ভূমিকা– ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু নারীই তাঁদের সাহস, ত্যাগ, এবং অনন্য নেতৃত্বের মাধ্যমে চিরস্মরণীয় হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হংসাবেন মেহতা — যিনি কেবলমাত্র স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই করেননি, বরং স্বাধীনতার পর ভারতের সংবিধান প্রণয়ন, নারী অধিকার রক্ষা, এবং শিক্ষার প্রসারে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, নারীবাদী, এবং সামাজিক সংস্কারক — এককথায়, এক বহুমুখী ব্যক্তিত্ব।
শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি–
হংসাবেন মেহতার জন্ম ৪ জুলাই ১৮৯৭ সালে গুজরাটের সুরাট শহরে। তাঁর পিতার নাম ছিল হারিপ্রসাদ দেসাই, যিনি ছিলেন শিক্ষিত, উদারচিন্তাধারার মানুষ। পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্ত কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ। ছোটবেলা থেকেই হংসাবেনের মধ্যে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার প্রবণতা দেখা যায়।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন সুরাটে এবং পরে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বগুণের বিকাশ ঘটে, এবং নারী শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ জন্ম নেয়।
প্রথম জীবনে নারীবাদী চেতনা–
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় হংসাবেন পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন — বিশেষত জন স্টুয়ার্ট মিল এবং এমেলিন প্যাঙ্কহার্স্টের নারী অধিকারের দর্শন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন এবং সেখানকার নারী ভোটাধিকার আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর রাজনৈতিক এবং সামাজিক চেতনার ভিত্তি দৃঢ় করে।
রাজনীতিতে প্রবেশ–
ভারতে ফিরে এসে হংসাবেন সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং নারীদের সমস্যা, শিশুদের শিক্ষা, ও সামাজিক সংস্কারের বিষয়ে ধারালো প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। তাঁর লেখনী ছিল স্পষ্ট, যুক্তিপূর্ণ, এবং সাহসী।
তিনি গুজরাট মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করত।
হংসাবেন ১৯৩৭ সালে বম্বে প্রাদেশিক বিধানসভা-র সদস্য নির্বাচিত হন। সেখানেও তিনি নারীর অধিকার রক্ষার জন্য একাধিক বিল প্রস্তাব করেন, যেমন — বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা পুনর্বিবাহের প্রচার, এবং নারীদের কর্মক্ষেত্রে সমান মজুরি।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা–
হংসাবেন মেহতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী-র আদর্শে অনুপ্রাণিত।
তিনি অসহযোগ আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি প্রায় তিন বছর বন্দি ছিলেন।
কারাবাসের সময়ও তিনি নারী বন্দিদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন এবং তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেন।
সংবিধান সভায় ভূমিকা–
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৬ সালে হংসাবেন মেহতা সংবিধান সভা-র সদস্য নির্বাচিত হন।
সংবিধান রচনার সময় তিনি নারী অধিকার সংক্রান্ত একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেন।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তাঁর প্রচেষ্টাতেই ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা-তে “Equality” বা সমতা শব্দটি যুক্ত হয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
তিনি মানবাধিকার সনদ (Universal Declaration of Human Rights)-এর প্রণয়নেও অবদান রাখেন। জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সক্রিয়ভাবে নারী অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।
নারী শিক্ষার প্রসারে অবদান–
হংসাবেন বিশ্বাস করতেন যে স্বাধীনতা অর্থবহ হবে কেবল তখনই, যখন নারীরা শিক্ষিত ও আত্মনির্ভর হবে।
তিনি গুজরাটের গ্রামীণ অঞ্চলে একাধিক বিদ্যালয় ও নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন।
তাঁর প্রচেষ্টায় বহু মেয়েরা প্রথমবার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়।
তিনি মেয়েদের জন্য বিজ্ঞান, কলা, এবং পেশাগত শিক্ষার প্রসারে জোর দেন, যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।
লেখনী ও সাহিত্যকর্ম–
হংসাবেন একজন দক্ষ লেখিকাও ছিলেন। তিনি “Indian Woman” এবং “The Awakening of Indian Women” নামে দুটি প্রভাবশালী বই লেখেন, যেখানে ভারতীয় নারীর ইতিহাস, সংগ্রাম, এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়াও তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ, বক্তৃতা, এবং রিপোর্ট লিখেছেন, যা নারী আন্দোলনের ইতিহাসে অমূল্য দলিল।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি–
হংসাবেন মেহতার অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে ভারত সরকার তাঁকে একাধিক সম্মানে ভূষিত করে।
১৯৮৮ সালে তিনি পদ্মভূষণ লাভ করেন।
এছাড়াও নারী আন্দোলন ও সামাজিক সংস্কারে অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা তাঁকে সম্মানিত করে।
ব্যক্তিগত জীবন–
হংসাবেনের বিবাহ হয়েছিল ঝাবেরচন্দ মেহতা-র সঙ্গে, যিনি নিজেও সামাজিক সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল আদর্শ সহযোগিতামূলক — স্বামী-স্ত্রী মিলে সমাজ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার–
হংসাবেন মেহতার মৃত্যু হয় ১৯৯৫ সালে। তবে তাঁর কর্ম, আদর্শ, এবং সংগ্রামের উত্তরাধিকার আজও ভারতীয় নারী আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বল।
তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে একজন নারী কেবল ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় — বরং জাতি, সমাজ, এবং রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
উপসংহার–
হংসাবেন মেহতা ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম, সংবিধান রচনা, নারী অধিকার রক্ষা, এবং শিক্ষা প্রসারে সমানতালে অবদান রেখেছেন।
তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে স্বাধীনতার সংগ্রাম কেবল বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে নয় — বরং সামাজিক অন্যায়, লিঙ্গ বৈষম্য, এবং অশিক্ষার বিরুদ্ধেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁর সংগ্রাম ও আদর্শ আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে — স্বাধীনতার মূল্য, সমতার গুরুত্ব, এবং শিক্ষার শক্তি উপলব্ধি করতে।
Leave a Reply