ আছে, যেখানে পর্যটকরা থাকতে পারেন। সন্ধ্যায় গ্রামের লোকজন আগুন জ্বালিয়ে গান গায়, পাহাড়ি খাবার পরিবেশন করে, আর গল্পের ফাঁকে ফাঁকে শোনায় তাদের ঐতিহ্যের কাহিনি।

এখানকার খাবারের মধ্যে আছে চালের পিঠে, বাঁশের কুঁড়ি দিয়ে রান্না করা মাংস, ও স্থানীয় ভেষজ চা — যা একেবারে অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেয়।


ভ্রমণের সেরা সময়

নংরিয়াট ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হল অক্টোবর থেকে এপ্রিল। বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও স্রোতের কারণে পথ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তবে বৃষ্টির মৌসুমে এখানে এসে প্রকৃতির রূপ অন্য মাত্রা পায় — জঙ্গলে সবুজের বিস্তার, ঝরনার গর্জন আর মেঘের খেলা মন ছুঁয়ে যায়।


ভ্রমণ পরামর্শ

  • হাঁটার জন্য আরামদায়ক জুতো পরুন।
  • একটি ছাতা বা রেইনকোট রাখুন।
  • পানি ও হালকা খাবার সঙ্গে রাখুন।
  • পরিবেশ দূষণ থেকে বিরত থাকুন — এখানে কোনো প্লাস্টিক ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

উপসংহার

মেঘালয়ের নংরিয়াট রুট ব্রিজ শুধু একটি ভ্রমণ গন্তব্য নয়, এটি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সহাবস্থানের এক জীবন্ত নিদর্শন। এখানে এসে বোঝা যায়, মানুষ যদি প্রকৃতিকে ভালোবাসে ও তার সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে শেখে, তবে প্রকৃতিও মানুষকে এমন অলৌকিক সৌন্দর্য উপহার দেয়, যা কোনো আধুনিক স্থাপত্য দিতে পারে না।

নংরিয়াটের সেই জীবন্ত সেতু যেন বলে — “প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ো, কারণ প্রকৃতি চিরজীবী।”

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *