
বাংলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পুরুলিয়া জেলা প্রকৃতির অপার রূপে ভরপুর। এই জেলার পাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা ও হ্রদ যেন প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য স্বর্গ। সেই রূপকথার মতো সুন্দর স্থানের মধ্যে অন্যতম হলো বরন্তি লেক—যা তার মায়াময় সৌন্দর্যে ভ্রমণপ্রেমীদের হৃদয়ে এক অনন্য ছাপ রেখে যায়।
ভূমিকা
বরন্তি লেক (Baranti Lake) পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর মহকুমার মধ্যে অবস্থিত একটি মনোরম জলাধার। এটি আসলে একটি কৃত্রিম হ্রদ—পাঞ্চেত বাঁধের অংশ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। চারদিক ঘেরা পাহাড়, সবুজ বনভূমি, নীরব পরিবেশ, এবং লেকের জলে সূর্যাস্তের প্রতিচ্ছবি—এই সব মিলিয়ে বরন্তি এমন এক জায়গা যা ভ্রমণকারীর মনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে দেয়।
কীভাবে পৌঁছানো যায়
বরন্তি লেক কলকাতা থেকে প্রায় ২৬৫ কিলোমিটার দূরে। হাওড়া থেকে ট্রেনে রঘুনাথপুর বা আদ্রা স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে বরন্তি পৌঁছানো যায়।
অন্যদিকে, বাসে আসার জন্য দুর্গাপুর হয়ে রঘুনাথপুরগামী বাসে চেপে বরন্তিতে পৌঁছানো সম্ভব। রাস্তা জুড়ে লালমাটির ঢিবি, খেজুরগাছ, আর গ্রামের নিরিবিলি দৃশ্য মনকে প্রশান্ত করে তোলে।
প্রকৃতির কোলে বরন্তি
বরন্তি লেকের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেন এক অদ্ভুত মায়ার সৃষ্টি করে। সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে, আর সন্ধ্যাবেলায় লালচে সূর্যাস্তের আলো যখন লেকের জলে পড়ে, তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজ হাতে রঙের প্যালেটে ছবি এঁকে চলেছে।
লেকের একপাশে পাহাড়, অন্য পাশে সবুজ বন—এই দুইয়ের মিলনস্থলে লেকটি যেন এক স্বপ্নপুরী।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
বরন্তির আশেপাশে আরও বেশ কিছু ঘুরে দেখার মতো জায়গা রয়েছে—
- আয়োধ্যা পাহাড়, যেখানে ঝর্ণাধারা আর পাথরের ছন্দ একাকার।
- পাঞ্চেত বাঁধ, বরন্তিরই কাছাকাছি, যা থেকে দামোদর নদীর দৃশ্য অপূর্ব।
- জয়চণ্ডী পাহাড়, যেখানে “হিরক রাজার দেশে” সিনেমার শুটিং হয়েছিল।
- গরপঞ্চকোট ধ্বংসাবশেষ, প্রাচীন ইতিহাসের নিদর্শন।
এই সব জায়গা একসঙ্গে ঘুরে দেখা যায় বরন্তিকে কেন্দ্র করে।
থাকার ব্যবস্থা
বরন্তিতে এখন বেশ কয়েকটি সুন্দর রিসর্ট ও হোমস্টে রয়েছে। মাটির ঘরের সঙ্গে আধুনিক সুবিধা, গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে শহুরে আরামের মিশেল—সব কিছুই ভ্রমণকারীর মন জয় করে।
সন্ধ্যায় কাঁঠের চুলোর ধোঁয়া, পেঁয়াজের চপ আর গরম চা—এই সবই বরন্তির আবেশকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ
বরন্তির আশেপাশে প্রচুর বনাঞ্চল রয়েছে যেখানে নানা প্রজাতির পাখি ও ছোট প্রাণী দেখা যায়। শীতকালে এখানে বহু পরিযায়ী পাখি আসে—তাদের ডানা মেলে ওড়া দৃশ্য সত্যিই দেখার মতো।
এই অঞ্চলের বনভূমিতে শাল, পলাশ, মহুয়া গাছ ছড়িয়ে আছে, আর বসন্তকালে পলাশফুলে গোটা অঞ্চল রাঙা হয়ে ওঠে।
সূর্যাস্তের জাদু
বরন্তির সূর্যাস্তের দৃশ্যই এই স্থানের প্রধান আকর্ষণ। বিকেলের শেষে পাহাড়ের আড়ালে যখন সূর্য ডুবে যায়, তার প্রতিফলন লেকের জলে লালচে সোনালি রঙে ঝলমল করে ওঠে। সেই দৃশ্য দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। অনেকে বলেন, বরন্তির সূর্যাস্ত দেখা মানে “প্রকৃতির সঙ্গে আত্মার মিলন।”
স্থানীয় সংস্কৃতি ও মানুষ
বরন্তির স্থানীয় মানুষ অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। তাদের সরল জীবনযাপন, নৃত্য-গীত, এবং উৎসবের আবহ ভ্রমণকারীর মনে এক অনন্য ছাপ ফেলে যায়। স্থানীয় বাজারে মহুয়া ফুলের মদ, হস্তশিল্প, বাঁশের কাজ—এসব দেখতে ভালো লাগে।
♀️ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
বরন্তি এমন এক জায়গা যেখানে প্রকৃতি কথা বলে। সকালে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাঁটা, দুপুরে লেকের ধারে বসে নির্জনে চুপচাপ জল দেখা, আর রাতে চাঁদের আলোয় লেকের রূপ—সব মিলিয়ে এটি এক পূর্ণাঙ্গ মানসিক শান্তির আশ্রয়স্থল।
উপসংহার
আজকের যান্ত্রিক জীবনে বরন্তি লেকের মতো জায়গা আমাদের মনে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ফিরিয়ে আনে।
এখানে নেই শহরের কোলাহল, নেই ভিড়ের চাপ—শুধু আছে নিস্তব্ধ প্রকৃতি, পাহাড়, জলের সুর, আর আকাশভরা তারা।
বরন্তি শুধুই একটি ভ্রমণস্থল নয়, এটি এক অনুভূতি—যা মনে শান্তি আনে, আত্মাকে নবজীবন দেয়।
“বরন্তি একবার নয়, বারবার ডাকে — কারণ প্রকৃতি সেখানে এখনো কথা বলে।”












Leave a Reply