
ভূমিকা
বাংলার উত্তর প্রান্তে, জলপাইগুড়ি জেলার কোচবিহার ও দার্জিলিং সীমান্তে বিস্তৃত এক সবুজ অরণ্যভূমি—গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক। প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য, ঘন শাল ও সেগুনবন, নদীর কলকল ধ্বনি আর বন্যপ্রাণীর মুক্ত বিচরণ—সব মিলিয়ে গরুমারা যেন প্রকৃতির এক জীবন্ত কবিতা। উত্তরবঙ্গের বুকে এটি এমন এক স্থান, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতির অদ্ভুত সহাবস্থান দেখা যায়।
️ পার্কের ইতিহাস ও অবস্থান
গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক মূলত ১৯৪৯ সালে একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে, ১৯৯২ সালে এটি জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পায়।
পার্কটি জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ও মালবাজার ব্লকের মধ্যে অবস্থিত। এর মোট আয়তন প্রায় ৮০ বর্গ কিলোমিটার, এবং এটি নদী ও পাহাড়ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে অবস্থিত।
উত্তরে আছে হিমালয়ের পাদদেশ, দক্ষিণে তোর্সা নদী, আর চারপাশে সবুজ ঘন বন—এই মিলনে গরুমারা সত্যিই এক প্রাকৃতিক স্বর্গ।
প্রাকৃতিক পরিবেশ
গরুমারার বন প্রধানত শাল, সেগুন, সিমুল, মহুয়া, কাঁথাল, ও বটগাছে পরিপূর্ণ। বর্ষাকালে পুরো অরণ্য সবুজে ভরে ওঠে, আর শীতে ঝরে পড়া পাতায় বনভূমি পায় অন্য রূপ।
এখানকার আবহাওয়া মনোরম—শীতল, আর্দ্র এবং বৃষ্টি-প্রবণ। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৩০°C পর্যন্ত ওঠে, আর শীতে নেমে যায় ১০°C এর নিচে।
বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য
গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক সবচেয়ে বেশি পরিচিত এক শৃঙ্গ বিশিষ্ট গণ্ডার (One Horned Rhinoceros) এর জন্য। এছাড়াও এখানে দেখা যায়—
- হাতি, চিতা, হরিণ, বন্য মোষ, বুনো শূকর,
- রাজহাঁস, ময়ূর, মহান হর্ণবিল, ঈগল,
- ও বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি ও পাখি।
বিশেষত শীতকালে এখানে বহু পরিযায়ী পাখি আসে—যা পাখিপ্রেমীদের কাছে এক স্বর্গরাজ্য।
জিপ সাফারি – বনের মায়াবী অভিজ্ঞতা
গরুমারায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা হলো জিপ সাফারি। সকালে বা বিকেলে জিপে চেপে ঘন অরণ্যের ভিতর দিয়ে যাওয়া এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। বনরক্ষীর সঙ্গে জিপ চলতে থাকে কাঁদা পথ, নদীর পাথর পেরিয়ে, গাছের ছায়ায় ঢেকে থাকা পথে।
সৌভাগ্য ভালো থাকলে দেখা মিলতে পারে গণ্ডারের, অথবা দূরে জলাশয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাতির পাল।
ওয়াচ টাওয়ার – বনের হৃদস্পন্দন
গরুমারায় বেশ কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার (দর্শন মঞ্চ) রয়েছে, যেমন—
- চাপরামারি টাওয়ার
- চন্দ্রচূড়া টাওয়ার
- মেদলা টাওয়ার
- জাটারাঙ্গা টাওয়ার
- গারুমারা টাওয়ার
এই টাওয়ারগুলো থেকে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় পুরো বনজুড়ে আলো-ছায়ার খেলা দেখা যায়। বিশেষত ভোরে বা বিকেলে হরিণ ও গণ্ডারদের নদীর ধারে দেখা যায়—যা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
গরুমারার আশেপাশে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে—
- চাপরামারি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি,
- লাটাগুড়ি,
- সামসিং,
- মালবাজার,
- জালদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক।
এই সব জায়গা একসঙ্গে ঘুরে দেখা যায়, যা উত্তরবঙ্গ ভ্রমণকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে।
থাকার ব্যবস্থা
লাটাগুড়ি, গরুমারা ইকো ভিলেজ, মেদলা, এবং চাপরামারি—এই সব জায়গায় পর্যটকদের জন্য সুন্দর রিসর্ট, বনবাংলো, ও হোমস্টে রয়েছে।
রাতের নিরবতা, জোনাকির আলো, আর দূরে হাতির ডাক—এমন পরিবেশে থাকা এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়।
স্থানীয় মানুষ ও সংস্কৃতি
গরুমারার আশেপাশে রাজবংশী, আদিবাসী ও নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন। তাদের নাচ-গান, উৎসব ও রঙিন জীবনযাপন এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
বিশেষ করে আদিবাসী নৃত্য এবং ঢোল-মাদল এর তালে বনজ রাতগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ভ্রমণের সেরা সময়
গরুমারা ভ্রমণের আদর্শ সময় নভেম্বর থেকে মার্চ। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং বনের সবুজ রূপ সবচেয়ে সুন্দরভাবে ধরা দেয়।
বর্ষাকালে পার্ক বন্ধ থাকে (১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) যাতে বন্যপ্রাণীরা নির্বিঘ্নে প্রজনন করতে পারে।
♀️ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
গরুমারায় প্রথম প্রবেশেই অনুভব করা যায় এক অন্যরকম শান্তি। বনপথে হাঁটার সময় পাখির ডাক, পাতার শব্দ, আর হঠাৎ দূরে হাতির চলাচল—সব কিছু মিলে এটি যেন এক প্রাকৃতিক নাট্যমঞ্চ।
যখন সূর্য ডোবে, তখন লালচে আলোয় গরুমারার গাছপালা ঝলমল করে ওঠে—মনে হয় যেন পুরো বন আগুনে রঙিন হয়ে উঠেছে।
উপসংহার
গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক শুধুমাত্র একটি ভ্রমণস্থল নয়—এটি প্রকৃতির সঙ্গে মনের মেলবন্ধনের স্থান। এখানে গিয়ে বোঝা যায়, মানুষ প্রকৃতির সন্তান, আর প্রকৃতির কোলে ফিরলে তবেই মন শান্ত হয়।
একদিনের জন্য হলেও গরুমারার বনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করলে শোনা যায় পাখির ডাক, নদীর সুর আর বাতাসের ফিসফিসানি—যা শহুরে জীবনে কখনোই মেলে না।
“গরুমারা শেখায়, প্রকৃতি কথা বলে—যদি মন দিয়ে শোনা যায়।”












Leave a Reply