
মধ্যপ্রদেশের হৃদয়ে অবস্থিত ইন্দোর (Indore) শহর শুধু আধুনিকতার জন্যই নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজকীয় ঐতিহ্যের অপূর্ব মেলবন্ধনের জন্যও পরিচিত। এই শহরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে এক অনবদ্য স্থাপত্যশৈলীর সাক্ষী — রাজওয়াড়া প্রাসাদ (Rajwada Palace)। সাত তলা এই বিশাল ভবনটি ইন্দোরের অতীত গৌরবের এক জীবন্ত নিদর্শন, যা আজও পর্যটকদের মুগ্ধ করে তার জাঁকজমক, শৈল্পিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গাম্ভীর্যে।
ইতিহাসের পাতায় রাজওয়াড়া
রাজওয়াড়া প্রাসাদের ইতিহাস শুরু হয় ১৮ শতকের শুরুর দিকে, যখন মালওয়া অঞ্চলে হোলকার রাজবংশ (Holkar Dynasty) শাসন করত। ১৭৪৭ সালে মালহার রাও হোলকার এই রাজবংশের জন্য রাজওয়াড়ার ভিত্তি স্থাপন করেন।
এই প্রাসাদটি ছিল হোলকার রাজপরিবারের প্রশাসনিক ও আবাসিক কেন্দ্র, যেখানে রাজারা সভা বসাতেন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতেন এবং উৎসব উদ্যাপন করতেন।
রাজওয়াড়ার ইতিহাসের প্রতিটি ইট যেন বলে যায় মারাঠা শৌর্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতির গল্প।
ব্রিটিশ আমলে এবং ১৯৮৪ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাসাদের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেলেও, পরবর্তীতে এটি পুনর্নির্মাণ করা হয় পূর্বের ঐতিহ্য বজায় রেখে।
️ স্থাপত্যের অনন্য সমন্বয়
রাজওয়াড়ার স্থাপত্য এক বিস্ময়। এখানে দেখা যায় মারাঠা, মোগল ও ফরাসি স্থাপত্যশৈলীর এক অসাধারণ মেলবন্ধন।
পুরো ভবনটি সাততলা বিশিষ্ট — নিচের তিন তলা তৈরি পাথর ও ইট দিয়ে, আর উপরের তলাগুলি কাঠের কাঠামোতে গড়া।
প্রাসাদের প্রধান দরজা বা মহাদ্বার, যা বিশাল কাঠের তৈরি ও লোহার পেরেক বসানো, যেন অতীতের শক্তির প্রতীক।
ভিতরে ঢুকলেই দেখা যায় রাজকীয় উঠোন, খোলা বারান্দা, সুউচ্চ ছাদ, এবং কারুকার্যময় জানালা ও দরজা — প্রতিটি অংশেই অসাধারণ শৈল্পিক নিপুণতা।
বাইরের দিকে রাজওয়াড়ার উঁচু ফ্যাসাদে (facade) কাঠের তৈরি বারান্দাগুলোকে সযত্নে রক্ষা করা হয়েছে, যা রাতে আলোকসজ্জায় এক রাজকীয় আবেশ তৈরি করে।
রাজওয়াড়ার ভিতরে
রাজওয়াড়ার ভিতরে প্রবেশ করলে ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। এখানে রয়েছে —
- রাজকীয় দরবার হল, যেখানে রাজারা সভা বসাতেন,
- পুরানো দপ্তর কক্ষ,
- এবং এক প্রান্তে একটি মন্দির, যা হোলকার রাজবংশের আধ্যাত্মিকতার প্রতীক।
আজ রাজওয়াড়ার একাংশে একটি ছোট মিউজিয়াম ও প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে রাজপরিবারের পুরনো প্রতিকৃতি, রাজকীয় অলঙ্কার, আসবাব ও ঐতিহাসিক দলিল সংরক্ষিত আছে।
রাজওয়াড়ার চারপাশের প্রাণচঞ্চলতা
রাজওয়াড়া শুধু একটি প্রাসাদ নয়, এটি ইন্দোর শহরের সাংস্কৃতিক হৃদয়কেন্দ্র।
প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে ব্যস্ত রাজওয়াড়া বাজার, যেখানে পাওয়া যায় ইন্দোরের বিখ্যাত হস্তশিল্প, রেশমের শাড়ি, চুড়ি, ও সুস্বাদু স্ট্রিট ফুড।
বিশেষ করে সন্ধ্যার সময় রাজওয়াড়ার সামনে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের আলোয় প্রাসাদের মুখ যখন সোনালি আভায় ভরে ওঠে, তখন দৃশ্যটি একেবারেই অন্যরকম রাজকীয়।
️ আধ্যাত্মিক ছোঁয়া – রাজওয়াড়া মন্দির
রাজওয়াড়ার ভিতরে রয়েছে একটি ছোট গণেশ মন্দির, যা স্থানীয়দের কাছে খুবই পবিত্র।
রাজপরিবারের প্রার্থনার এই স্থান আজও সকালের ঘণ্টাধ্বনি ও সন্ধ্যার প্রদীপের আলোয় ভরে ওঠে।
রাজওয়াড়ার ঐ রাজকীয় প্রাসাদ আর দেবালয়ের শান্ত পরিবেশ যেন অতীত ও বর্তমানের মিলনের এক অনবদ্য প্রতীক।
কীভাবে পৌঁছাবেন
- অবস্থান: রাজওয়াড়া, ইন্দোর শহরের কেন্দ্রস্থলে।
- নিকটতম রেলস্টেশন: ইন্দোর জংশন (প্রায় ২ কিমি দূরে)
- নিকটতম বিমানবন্দর: দেবী আহিল্যা বাই হোলকার বিমানবন্দর (প্রায় ১০ কিমি দূরে)
- সময়: প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত খোলা।
- প্রবেশমূল্য: ভারতীয়দের জন্য ₹২০, বিদেশিদের জন্য ₹২৫০।
ভ্রমণ টিপস
- রাজওয়াড়া ঘোরার সবচেয়ে ভালো সময় সকাল বা বিকেল, তখন রোদ কম থাকে এবং ছবি তোলার জন্য আলো নিখুঁত।
- কাছেই রয়েছে সরাফা বাজার, যা রাতের ফুড স্ট্রিট হিসেবে বিখ্যাত — রাজওয়াড়ার পর ঘুরে অবশ্যই সেখানে যাবেন।
- ইতিহাস জানতে চাইলে স্থানীয় গাইড নিন, তাহলে প্রতিটি অংশের তাৎপর্য আরও ভালো বোঝা যাবে।
শেষকথা
ইন্দোরের রাজওয়াড়া কেবল এক রাজপ্রাসাদ নয়, এটি ইতিহাস, শিল্প, ধর্ম ও ঐতিহ্যের সমন্বিত এক অনন্য স্মারক।
এখানে এসে আপনি শুধু এক রাজবংশের জাঁকজমকই দেখবেন না, বরং অনুভব করবেন এক সময়ের মহিমা, যেখান থেকে ইন্দোর শহর তার পরিচয় পেয়েছে।
রাজওয়াড়ার সামনে দাঁড়িয়ে যখন সন্ধ্যার আলোয় প্রাসাদের প্রাচীরগুলো ঝলমল করে ওঠে, তখন মনে হয় —
“ইতিহাস কোনো বই নয়, এটি বেঁচে থাকা এক অনুভূতি — রাজওয়াড়া তারই প্রতীক।”












Leave a Reply