হায়দ্রাবাদের চৌমহল্লা প্যালেস – নবাবি ঐশ্বর্যের অমলিন প্রতীক।

ভারতের দক্ষিণের ঐতিহ্যবাহী শহর হায়দ্রাবাদ কেবল তার মুক্তো ও বিরিয়ানির জন্যই নয়, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের জন্যও বিখ্যাত। এই শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা চৌমহল্লা প্যালেস (Chowmahalla Palace) সেই ঐতিহ্যের অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন। “চৌমহল্লা” শব্দটি ফারসী ভাষার, যার অর্থ ‘চার প্রাসাদ’ — অর্থাৎ চার দিকের রাজপ্রাসাদ। একসময় এখানেই নিঝাম রাজাদের রাজকীয় আসন বসত, আর আজ এটি পর্যটকদের জন্য এক অসামান্য ঐতিহাসিক আকর্ষণ।


ইতিহাসের পাতায় চৌমহল্লা প্যালেস

চৌমহল্লা প্যালেস নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৭৫০ সালের দিকে আসাফ জাহি রাজবংশের তৃতীয় নিঝাম, নাসির উদ-দৌলা-র আমলে। পরে এটি সম্পূর্ণ হয় পঞ্চম নিঝাম আফজল উদ-দৌলা-র শাসনকালে। এই প্রাসাদ দীর্ঘদিন ধরে হায়দ্রাবাদের নিঝামদের সরকারি বাসভবন ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। এখানেই রাজাদের অভিষেক অনুষ্ঠান, সভা ও বিদেশি অতিথিদের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠিত হত।


স্থাপত্য ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধন

চৌমহল্লা প্যালেস এক আশ্চর্য স্থাপত্য কীর্তি, যেখানে ইরানি, মুঘল ও ইউরোপীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণ দেখা যায়।
প্রাসাদ কমপ্লেক্সের মধ্যে চারটি প্রধান অংশ রয়েছে –

  1. আফজাল মহল
  2. মেহতাব মহল
  3. তাহনিয়াত মহল
  4. আফজাল ইউনানি মহল

প্রত্যেকটি প্রাসাদে সাদা মার্বেল, খোদাই করা ছাদ, আর রঙিন কাচের জানালা রাজকীয় আভিজাত্যের কথা বলে।

সবচেয়ে বিখ্যাত হল খিলওয়াত মহল (Khilwat Mahal) — নিঝামদের রাজাসনে বসার আসল হলঘর। এর সোনালি সিলিং, ঝুলন্ত ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি এবং সাদা মার্বেল মেঝে এক অদ্ভুত মহিমা সৃষ্টি করে। এখানেই নিঝামরা সভা করতেন ও অতিথিদের স্বাগত জানাতেন।


প্রাসাদের অভ্যন্তর ও জাদুঘর

আজকের দিনে চৌমহল্লা প্যালেসের একটি বড় অংশকে মিউজিয়াম বা জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে।
এখানে সংরক্ষিত রয়েছে নিঝামদের মূল্যবান সামগ্রী —

  • রাজকীয় পোশাক,
  • রূপার থালা-বাটি,
  • অস্ত্রশস্ত্র,
  • সোনার পালঙ্ক,
  • পুরনো গাড়ি ও রথ।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী হলো নিঝামদের ব্যবহৃত ১৯১১ সালের রোলস রয়েস গাড়ি, যা এখনো নিখুঁত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে।


চৌমহল্লা প্যালেসের আঙিনা

প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে সুবিশাল বাগান, ফোয়ারা এবং ফুলে ভরা উদ্যান।
এই প্রাঙ্গণে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, যেন সময় থমকে গেছে। মৃদু বাতাসে মোগরার গন্ধ, রাজপ্রাসাদের দেয়ালে সূর্যের ছায়া — সব মিলিয়ে এক অনিন্দ্য শান্ত অভিজ্ঞতা।


সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কেন্দ্র

চৌমহল্লা প্যালেস কেবল একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নয়; এটি হায়দ্রাবাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কেন্দ্রও বটে। এখানে প্রায়ই সংগীত, নৃত্য ও ঐতিহ্যবাহী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যা স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।


‍♀️ ভ্রমণ তথ্য ও পরামর্শ

  • অবস্থান: চারমিনার থেকে মাত্র ১ কিমি দূরে, হায়দ্রাবাদ শহরের পুরোনো অংশে।
  • খোলার সময়: সকাল ১০টা – বিকেল ৫টা (শুক্রবার বন্ধ)।
  • প্রবেশ মূল্য: প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ₹৮০ (বিদেশিদের জন্য ₹২০০)।
  • টিপস: খিলওয়াত মহলের ভেতরে ফটোগ্রাফি সীমিত, তবে বাইরের বাগানে ছবি তোলা যায়।
  • নিকটবর্তী আকর্ষণ: চারমিনার, মক্কা মসজিদ, লাড বাজার ও সালার জং মিউজিয়াম।

শেষ কথা

চৌমহল্লা প্যালেস আজ হায়দ্রাবাদের গৌরবময় অতীতের নীরব সাক্ষী।
এটি এমন এক স্থান, যেখানে ইতিহাস, রাজকীয় ঐশ্বর্য ও স্থাপত্যের জৌলুস একাকার হয়েছে। প্রাসাদের প্রতিটি করিডর, প্রতিটি স্তম্ভ যেন অতীতের নিঝাম রাজাদের গল্প বলে।

যদি তুমি হায়দ্রাবাদে ভ্রমণ করো, তবে চৌমহল্লা প্যালেসে না গেলে সেই সফর অসম্পূর্ণ থাকবে — কারণ এখানে তুমি অনুভব করবে রাজত্বের মহিমা, শিল্পের সৌন্দর্য এবং ইতিহাসের নিঃশব্দ গৌরব, একসাথে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *