
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্গত বাঁশবেড়িয়া শহরটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য ভান্ডার। এখানে অবস্থিত হংসেশ্বরী মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় স্থল নয়, বরং এটি বাংলার স্থাপত্যশৈলী, শিল্পচেতনা ও ভক্তির এক অসাধারণ সমন্বয়। ইট-পাথরের গাঁথুনিতে গড়ে ওঠা এই মন্দির আজও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে তার শৈল্পিক সৌন্দর্য, রহস্যময় গঠন ও শান্ত পরিবেশ দিয়ে।
ইতিহাসের পটে হংসেশ্বরী মন্দির
হংসেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন বাঁশবেড়িয়ার রাজা নৃপতি সিংহের পরিবার। মূলত, এই মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেন তাঁর স্ত্রী রাণী শঙ্করী, প্রায় আঠারো শতকের শেষ দিকে। তবে নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয় ১৮১৪ সালে, তাঁদের পুত্র রাজা নৃপতি সিংহের পুত্র রাজা নৃপতিচন্দ্র সিংহ-এর সময়।
এই মন্দিরের এক বিশেষত্ব হল—এটি “যোগতত্ত্ব”-এর প্রতীক। বলা হয়, মানব দেহের ৭২,০০০ স্নায়ুর প্রতীক হিসেবে মন্দিরের স্থাপত্যে ১৩টি টাওয়ার বা শিখর রয়েছে, যা মানুষের দেহে কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরণের ইঙ্গিত বহন করে।
️ স্থাপত্যের বিস্ময়
হংসেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য সাধারণ বাঙালি মন্দিরের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি একটি বহুস্তর বিশিষ্ট পিরামিড আকৃতির মন্দির, যার উপর উঠে রয়েছে ১৩টি পদ্মকলির আকৃতির গম্বুজ। এই পদ্মকুঁড়ির গঠনই মন্দিরটিকে আলাদা করে তোলে।
মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে পূজিত হন মা হংসেশ্বরী, যিনি শাক্ত মতে দেবী কালী বা পার্বতীর এক রূপ। ‘হংস’ শব্দের অর্থ আত্মা, আর ‘ঈশ্বরী’ মানে সেই আত্মার নিয়ন্ত্রী। অর্থাৎ, হংসেশ্বরী নামটি এক গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বহন করে।
মন্দিরের ভিতরে বিভিন্ন তলায় সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে ওঠা যায়—যা মানুষের দেহে শক্তির কেন্দ্র ‘চক্র’ গুলোর প্রতীক। মন্দিরের গঠন মূলত “যোগতন্ত্র” বা “তন্ত্রসাধনা”-র ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি।
দেবী হংসেশ্বরীর মাহাত্ম্য
মা হংসেশ্বরীকে স্থানীয়রা ‘আত্মার অধিষ্ঠাত্রী দেবী’ বলে মানেন। বিশ্বাস করা হয়, এখানে মা নিজের শক্তি রূপে অবস্থান করেন—যিনি জ্ঞান, সাধনা ও মুক্তির পথপ্রদর্শক। প্রতিদিন ভোরবেলা মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিতে এক অলৌকিক শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
দেবীর পুজোর সময়, বিশেষত দুর্গাপূজা, কালিপূজা, ও রাস উৎসবে মন্দির চত্বরে হাজারো ভক্ত সমাগম হয়।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির দর্শনের পর কাছেই দেখা যেতে পারে আরও কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা—
- আনন্দময়ী কালীবাড়ি – হুগলির অন্যতম প্রাচীন শাক্তপীঠ।
- জুবিলি ব্রিজ ও ব্যান্ডেল চার্চ – ইউরোপীয় স্থাপত্যের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
- হুগলি নদীর ঘাট – যেখানে ভোরের আলোয় গঙ্গার ঢেউ যেন দেবী মূর্তির প্রতিফলন ঘটায়।
যাতায়াতের পথ
হংসেশ্বরী মন্দির পৌঁছানো বেশ সহজ।
- রেলপথে: হাওড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া লোকাল ট্রেনে প্রায় ১.৫ ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়।
- সড়কপথে: হুগলি জেলার ভেতর দিয়ে NH-2 বা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে গাড়িতে পৌঁছানো যায়।
- জলপথে: এক সময় নদীপথেও যাত্রা করা হতো, যদিও বর্তমানে সেটি সীমিত।
️ মন্দির চত্বরে অভিজ্ঞতা
মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে সেই লালচে ইটের মহিমাময় গঠন। সূর্যের আলো পড়লে প্রতিটি পদ্মকলির গম্বুজ যেন সোনার আভায় ঝলমল করে ওঠে। ভেতরে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, শান্ত পরিবেশে এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি জাগে।
মন্দিরের প্রাঙ্গণে ছোট ছোট পুকুর, বটগাছের ছায়া আর ভক্তদের আরতি—সব মিলিয়ে এক শান্তিপূর্ণ আবহ সৃষ্টি করে।
উপসংহার
হংসেশ্বরী মন্দির শুধু একটি পূজাস্থল নয়, এটি বাংলার তান্ত্রিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির এক জীবন্ত নিদর্শন। এখানে ধর্ম ও স্থাপত্যের মিলনে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে, তা বাংলার ঐতিহ্যকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
যে কেউ একবার বাঁশবেড়িয়ার এই মন্দিরে পা রাখবেন, তাঁর মনে চিরকাল গেঁথে থাকবে মা হংসেশ্বরীর সেই শান্ত, তেজস্বী মুখচ্ছবি ও মন্দিরের অলৌকিক স্থাপত্যের মহিমা।
ভ্রমণতথ্য সংক্ষেপে:
- অবস্থান: বাঁশবেড়িয়া, হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ
- ️ দেবী: মা হংসেশ্বরী
- ️ নির্মাণকাল: প্রায় ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দ
- নিকটতম রেলস্টেশন: বাঁশবেড়িয়া (হাওড়া থেকে প্রায় ১.৫ ঘণ্টা)
- ️ খোলার সময়: সকাল ৬টা – দুপুর ১২টা, বিকেল ৪টা – রাত ৮টা












Leave a Reply