পুতুল তো কোনো অন্যায় করেনি । ভালবাসাটা কী অপরাধ ? অপরাধই যদি হতো তাহলে ভালবাসা শব্দটার ব্যবহারের বিপুল চাহিদা থাকতো না । হয়তো ভালবাসাহীন মানুষ ক্রমশ হিঃস্র হয়ে উঠতো ।
পুতুল আজ অব্দি বুঝতেই পারলো না তার কপালে এত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা কেন ? সে আর পাঁচটা পুরুষ-নারীর সমতুল্য । বিবাহিত জীবনে আর পাঁচটা পুরুষ-নারী যা চায় সে তো সেইটুকুতেই সন্তুষ্ট । তার বেশী চাহিদা নেই । তবে কেন তার প্রতি সমাজের মানুষের এত ধিক্কার ! অহেতুক তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনধিকার চর্চা !
গাঁয়ের ভৈরব কাকা বাড়ি এসে ‘যা-নয়-তাই’ বলে গেলেন । পুতুলের ভালবাসার সিদ্ধান্তটাই নাকি উদ্ভট ! যাকে বলে বেমানান, খাপছাড়া ! যার জন্য তাদের পারিবারিক সামাজিক মর্যাদা ধুলোর সঙ্গে মিশে গেছে । বরং তার ভালবাসার মেলবন্ধনের কাজটাই নাকি অপরাধমূলক ! যেটা কিনা সামাজিক দৃষ্টিতে গর্হিত ও জঘন্য ।
কিন্তু পুতুল এখনও বুঝতে পারছে না তার ভালবাসা নিয়ে সমাজ কেন এত উদ্বিগ্ন ? পুতুল একজন স্বাধীনচেতা মেয়ে । তার নিজস্বভাবে বাঁচবার অধিকার, ষোলোআনা । তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা নিয়ে কেন এত শোরগোল ! পুতুলের এখনও দৃঢ় বিশ্বাস, সে কোনো অন্যায় করেনি ।
ফুলি তার প্রিয় বান্ধবী । গত রবিবার দিন দেখা করতে এসেছিল । এসে পুতুলকে উল্টোপাল্টা টক্-ঝাল-মিষ্টি যা খুশী তাই বলে গেলো । কখনও ধমকানো, কখনও চমকানো, আবার কখনও হিতোপদেশ ! কিন্তু ফুলির অতো কথার সারমর্ম পুতুল কিছুই বুঝতে পারলো না । ফুলি কিন্তু বলতে ছাড়েনি, যেমন—“নিজের ভাল পাগলেও বোঝে । তুই জেনেশুনে সমাজের চোখে নিন্দনীয় কাজটাই শেষে করলি ? তোর বিবেকে বাঁধলো না ?” আরও কতো কী ? পুতুল কান খুলে শুধুমাত্র শুনে গেলো । অথচ প্রতি উত্তরে কিছু বলতে পারলো না । ‘বলতে পারলো না’ ঠিক নয়, বরং ওকে বলার সুযোগই দিলো না । এক ঝটিকায় তার মনের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়ে তড়িৎ গতিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো । পুতুল এসব ভাবে আর হাসে ।
বাড়িতে বাবা আপত্তি না করলেও মায়ের ভীষণ আপত্তি ছিলো । পুতুল বুঝিয়েছিলো, ভালবাসার কোনো জাত নেই । এটা তার নিস্পাপ ভালবাসার পরিণতি । পুতুল এখন অনেক বড় । পকেটে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি । তাই নিজের ব্যাপারে “ভাল-মন্দ” সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে । মাকে পুতুল বুঝিয়েছিলো, “তার সিদ্ধান্ত সঠিক ।“ তাকে নিয়ে অহেতুক চিন্তা করতে “না” করেছিলো । কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হলো অন্যত্র । অর্থাৎ গাঁয়ের প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন মায়ের মনটাকে বিষিয়ে তুললো । যেমন “পুতুলের কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি । বরং কদর্য । পরে পস্তাতে হবে ।“ আরও কতো কী ?
অন্যদিকে পুতুলের বাবার পরিচিত এমনকি আপনজনেরাও এককাট্টা । তারাও বেসামাল । বিদ্রূপ করতে ছাড়লেন না । তাঁদের বাচনভঙ্গি নিঃসন্দেহে অশোভনীয় । নিজেরাই জানেন না, কী ভাষায় পুতুলের কাজটাকে আক্রমণ করছেন ? অথচ ঐসব ব্যক্তিগণ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত । সকলের চোখে নমস্য ব্যক্তি । তাঁদের ভাষাগত ব্যুৎপত্তি বলা চলে আরও মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া উচিত ছিলো । কিন্তু বাস্তবে তাঁদের আচরণ নিম্ন মানের । এসব কারণে পুতুলের সমাজের ঐসব নমস্য ব্যক্তিদের প্রতি এমনকি শ্রদ্ধাভাজন আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি শ্রদ্ধা ক্রমশ কমে যাচ্ছে ।
তারপর……?
পুতুল যখন এসব ভাবনায় নিবিড়ভাবে অবরুদ্ধ, হঠাৎ তার বাবা উপস্থিত । তাঁর চোখ দুটি ছলছল, কাঁদো কাঁদো অবস্থা । পুতুলের মাথায় হাত রেখে বললেন, “আমি আর পারছি না, মা !”
বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি রণক্লান্ত । মনের ভিতর তাঁর খুব কষ্ট ! নিজেকে সামলাতে পারছেন না । সঙ্গে সঙ্গে পুতুলের তাৎক্ষণিক উত্তর, “কী পারছো না, বাবা ?”
নীচু সম্প্রদায়ের অম্লানের সাথে ভালবাসার পরিণয়সূত্রের সমালোচনার উপযুক্ত জবাব দিতে !
সে কি ! অস্ফুটোস্বরে পুতুলের কৌতুহল !
বাবার চোখে জল । তিনি কাঁদছেন …!
*****************************
অবরুদ্ধ : দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

Leave a Reply