
বাংলার হৃদয়ভূমি হুগলি জেলার বুকে অবস্থিত তারকেশ্বর মন্দির হল এক আধ্যাত্মিক শক্তিক্ষেত্র, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে মুখর করে তোলেন পরিবেশ। এটি শুধু একটি শিবমন্দির নয়, বরং বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রাচীন ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতীক। এখানকার শিবলিঙ্গকে “বাবা তারকনাথ” নামে ডাকা হয়, যিনি নাকি স্বয়ং মহাদেবের রূপে এখানে অবস্থান করেন।
ইতিহাসের পটভূমি
তারকেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস প্রায় ১০০০ বছরেরও পুরনো। স্থানীয় কাহিনি অনুযায়ী, এক কৃষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী তাঁর জমিতে চাষ করার সময় একদিন মাটির নিচ থেকে একটি পাথরের লিঙ্গ আবিষ্কার করেন। সেই রাতে তিনি স্বপ্নে দর্শন পান স্বয়ং মহাদেবের, যিনি তাঁকে নির্দেশ দেন এখানে মন্দির স্থাপন করতে। সেই থেকেই জন্ম নেয় তারকেশ্বর ধাম।
বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ করেন রাজা বিষ্ণুচরণ চৌধুরী, প্রায় ১৭২৯ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজবংশের সহায়তায় মন্দিরটি সংস্কার ও সম্প্রসারিত হয়। আজ এটি ভারতের অন্যতম প্রধান শিবতীর্থ হিসেবে স্বীকৃত।
মন্দিরের স্থাপত্য
তারকেশ্বর মন্দির একটি নবরত্ন শৈলীর (নয়টি গম্বুজ বিশিষ্ট) চূড়াযুক্ত প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন। মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে স্থাপন করা আছে স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ, যা বলা হয়, মাটির গভীর থেকে স্বয়ং উদ্ভূত।
মন্দিরের চারপাশে রয়েছে নাটমন্দির, ভক্ত নিবাস, ও একটি বৃহৎ স্নানকুণ্ড, যেখানে ভক্তরা গঙ্গাজল মিশিয়ে শিবলিঙ্গে অভিষেক করেন। ভোরের আরতি ও ঘণ্টাধ্বনির শব্দে গোটা পরিবেশটি পবিত্রতায় ভরে ওঠে।
ধর্মীয় তাৎপর্য ও বিশ্বাস
তারকেশ্বর মন্দিরে ভক্তরা বিশ্বাস করেন, বাবা তারকনাথ হলেন “তারকব্রহ্ম”—যিনি মৃত্যুর মুহূর্তে আত্মাকে মুক্তি দান করেন। তাই অনেকেই এখানে এসে “তারক মন্ত্র” শ্রবণ করে আত্মার মুক্তি কামনা করেন।
বিশেষত শ্রাবণ মাসে (জুলাই-আগস্ট) এখানে ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে। হাজার হাজার কাঁওয়ারিয়া পদযাত্রা করে গঙ্গা থেকে জল এনে বাবা তারকনাথের অভিষেক করেন।
এছাড়াও, শিবরাত্রি, চৈত্রসংক্রান্তি, ও দোলযাত্রা উপলক্ষে মন্দিরে বিশেষ পূজা, হোমযজ্ঞ ও মেলার আয়োজন হয়।
♂️ সাধনা ও আধ্যাত্মিকতা
তারকেশ্বর মন্দিরের এক বিশেষ দিক হলো এখানকার আধ্যাত্মিক পরিবেশ। বহু তান্ত্রিক, যোগী ও সাধু এখানে সাধনা করেন। ভোরের সময় ঘণ্টাধ্বনি, ভক্তিমূলক কীর্তন, ও ধূপের গন্ধে পরিবেশ এমনই শান্ত ও পবিত্র যে মন নিজেই ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যায়।
বিশ্বাস করা হয়, যিনি একাগ্রচিত্তে “ওঁ নমঃ শিবায়” জপ করেন, তাঁর জীবনের সমস্ত বাধা দূর হয়, এবং আত্মা পায় মুক্তির পথ।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
তারকেশ্বর মন্দির দর্শনের পাশাপাশি পর্যটকরা ঘুরে দেখতে পারেন কিছু সুন্দর স্থান—
- সন্তোষী মা মন্দির – কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এক শান্ত তীর্থস্থান।
- রাজবাড়ি ধাম – রাজা বিষ্ণুচরণের প্রাচীন আবাস।
- কামারপুকুর – শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মস্থান, মাত্র ২০ কিমি দূরে।
- জয়রামবাটি – মা সারদা দেবীর জন্মভূমি, যা আধ্যাত্মিক ভ্রমণের এক পরিপূর্ণ স্থান।
যাতায়াতের পথ
তারকেশ্বর পৌঁছানো বেশ সহজ।
- রেলপথে: হাওড়া থেকে তারকেশ্বর লোকাল ট্রেন চলে, সময় লাগে প্রায় ১.৫ ঘণ্টা।
- সড়কপথে: হুগলি জেলার ভেতর দিয়ে NH-2 ধরে গাড়িতে প্রায় ৭৫ কিমি পথ।
- বাস: কলকাতা, চন্দননগর, সেরামপুর, ও বর্ধমান থেকে নিয়মিত বাস পরিষেবা রয়েছে।
মন্দির চত্বরে অভিজ্ঞতা
মন্দিরের প্রবেশপথে সারি সারি ফুল, বেলপাতা, দুধ ও গঙ্গাজলের দোকান চোখে পড়ে। ভক্তরা মাথায় পুজোর থালা নিয়ে “বোল বোল বাবা তারকনাথ কি জয়!” বলে প্রবেশ করেন।
ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, শিবলিঙ্গের ওপর দিয়ে অবিরত গঙ্গাজল পড়ছে—একটি সোনার সাপের আকৃতির নল দিয়ে। ঘণ্টাধ্বনি, ধূপের গন্ধ, আর আরতির সুরে যেন পুরো চত্বর ভরে ওঠে দেবতার শক্তিতে।
️ উপসংহার
তারকেশ্বর মন্দির শুধু একটি পূজাস্থল নয়, এটি ভক্তি ও মুক্তির দ্বার। এখানে আসলে মনে হয় যেন মহাদেব নিজেই উপস্থিত আছেন—অন্তরকে শান্তি, শক্তি ও মুক্তি দান করতে।
যে কেউ একবার এই তীর্থে এসে মহাদেবের দর্শন পান, তাঁর মনে আজীবনের জন্য থেকে যায় এক অবর্ণনীয় পবিত্র অনুভূতি।
ভ্রমণতথ্য সংক্ষেপে:
- অবস্থান: তারকেশ্বর, হুগলি জেলা, পশ্চিমবঙ্গ
- ️ দেবতা: স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ (বাবা তারকনাথ)
- ️ নির্মাণকাল: প্রায় ১৭২৯ খ্রিষ্টাব্দ
- নিকটতম রেলস্টেশন: তারকেশ্বর
- ️ খোলার সময়: সকাল ৫টা – রাত ৯টা
- বিশেষ উৎসব: শ্রাবণ মাস, মহাশিবরাত্রি, দোলযাত্রা












Leave a Reply