আজ একবিংশ শতকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত বিশ্বের মানুষ এক অজানা,অচেনা রোগের প্রাদূর্ভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত-দিশেহারা।এই অজানা নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগের উৎপত্তি চীনে হলেও কি থেকে এই রোগের সৃষ্টি হচ্ছে এবং কিভাবেই বা এই রোগ নির্মূল করা যাবে সে বিষয়ে কোনো দেশই দিশা দেখাতে পারছে না।প্রতিদিন যেভাবে এই রোগের আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং যেভাবে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তাতে বোঝা যাচ্ছে মানুষ আজ বড় অসহায়।
এই বিশ্বে মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রকার বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছে-দুই মহাযুদ্ধে লক্ষলক্ষ মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছিল,আবার প্রাকৃতিক দূর্যোগ আইলা-সুনামি-বুলবুল-ভূমিকম্পের প্রকোপে লক্ষ-লক্ষ মানুষ,ঘরবাড়ি,শস্য অবলুপ্ত হয়েছে,এদেশে কলেরা-ম্যালেরিয়া-প্লেগ-এডস প্রভৃতি মহামারী,এমনকি বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রাদূর্ভাবে প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুর করাল গ্রাসে পতিত হয়েছিল।কিন্তু বর্তমানে এই করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর মতো বিশ্বব্যপী বিপর্যয় আর কখনো ঘটেছে বলে জানা নাই।আজ সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশে এক অনিশ্চয়তার পরিবেশ গড়ে উঠেছে যার থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে মানুষ দিশেহারা।
করোনা ভাইরাস দেখিয়ে দিল,মানুষের হাতে তৈরি রাষ্ট্রের লৌহ দৃঢ় সীমানা কিছুই নয়।একের পর এক রাষ্ট্রের নিশ্ছিদ্র সীমানা তছনছ করে ভৌগোলিক দূরত্ব্ব উড়িয়ে ধনতন্ত্রের যাবতীয় গর্ব চূর্ণ করে করোনা ভাইরাস অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার মতই যেন অপ্রতিরোধ্য। উন্নত,উন্নতশীল ও অনুন্নতর ভেদাভেদ একাকার হয়ে গেল।
আজ যখন উচ্চ ও মধ্যবিত্তের আর্তনাদ শোনা যায়-বস্তির লোকজন,পরিযায়ী শ্রমিকগণ,পৌরসভার চোখে যারা অবৈধ দখলদার,ঠিকাদারের চোখে লেবার,শহরের বাবুদের কাছে দৃশ্যদূষণকারী,রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ফালতু অ-ভোটার ‘তারা কিছু মানছে না’ ‘ঘরে থাকছে না ওরা’ ‘ওরাই ছড়িয়ে দেবে সংক্রমন।’আগে আমরা এই সমস্ত তথাকথিত মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের অধিকার নিয়ে কোনো কথা বলিনি।আজ আমরা এই সংক্রমণ প্রবণ মানুষদের নিয়েই যত আতঙ্কিত।আমাদের সরকার এদের জন্য কী কী ব্যবস্থা নিল? অগ্রিম ঘোষণা ছাড়াই মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে জারি হলো সমস্ত দেশে ‘লক-ডাউন’। অথচ সরকার যেটা অতি সহজে করতে পারতো-বিমান বন্দরে প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা,সংক্রামিত দেশ থেকে আসা বিমানযাত্রীদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা।এইসব কাজের পরিবর্তে এই মহাবিপর্যয়ের পরে দেখা গেল শতশত শ্রমিককে প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে পায়ে হেঁটে ফিরতে হচ্ছে এবং যাদের উপর হোসপাইপে ‘ক্লোরিন জল’ ছিটিয়ে স্যানিটাইজ করার মতো এক হাস্যকর ও আমানবিক কাজ চলছে।
যাক এইসব তথ্য আর বেশি বিশ্লেষণ করে তিক্ততা বৃদ্ধিকরে লাভ নেই।এখন দেখা যাক আমাদের দেশ এই মহামারীর হাত থেকে বাঁচতে কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।আমাদের দেশে আপাতত ৩রা মে পর্যন্ত লকডাউনে ঘোষণা করা হয়েছে – আরো এই লকডাউন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা ভবিষ্যৎই বলবে।এই লকডাউনে বলা হয়েছে- প্রত্যেককে পৃথকভাবে দূরত্ব বজায় রেখে থাকতে হবে, ব্যক্তিগত ভাবে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে, মানুষকে নিজের ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকতে হবে,সর্দি,কাশী,শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে পরীক্ষা করাতে হবে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সমাজসেবক ডাক্তারবাবু,নার্স ও স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মচারীবৃন্দ যারা প্রানের ঝুঁকি নিয়ে রুগীদের সেবা করে চলেছেন,পুলিশকর্মীরা লকডাউনের বিধিগুলিকে কার্যকরী করার জন্য ছুটি না নিয়ে সদাসতর্ক পাহাড়া দিচ্ছেন,সরকার বিনামূল্যে সকলশ্রেণীর মানুষকে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগানোর জন্য কিছুটা চেষ্টা করছেন।
এরূপ অবস্থায় আমাদের শিক্ষকগণের ভূমিকা কি হওয়া উচিৎ? আমরা কী হাতগুটিয়ে ঘরে বসে থাকবো?
আমাদের শিক্ষাদপ্তর স্কুলে কলেজে ১০ই জুন পর্যন্ত ছুটি ঘোষনা করেছে।তাছাড়া শিক্ষাদপ্তর জানিয়েছে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের বিনা পরীক্ষায় পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করে দেওয়া হবে ।তাই ছাত্রছাত্রীরাও নিশ্চিন্তে বইপত্র গুটিয়ে দিয়ে টি ভি, মোবাইল বা অন্য আনন্দ দায়ক খেলা ধুলার কাজে নিজেদের নিযুক্ত রেখেছে।আর এই সুযোগে অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ স্কুলের ছুটি পেয়ে বাড়িতে বসে পরিবারের সঙ্গে মহানন্দে দিন কাটাচ্ছেন।
কিন্তু এই অবস্থায় আমার মনে হয়,শিক্ষক সমাজের কিছু দায় বদ্ধতা থাকা উচিত।শিক্ষকগণ সমাজেরবন্ধু এবং সমাজের অন্যতম কারিগর।তাই সমাজের ও দেশের এই বিপর্যয়ের দিনে শিক্ষকগণকে শিক্ষার আলোকশিখা জ্বেলে রাখার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।স্কুল বন্ধ থাকার এবং পরীক্ষা না দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকায় অনেক ছেলে মেয়ে পড়াশুনা না করে বইপত্র বাক্সবন্দি করে রেখেছে।বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা একপ্রকার ত্যাগই করেছে।তারা পড়াশুনা করবেই বা কার কাছে?অধিকাংশ অভিভাবক অশিক্ষিত, তার মাঠে ঘাটে কর্মে ব্যস্ত থাকে, তারা পড়াশুনার মর্ম বোঝে না,ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা বিষয় দেখিয়ে দেবার ক্ষমতাও তাদের নেই।এর ফলে সুদূর পল্লীগ্রামে শিক্ষার আলো একেবারে নিভে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।কতদিন স্কুল বন্ধ থাকবে,কতদিন লকডাউন চালু থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।এরূপ অবস্থায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ যাঁরা যে অঞ্চলে বাস করেন তাঁরা সেখা্নে থেকেই তাঁর পার্শবর্তী প্রতিবেশী ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটু শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে পারেন তা হলে হয়তো শিক্ষার দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত থাকবে।
এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষাচিন্তা নিয়ে তাঁর একটা ভাবনার কথা বলেছিলেন ,সেটা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি।তিনি ছাত্রদের শিক্ষা সম্পর্কে একটা বাস্তব কথা বলেছিলেন যে,গ্রামে গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলে দিলেও খুব গরীব ঘরের ছেলে মেয়েরা স্কুলে পড়তে আসবে না।কারন তারা জীবিকা অর্জনের জন্য ক্ষেত খামার কিংবা বিভিন্ন ছোটখাট কাজ করতে ছুটবে।তিনি এই সমস্যার সমাধানের জন্য একটা পথ বার করেছিলেন।তিনি বলেছেন – “যদি পর্বত মহম্মদের কাছে না আসে তবে মহম্মদকে পর্বতের কাছে যেতে হবে।অর্থাৎ দরিদ্র ছেলেগুলো যদি বিদ্যালয়ে আসতে না পারে তবে শিক্ষাকেই চাষীর লাঙ্গলের কাছে,মজুরের কারখানায় এবং অন্য সব স্থানে নিয়ে যেতে হবে। নিঃস্থার্থ,সৎ ও শিক্ষিত শতশত ব্যাক্তিকে গ্রামে গ্রামে,প্রতি দ্বারে দ্বারে শিক্ষার আলোকবর্ত্তৃকা বহন করে নিয়ে যেতে হবে।”
কিন্তু আমি দেশের বর্তমান এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শিক্ষকগণকে ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলছি না,বরং লকডাউনের সময়ে ছাত্রছাত্রীরা নিজ নিজ বাড়িতে থাকবে এবং শিক্ষক মহাশয়গণও নিজ নিজ বাড়িতে থেকে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি যথা – ফোন, ই-মেল, SMS, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব অন্যান্য অ্যাপস ইত্যাদির মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা বিষয়ে অনেক কিছু আলোকপাত করতে পারেন।
ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনস্ত বিদ্যালয়গুলির পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীর প্রতি বার্তা পাঠিয়েছে –
কারো বাড়িতে বা পাড়ায় বা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে V – X শ্রেণী পর্যন্ত বর্তমানে পাঠরত যদি কোনো ছাত্রছাত্রী থাকে তাহলে তাদেরকে বলবেন যে, তাদের ক্লাসের প্রতিটি বিষয়ে ফার্স্ট ইউনিটের সিলেবাসের ভিত্তিতে কিছু হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছে ‘বাংলার শিক্ষা’ পোর্টালে,লকডাউন পিরিয়ডে বাড়িতে বসে কিছু Activity Task করার জন্য।স্কুল যখন আবার খুলবে তখন ঐ প্রশ্নগুলো সংশ্লিষ্ট স্কুলের বিষয় শিক্ষককে অবশ্যই দেখাতে হবে।যতটা পারবেন এই বার্তা বা টাস্কগুলো ছড়িয়ে দিন আপনার নিকটস্থ মূলত V-X ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তা যে স্কুলেরই হোক না কেনো আপনার বা ছাত্রছাত্রীরা কেউ এর জন্য ঘর থেকে বার হবেন না।ঘরে বসে থেকেই প্রযুক্তির সাহায্যে যতোটা পারবেন সবাইকে এই Activity Task এর বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করবেন, কারন অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই এই পোর্টালের বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নয় বা তাদের পক্ষে এটার নাগাল পাওয়াও সহজ নয়।
বর্তমান লকডাউনের পিরিয়ডে ছাত্র ছাত্রীদের কাছে পৌঁছানোর এটাই প্রকৃত রাস্তা।তাই ছাত্র- ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি-অভিভাবক সকলের কাছে একজন শিক্ষক হিসাবে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ আপনারা শিক্ষাবিভাগের এই Activity Task এর বার্তাটি টার্গেটেড করে ছাত্র ছাত্রীর কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ ব্যক্তিগত ভাবে গ্রহণ করুন এবং কোভিড-১৯ এর জন্য সমস্ত সরকারী নির্দেশিকা কঠোরভাবে পালন করেও ছাত্রছাত্রীদের ঘরে বসে পঠন পাঠনে উৎসাহিত করুন।এ প্রসঙ্গে বলাবাহুল্য কিছু সহৃদয় শিক্ষক শিক্ষিকা এবং কতিপয় স্কুল ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাঁদের ধন্যবাদ প্রাপ্য কিন্তু সেটা এতই নগন্য যে আমাদের শিক্ষক সমাজের সুনামের সাথে সেটা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।তাই এই বিপর্যয়ের সময় এভাবে আমরা শিক্ষকসমাজ শুধুমাত্র হাতগুটিয়ে বসে না থেকে যদি মনদিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাই তাহলে শিক্ষার উপায় বার হবেই এবং তাতে সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষার আলোকবর্ত্তৃকা প্রজ্জ্বলিত থাকবে।
পরিশেষে বলি,দেশের এই কঠিন অবস্থায় আপনারা সকলে আতঙ্কিত না হয়ে এবং আতঙ্ক বা গুজব না ছড়িয়ে সচেতন থাকুন,সুস্থ থাকুন।সমষ্টিগত ভাবে এই জটিল মারনরোগের বিরুদ্ধে লড়াই করুন।এই অন্ধকারের সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আমরা একদিন আলোর দিশা দেখবোই।আমরা মনের জোরে বলবো –
“আমরা করবো জয়,আমরা করবো জয়,আমরা করবো জয় নিশ্চয়।”
প্রশান্ত কুমার দাস,
শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক (বাজিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়(উঃমাঃ)
পোঃ-পাথাই, ময়ূরেশ্বর-১,বীরভূম)
মোবাইলঃ-9474731116, e-mail-prasantakd1971@gmail.com
Leave a Reply