পুরুলিয়ার মায়াবন পাহাড় : প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে থাকা এক জাদুকরী সৌন্দর্যভূমি।

বাংলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পুরুলিয়া জেলা যেন প্রকৃতির এক অপার রূপের আঁধার। এখানকার প্রতিটি পাহাড়, বন, জলাধার ও গ্রামীণ পরিবেশে লুকিয়ে আছে এক অজানা আকর্ষণ। পুরুলিয়ার এমনই এক তুলনাহীন রত্ন হলো মায়াবন পাহাড় (Mayaban Pahar)— নামের মতোই এই স্থান যেন সত্যিই এক “মায়াময় বন”। পাহাড়, জঙ্গল, লাল মাটি, আর নীরবতার ভিতরে প্রকৃতি এখানে তার রূপের পরম জাদু ছড়িয়ে রেখেছে।


মায়াবন পাহাড়ের পরিচয়

পুরুলিয়া জেলার বাগমুন্ডি ব্লক অঞ্চলে অবস্থিত মায়াবন পাহাড়, পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম অজানা অথচ অপূর্ব প্রাকৃতিক গন্তব্য। এটি আয়োধ্যা পাহাড়শ্রেণির অংশ, যা পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে বিস্তৃত। পাহাড়টির উচ্চতা খুব বেশি নয়, কিন্তু এর সৌন্দর্য এবং শান্ত পরিবেশ মনকে গভীর প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়।

“মায়াবন” নামটির উৎপত্তি স্থানীয় লোককথা থেকে। গ্রামবাসীরা বলেন, এই পাহাড়ে একসময় সন্ন্যাসী ও সাধকেরা ধ্যান করতেন, আর বনভূমিতে এমন এক রহস্যময় নীরবতা ছিল যে, মনে হত প্রকৃতি নিজেই ধ্যানমগ্ন। তাই এই জায়গার নাম হয়ে যায় “মায়াবন”— অর্থাৎ মায়ায় ভরা বনভূমি।


প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ

মায়াবন পাহাড়ের অন্যতম আকর্ষণ এর অবিকৃত প্রকৃতি। এখানে নেই শহরের কোলাহল, নেই মানুষের ভিড়— আছে শুধু পাহাড়, বন, পাথর আর শান্ত নীরবতা।

পাহাড়ের গায়ে লালচে পাথর আর শুকনো পাতার আবরণে তৈরি এক অপরূপ দৃশ্য। বসন্তকালে যখন পলাশ ও শিমুল ফুলে পাহাড় জ্বলে ওঠে লাল-কমলা রঙে, তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন রঙের উৎসব করছে।

বর্ষাকালে পাহাড়ে ঝরনা নেমে আসে— ছোট ছোট জলধারা গিয়ে মিশে যায় নীচের বনে। দূর থেকে দেখা যায় সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে জলরাশি নেমে আসছে যেন রূপালী ফিতা।

শীতের সকালে কুয়াশায় মোড়া মায়াবন পাহাড়ে সূর্যের প্রথম আলো পড়লে তার দৃশ্য দেখে বোঝা যায়— “প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের চরম প্রকাশ ঘটিয়েছে এখানে।”


বনজ প্রাণ ও পাখির ডাক

মায়াবন পাহাড়ের আশেপাশে ঘন শাল, সেগুন, মহুয়া, পলাশ ও তামাল গাছের বন। এই বনে বসবাস করে নানা বন্যপ্রাণী ও পাখি। শীতকালে এখানে দেখা মেলে অভিবাসী পাখির।
ভোরের নিস্তব্ধ বনে যখন শালপাতার গন্ধে ভরে ওঠে বাতাস, আর পাখিরা গান গায়, তখন মন ভরে যায় শান্তিতে।

স্থানীয় গ্রামের মানুষরা বলেন, অনেক সময় রাতে বনের ভেতর থেকে হরিণের ডাক বা পেঁচার ডানা ঝাপটার শব্দ শোনা যায়। তাই এই বনের নামের “মায়া” যেন আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে।


️ আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

মায়াবন পাহাড়ের কাছাকাছি রয়েছে পুরুলিয়ার আরও বহু আকর্ষণীয় স্থান—

  • আয়োধ্যা পাহাড়: পুরুলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় পাহাড়ি এলাকা, যেখানে জলপ্রপাত, ট্রেকিং ও ক্যাম্পিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে।
  • মুরগুমা বাঁধ: পাহাড় ও জলাশয়ের মেলবন্ধনে তৈরি এক মনোরম দৃশ্যপট।
  • খেয়াড়া জলপ্রপাত: বর্ষার সময় এখানে ছোট ছোট ঝরনা সৃষ্টি হয়, যা পর্যটকদের টানে।
  • চরিদা গ্রাম: চৌ নাচের মুখোশ তৈরির জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম মায়াবনের কাছেই অবস্থিত।

এই সব মিলিয়ে মায়াবন পাহাড়ের চারপাশের অঞ্চল প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও লোকশিল্পের এক সমৃদ্ধ সংমিশ্রণ।


‍♂️ ট্রেকিং ও অ্যাডভেঞ্চার

যারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী, তাদের জন্য মায়াবন পাহাড় এক দারুণ অভিজ্ঞতার জায়গা। পাহাড়ে ওঠার পথে রয়েছে পাথুরে ঢাল, শালবন, আর মাঝেমাঝে ছোট ঝরনা।
স্থানীয় গাইডের সাহায্যে পাহাড়ে ওঠা যায় এবং শীর্ষে দাঁড়িয়ে দূরে দেখা যায় আয়োধ্যা পাহাড়ের রেখা আর মুরগুমা বাঁধের নীল জলরাশি।

রাতের মায়াবন পাহাড় আবার অন্য রকম। আকাশ ভর্তি তারা, নীচে বনের কালো ছায়া— সেই দৃশ্য দেখে বোঝা যায় কেন এর নাম “মায়াবন”!


️ কীভাবে পৌঁছাবেন

  • ট্রেনে: কলকাতা থেকে পুরুলিয়া স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে পৌঁছে, সেখান থেকে ট্যাক্সি বা গাড়ি ভাড়া করে মায়াবন পাহাড়ে যাওয়া যায়। দূরত্ব প্রায় ৫০ কিমি।
  • বাসে: কলকাতা থেকে পুরুলিয়া পর্যন্ত নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি বাস চলে। পুরুলিয়া শহর থেকে স্থানীয় গাড়ি বা মোটরবাইক ভাড়া করে যাওয়া যায়।
  • নিজস্ব গাড়িতে: NH-19 (পুরাতন GT রোড) ধরে দুর্গাপুর হয়ে মায়াবন পাহাড়ের দিকে রওনা হওয়া যায়।

থাকার ব্যবস্থা

মায়াবন পাহাড়ের কাছাকাছি আয়োধ্যা ট্যুরিস্ট লজ, মুরগুমা রিসোর্ট, ও স্থানীয় হোমস্টে রয়েছে। যারা প্রকৃতির নীরবতা উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য স্থানীয় গ্রামীণ হোমস্টে ভীষণ উপযুক্ত।


স্থানীয় খাবার

এখানকার গ্রামগুলোয় পেয়ে যাবেন খাঁটি দেশি রান্না— ভাত, মুসুর ডাল, আলু পোস্ত, দেশি মুরগি, পাথরচাপা মাছ, পলাশ ফুলের বড়া, আর মহুয়ার মিষ্টি পানীয়।
এই সমস্ত খাবারে মিশে আছে পুরুলিয়ার আদিবাসী সংস্কৃতির ছোঁয়া।


️ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

মায়াবন পাহাড় ভ্রমণের জন্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়টি সবচেয়ে উপযুক্ত। শীতের নরম রোদ, ঠান্ডা হাওয়া আর পলাশ ফুলের রঙে পাহাড়ের রূপ তখন সবচেয়ে সুন্দর।
যদিও বর্ষাকালেও পাহাড়ে ছোট ছোট ঝরনা বয়ে যায়, তবে রাস্তা পিচ্ছিল হওয়ায় তখন কিছুটা সাবধান থাকা দরকার।


শেষ কথা

মায়াবন পাহাড় এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ আর প্রকৃতি যেন একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। শহরের ক্লান্ত মন এখানে এসে খুঁজে পায় প্রশান্তি, নিঃশব্দতা আর প্রকৃতির স্পর্শ।
এটি শুধু একটি ভ্রমণস্থান নয়— এটি এক অনুভব, এক অন্তরঙ্গ সংযোগ প্রকৃতির সঙ্গে।


“যেখানে নীরবতা কথা বলে,
পলাশের ফুলে লাল হয় দিগন্ত—
সেইখানেই আছে মায়াবনের মায়া।”

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *