চিলাপাতা বন ভ্রমণ – উত্তরবঙ্গের রহস্যময় সবুজ সাম্রাজ্য ।


ভূমিকা

উত্তরবঙ্গের দোয়ার্স অঞ্চলে প্রকৃতির কোলে এক অনন্য রহস্যময় অরণ্য – চিলাপাতা বন (Chilapata Forest)
শাল, সেগুন, মহুয়া, গামার আর বেল গাছে ভরা এই গভীর বনভূমি যেন এক জীবন্ত কাব্যের মতো।
এখানে ঢুকলেই মনে হয়, প্রকৃতির বুকের ভেতর প্রবেশ করলাম—যেখানে প্রতিটি পাতার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে কাহিনি, বন্যতা আর জাদু।

চিলাপাতা কেবল একটি বন নয়, এটি উত্তরবঙ্গের প্রকৃতির আত্মা।
জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের দক্ষিণে এবং বক্সা টাইগার রিজার্ভের পশ্চিমে অবস্থিত এই বন যেন দুই মহীরুহের মাঝে এক সবুজ সেতু।


অবস্থান ও পরিচিতি

চিলাপাতা বন অবস্থিত আলিপুরদুয়ার জেলা, পশ্চিমবঙ্গে।
এটি হাসিমারাফালাকাটা শহরের মাঝখানে অবস্থিত, জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে।
বনের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে তোর্ষা, বামনি ও কালসা নদী, যা এই অরণ্যের প্রাণরেখা।

চিলাপাতা একসময় ভুটান রাজ্যের প্রহরী বন ছিল।
এখানে এখনও দেখা যায় রাজা নালরাজা কেল্লার ধ্বংসাবশেষ, যা স্থানীয় কিংবদন্তি আর ইতিহাসের এক রহস্যময় মেলবন্ধন।


প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

চিলাপাতার বনভূমি ঘন ও স্যাঁতসেঁতে।
শাল, সেগুন, গামার, মহুয়া ও বাঁশের গাছ একে ঘিরে রেখেছে।
বর্ষাকালে বনজুড়ে কুয়াশা ও বৃষ্টির স্রোতে মিশে যায় মাটির গন্ধ।
শীতকালে ভোরের কুয়াশার ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো পড়লে বন যেন সোনালী ধোঁয়ায় ঢেকে যায়—সেই দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়।


বন্যপ্রাণীর রাজ্য

চিলাপাতা বন্যপ্রাণে ভরপুর এক অরণ্য।
এখানে দেখা যায়—

  • এক শৃঙ্গ বিশিষ্ট গণ্ডার (যারা প্রায়শই জলদাপাড়া থেকে আসে),
  • এশিয়ান হাতি,
  • চিতাবাঘ,
  • হরিণ ও বুনো শূকর,
  • গৌর (Indian Bison),
  • বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি ও সরীসৃপ

বিশেষ করে শীতকালে এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে, ফলে এটি পক্ষিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য।


নালরাজা কেল্লা – ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী

চিলাপাতা বনের অন্যতম আকর্ষণ হলো নালরাজা কেল্লা (Nalraja Garh)
ধারণা করা হয়, এটি ছিল প্রাচীন কোচ রাজবংশের অধীনে শাসনকারী নালরাজাদের দুর্গ, যা ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যে নির্মিত।
আজ তা ধ্বংসপ্রাপ্ত, কিন্তু ভগ্নপ্রাচীরের ভেতর দাঁড়িয়ে যখন চারপাশের বন দেখো, মনে হয় ইতিহাস এখনো ফিসফিস করে কথা বলছে।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, রাতে নাকি এখানকার নীরবতায় শোনা যায় অদ্ভুত শব্দ—যা চিলাপাতার রহস্য আরও বাড়িয়ে তোলে।


সাফারি – রোমাঞ্চে ভরা অভিজ্ঞতা

চিলাপাতা বনে সাফারি হলো ভ্রমণের আসল আকর্ষণ।
Forest Department-এর গাড়িতে জিপ সাফারি করা যায় সকাল ও বিকেলে দুই সময়েই।
সাফারির সময় হঠাৎ সামনে হাতির পাল দেখা, বা হরিণদের দৌড়ে পালাতে দেখা, ভ্রমণকারীর মনে রোমাঞ্চ জাগিয়ে তোলে।

বনের ভেতর দিয়ে গাড়ি চলতে চলতে যখন হঠাৎ নদীর ধারে থেমে যায়, আর দূরে দেখা যায় গণ্ডারের অবয়ব—তখন বোঝা যায়, এই বন প্রকৃতির কতটা জীবন্ত।


থাকার ব্যবস্থা

চিলাপাতা বনে থাকার জন্য আছে চিলাপাতা ইকো ট্যুরিজম রিসর্ট (WBFDC)
এখানকার কাঠের কটেজ, বারান্দা থেকে বনভূমির দৃশ্য, আর রাতের নিস্তব্ধতা — এক কথায় অপূর্ব।
এছাড়াও হাসিমারা, ফালাকাটা ও জলদাপাড়া অঞ্চলে বিভিন্ন রিসর্ট ও হোমস্টে আছে, যা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়।


স্থানীয় সংস্কৃতি

চিলাপাতার আশেপাশে বাস করেন রাজবংশী, আদিবাসী, ও নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষ।
তাদের লোকসংগীত, বস্ত্র, এবং উৎসব এই অঞ্চলে ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়।
অনেক পর্যটক স্থানীয় গ্রাম পরিদর্শন করেন, যেখানে দেখা যায় প্রকৃতি আর মানুষের নিখাদ সহাবস্থান।


️ ভ্রমণের সেরা সময়

চিলাপাতা ভ্রমণের সেরা সময় হলো অক্টোবর থেকে মে মাস
বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) বনভূমি প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে থাকে এবং সাফারি বন্ধ থাকে।
শীতকালে বন সবচেয়ে মনোরম, আর পাখি দেখার আদর্শ সময়ও তখনই।


কিভাবে পৌঁছাবেন

  • রেলপথে: নিকটতম স্টেশন হাসিমারা (২০ কিমি) বা ফালাকাটা (১৮ কিমি)
  • বিমানপথে: বাগডোগরা বিমানবন্দর (১৬০ কিমি)
  • সড়কপথে: সিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে প্রায় ৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় চিলাপাতায়, দোয়ার্সের অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য পেরিয়ে।

ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

চিলাপাতায় ভ্রমণ মানেই এক অন্য জগতে প্রবেশ।
ভোরে কুয়াশায় ঢাকা বন, দূরে নদীর কলকল শব্দ, গাছের ফাঁকে সূর্যের আলো, আর হঠাৎ দেখা গণ্ডার—সব মিলিয়ে এটি এক অপার্থিব অনুভূতি।
রাতে বনবাংলোর বারান্দায় বসে যখন শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যায়, তখন বোঝা যায়, প্রকৃতি আসলে কেমন শান্ত অথচ শক্তিশালী।


উপসংহার

চিলাপাতা বন প্রকৃতি ও ইতিহাসের এমন এক মেলবন্ধন, যেখানে একদিকে আছে অরণ্যের অদম্য সৌন্দর্য, অন্যদিকে অতীতের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি।
যারা প্রকৃতির গভীরে ডুব দিতে চান, শহরের কোলাহল থেকে দূরে কিছু নিস্তব্ধতা খুঁজছেন—তাদের জন্য চিলাপাতা এক পরম আশ্রয়।


“চিলাপাতার বনে হারিয়ে গেলে, আপনি হারাবেন না—বরং প্রকৃতিকে খুঁজে পাবেন নিজের মধ্যে।”


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *