সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ মরিচঝাঁপি তে গিয়ে ঐতিহাসিক মরিচঝাঁপি দিবস পালন করলো বিজেপি রাজ্য, জেলা নেতৃত্ব।

সুভাষ চন্দ্র দাশ,সুন্দরবন- প্রত্যন্ত সুন্দরবন এলাকার ঐতিহাসিক দ্বীপ মরিচঝাঁপি।আর দীর্ঘ নদীপথ অতিক্রম করে ঐতিহাসিক সেই মরিচঝাঁপি দ্বীপে গিয়ে সোমবার মরিচঝাঁপি দিবস পালন করলো রাজ্য,জেলা বিজেপির নেতৃত্বরা।প্রত্যন্ত সুন্দরবনে দ্বীপে গিয়ে ‘মরিচঝাঁপি’ দিবস পালন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদিকা তথা বিধায়িকা অগ্নিমিত্রা পাল,রাজ্য বিজেপির মুখপত্র দেবজিৎ সরকার,রাজ্য তপঃশিলি মোর্চার সভাপতি ডঃ সুদীপ দাস,দক্ষিণ ২৪ পরগনা পূর্ব জেলার সভাপতি উৎপল নস্কর,বিধায়ক অম্বিকা রায়,বিধায়ক অশোক কীর্তনিয়া সহ একঝাঁক রাজ্য ও জেলা বিজেপির নেতৃত্ব।বিজেপির নেতৃত্বের দাবী আগামী দিনে সরকার কে মরিচঝাঁপি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দোষীদের কে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি বিজেপি নেতৃত্বের দাবী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে দেশের প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে উদ্বাস্তু শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের স্বপ্ন পূরণ করেছেন তাতে করে মরিচঝাঁপি হত্যকান্ডের অসহায় উদ্বাস্তুদের আত্মার শান্তি পেল প্রাথমিক ভাবে।’
উল্লেখ্য বিশ্ব মানচিত্রে ভারতীয় ভূখন্ডের সুন্দরবনে অবস্থিত মরিচঝাঁপি দ্বীপ । পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবনের উত্তরভাগে অবস্থিত ১২৫ বর্গমাইলের দ্বীপ টি মরিচঝাঁপি নামেই পরিচিত। যেখানকার অধিকাংশ জায়গা ছিল শ্বাপদসংকুল। ১৯৪৭ দেশভাগের বলি হওয়া পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) বহু বাঙালি হিন্দু পরিবার তাদের চোদ্দপুরুষের ভিটে ছেড়ে বিভিন্ন সময়ে পাড়ি দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে। যারা সামান্য কিছু অর্থকড়ি আনতে পেরেছিলেন তারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে কিছুটা মাথা গোজার ঠাঁই তৈরী করতে সক্ষম হলেও সর্বাধিক বিপদে পড়ে যায় নিন্মশ্রেণির নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুরা। মুসলিম মৌলবাদীদের অত্যাচারে ভিটেহারা অসহায় লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দু খোলা আকাশের নিচে পরিবারবর্গ নিয়ে পশুর দিন কাটাতে থাকে। এরপর ‘দণ্ডকারণ্য প্রজেক্ট’ গড়ে উঠলে তাদের কে পাঠানো হয় বাংলা থেকে বহুদূরে। রামায়নে উল্লেখিত মধ্যপ্রদেশ-ছত্তিশগড়ের দন্ডকারণ্যে, উড়িষ্যার মালকানগিরির মতো ১৬৪ টি দুর্গম প্রান্তে। দণ্ডকারণ্যের পাথুরে জমি, শুকনো মাটি এবং অসহ্য খরায় তপ্ত বনভূমি সম্পূর্ণরূপে বাসের অযোগ্য। কোন কোন পাহাড়ি এলাকায় ছিল হিংস্র সব প্রাণীর আনাগোনা। ছিলোনা খাওয়ারজন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা।বসবাসহীন এই পরিবেশে থেকে নিজের আত্মীয়কে মরতে দেখেছে অসংখ্য ভিটেহারা বাঙালি। মৃত্যুর পর মরদেহ ট্রাকে তুলে নিয়ে ফেলে দেওয়া হতো।এমন মর্মর করুণার নিদর্শন পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে বিনোদ মজুমদার নামের এক শরণার্থী পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“১৯৬৪ এ যখন মানা ক্যাম্পে আসি, একটু জল ছিল না। সকাল বেলা জলের কলের গোড়ায় কম করে হলেও ৫-৬ টা মার্ডার হয়েছে এক মগ জলের জন্য।”

এর থেকে বুঝতে পারা যায় লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু বাঙালিকে ওই ক্যাম্পগুলোতে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যে কি নিদারুন জীবনযুদ্ধ করতে হয়েছিল।তৎকালীন সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু বামপন্থী নেতা সেইসব ক্যাম্পে গিয়ে তাদের পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। বিশেষত ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা রাম চ্যাটার্জির প্রতিশ্রুতিতে, বাঙালি হিন্দুর জন্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির রক্ষিত পশ্চিমবঙ্গে ফেরার স্বপ্ন দেখতে থাকেন ভিটেহারা বাঙালিরা। উদ্বাস্তু নেতা সতীশ মণ্ডল এবং তার সঙ্গীদের বলা হয়, বামেরা ক্ষমতায় এলে শরণার্থীদের সুন্দরবনের নিকট একটি সুন্দর জনপদে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। অনেকে তখন মরিচঝাঁপির নাম প্রস্তাব করেন। এসব কথা শুনে বড় আশ্বাস পান অবহেলায় থাকা হতদরিদ্র বাঙালিগুলো।

১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসীন হয় বামফ্রন্ট। সাথে সাথেই তাদের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেন সতীশ মণ্ডল। কিন্তু তার আবেদনের জবাবে আগের অবস্থান থেকে সরে আসে তৎকালীন সময়ের জ্যোতি বসুর বামফ্রন্ট সরকার। এই পদক্ষেপ সরকার নিতে পারবে না বলে জানান তিনি। সরকারের সাহায্য না পেয়ে হতাশ হয়ে যাননি এই শরণার্থীরা। দণ্ডকারণ্যের ঘন জঙ্গল, খাবার জলের অপ্রতুলতা ও ম্যালেরিয়া,ডায়রিয়াসহ অন্যান্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে ১৯৭৮ সালে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী বাংলায় ফিরতে শুরু করে। প্রায় দেড় লক্ষ শরণার্থী দন্ডকারণ্য ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসলে উদ্বাস্তুদের কয়েকজনকে আটক ও বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু অনেকেই পুলিশি বেষ্টনী উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে পেরেছিল। প্রায় ৩০,০০০ এরও বেশি উদ্বাস্তু প্রথমেই আশ্রয় নিয়ে ছিলেন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত মরিচঝাঁপি দ্বীপে। সদা পরিশ্রমী এই খেটে খাওয়া অসহায় বাঙালি হিন্দুগুলো নিজেদের চেষ্টায়, সরকারের সাহায্য ছাড়াই জঙ্গল পরিষ্কার করে।বন্যা থেকে বাঁচার জন্য বাঁধ নির্মাণ, মৎস্য চাষ ও চাষাবাদের ব্যবস্থা করে। নির্মাণ করা হয় স্কুল, হাসপাতাল, দোকানপাট, পানীয় জলের জন্য টিউবওয়েল, মাছ চাষের অভিনব সব পদ্ধতি। মাছ চাষ করে নিজেদের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি তারা বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করারও চিন্তা করছিলেন। মাত্র পাঁচ-ছ’মাসের মধ্যে একটি বিস্তীর্ণ এলাকাকে আদর্শ এক জনবসতি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সরকারের তরফ থেকে সাহায্য না পেলেও বিভিন্ন সংস্থা কিংবা গানের জলসা থেকে সামান্য সাহায্য পেতেন তারা। আশা করেছিলেন, তাদের পরিশ্রমের ফলে গড়ে ওঠা এই জনপদটিকে সরকার স্বীকৃতি দেবে।
কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বামপন্থী অমানবিক সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার চিত্র ফুটে উঠতে শুরু করে।১ জুলাই, ১৯৭৮ সালে সিপিএমের রাজ্যসভার বৈঠকে তাদেরকে এই জায়গা ছেড়ে দিতে বলা হয়। তারা না ছাড়লে তাদের দেখাদেখি অন্যরাও সেখানে যেতে উৎসাহ পাবে বলে যুক্তি দেয়া হয়। বলা হয়, তাদের দখল করা মরিচঝাঁপি হচ্ছে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের অংশ। সেখানে তাদের অবস্থান বে-আইনী। কিন্তু মানচিত্র অনুযায়ী তা বে-আইনী ছিল না। তাদের আশপাশের দ্বীপবাসীদের বলা হতে থাকে যে, মরিচঝাঁপির এসব শরণার্থী তাদের জীবনে বিপর্যয় বয়ে নিয়ে এসেছে। তাদের বিতাড়িত না করলে এই দ্বীপবাসীরা স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন না।

হাওয়ায় ভাসতে থাকে বিভিন্ন ‘সংবাদ’। বলা হয়- মরিচঝাঁপিতে একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে, সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তারা সুন্দরবনের গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করছে।বিভিন্ন সংবাকে বলা হয় সরকারকে সাহায্য করতে।

কিছুতেই কাজ না হলে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে সরাসরি আক্রমণ করে এসব উদ্বাস্তুদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩০টি লঞ্চ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় সর্বহারাদের আশ্রয় নেওয়া মরিচঝাঁপি দ্বীপটিকে। এসব লঞ্চে অবস্থান করেন সরকারের মোতায়েন করা পুলিশ বাহিনী। বন্ধ করে দেওয়া হয় এই দ্বীপের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা। যাতে করে মরিচঝাঁপি দ্বীপের শরণার্থীরা যেন নদী পারাপার হয়ে পাশের অন্যত্র কুমিরমারী গ্রামে ঔষধ,খাদ্যশস্য ও জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য কিনতে যেতে না পারে। সেদিনগুলোর ঘটনা স্মৃতিচারণ করে পুলিশ ও কমিউনিস্টদের হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসাদের একজন নারায়ণ মন্ডল। তিনি উল্লেখ করেন – সেদিন ৩০ থেকে ৩৫ টি লঞ্চ সহকারে পুলিশ পুরো দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলে। কুমিরমারী থেকে খাবার জল আনতে যাবো, সেই পরিস্থিতিও ছিল না। আমাদের জীবনকে দূর্বিসহ করে তোলার জন্য তারা উঠে-পড়ে লেগেছিল। অসহায়ভাবে খিদের জ্বালায় তাই আমরা নারকেলের পাতা ও ঘাস ( যদু পালং) খেতে বাধ্য হই।শিশুদের অনেকেই শুধু ডায়রিয়াতেই মারা যায়। পাশের কুমিরমারী গ্রাম থেকে খাবার জল, ঔষুধ এবং আহার-সামগ্রী যোগানের জন্য অবরোধের দশম দিনে আমরা মরিয়া হয়ে উঠি। নারীদের দেখে অত্যন্ত মায়া-দয়া হবে এই আশায় আমরা একটা নৌকাতে ১৬ জন মহিলাকে পাঠাই। কিন্তু “ইন্দ্রজিৎ এমভি ৭৯” নামের একটি লঞ্চ দ্রুত গতিতে মহিলাদের নৌকাটির দিকে এগিয়ে আসে এবং নদীর মাঝপথে নৌকাটিকে বিধ্বস্ত করে। ১৪ জন নারীকে আমরা ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করি। আর পরবর্তীতে বাকি দুজন কে বাগনান জঙ্গল থেকে তাদের দেহ উদ্ধার করি, যাদের উপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। ৩১ জানুয়ারি, ১৯৭৯ উদ্বাস্তুদের উদ্দেশ্য করে প্রথম গুলি চালানো হয়। ওইদিন দুপুরের দিকে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন উগ্রবাদী মুসলিমদের তোষামোদকারী নাস্তিকদের দ্বারা গঠিত বামফ্রন্ট সরকারের পরিচালিত পুলিশ দল দ্বীপের মধ্যে ঢুকে উদ্বাস্তুদের হত্যা করার জন্য লাগাতার গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনার শিকার আরেকজন শরণার্থী মুকুন্দ মন্ডল স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন –

দুপুর ৪টে নাগাদ পুলিশরা আমাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমরা সে সময় একটা নৌকাতে করে দ্বীপ ছেড়ে পাশের কুমিরমারী গ্রামে পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে চাইছিলাম। চারদিক প্রবল আতঙ্ক ভর করেছিল সে সময়। সে সময় আমার নাতনির বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে একটা গুলি তার গায়ে এসে লাগে এবং নৌকাতেই তার মৃত্যু হয়। আমাদের তার মৃত দেহ নদীর জলে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমরা এতোটাই অসহায় হয়ে পড়েছিলাম সেই সময়।

হত্যার পর পুলিশ ও সিপিএমের দলীয় কর্মীরা মৃতদেহগুলোকে নদীতে ফেলে দেয়। আবার অনেকেরই নদী সাঁতরে পালাতে গিয়ে ডুবে মৃত্যু হয়। ঘটনার পঞ্চদশ দিনে কোলকাতা হাইকোর্ট মরিচঝাঁপি দ্বীপে খাবার জল, প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং ডাক্তারদের প্রবেশের অনুমতি প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে মরিচঝাঁপি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু ঢালী বলেছিলেন “ঘাস খেয়েছে মানুষে। শুনেছেন কোনোদিন?জীবন বাঁচানোর তাগিদে মানুষে ঘাস খায়? ঘাস খেয়েছে!”। খাদ্য না পেয়ে ঘাস-লতা-পাতা খেতে থাকে সেখানকার মানুষজন। মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান জলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক অবরোধ, ক্ষুধাপিপাসায় ক্লান্ত মরিচঝাঁপির নমঃশূদ্র উদ্বাস্তু হিন্দুরা তাও ঘাস পাতা খেয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। বর্ষার জল ধরে রেখে সেখানকার মানুষ সেই জল দিয়ে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ করতেন। কিন্তু তাদের সেই জলেতে রাতে এসে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে দেওয়া হয়। এতে করে সেখানকার জল ব্যবহারকারীরা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন। খাদ্য আনতে যাওয়া হলে ২০-৪০ জন যুবককে গুলি করে মারা হয়। শুরু হয় হত্যার লীলাযজ্ঞ। বাংলার বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে অশিক্ষিত নমঃশূদ্রদের প্রতি চূড়ান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তখন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। তারা চিন্তা করছেন, কীভাবে তাদের মদতপুষ্ট সরকার পরেরবার গদি টিকিয়ে রাখবে।
প্রায় পাঁচমাস অবরুদ্ধ করে রাখার পরেও যখন দ্বীপবাসী জীবন বিসর্জন দিয়েও টিকে আছেন, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়- সরাসরি এই দ্বীপে আক্রমণ করে তাদের বিতাড়িত করা হবে। ১৩ই মে, ১৯৭৯ সালে রাজ্যের সিপিআই(এম) চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করে। সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের উক্ত দ্বীপে প্রবেশের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। পুলিশের সহায়তায় সিপিএমের ক্যাডাররা জ্বালিয়ে দেয় বাসিন্দাদের কুঁড়েঘর। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় অনেককেই। গ্রেফতার করা হয় সেখানকার যুবকদের। আর নারীরা শিকার হন গণধর্ষণের। যারা নৌকা নিয়ে পালাচ্ছিলেন, তাদের নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। কয়েকশো মানুষকে মেরে ফেলে দেওয়া হয় নদীর জলে। তিনদিন ধরে তাণ্ডব চালানোর পর দ্বীপে পড়ে থাকা অবশিষ্ট শরণার্থীদের পুনরায় মল্কানগিরি (উড়িষ্যা), মানা এবং কুরুত (মধ্যপ্রদেশ) এবং আদিলাবাদে (উত্তর প্রদেশে) জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার কিছু কিছু শরণার্থী পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কদম্বগাছি, মালতিপুর, বারাসাত, বর্ধমান, ঘুটিয়ারীশরিফ, হিঙ্গলগঞ্জ ও ক্যানিং-এ আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৬ই মে, ১৯৭৯ মরিচঝাঁপি উদ্বাস্তুশূন্য হয়।

সরকারি হিসেবে, সেখানে মোট নিহতের সংখ্যা মাত্র দু’জন। বিভিন্ন হিসেবে দেখা যায়, দণ্ডকারণ্য থেকে যারা এসে চমৎকার এক জনপদ তৈরি করেছিলেন, তাদের মধ্যে ১২ শতাংশ আর ফিরে যেতে পারেননি। এখানেই মরে গেছেন, পুড়ে গেছেন কিংবা আশেপাশের কোথাও আশ্রয় নিয়েছেন। নারীরা আশেপাশের এলাকার পতিতা হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। ফিরে আসা অনেকে বসতি স্থাপন করেছেন রেললাইনের পাশের ঝুপড়িতে। আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা ভুলে গেছেন ইতিহাসের নীরব এক কালো অধ্যায়কে, যে অধ্যায়ের কারণে তারা হতে পারেন প্রশ্নবিদ্ধ। ক্ষমতায় গিয়েও মানবতাবাদীদের এহেন আচরণ মানুষের মননের বহুরূপিতা প্রমাণ করে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তখন মানবতাকে বলি দিতে হয়, যে মানবতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছেন এতকাল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *