
বাংলার ইতিহাসের পাতায় মুর্শিদাবাদের নাম মানেই এক রাজকীয় অধ্যায়। নবাবদের ঐশ্বর্য, ব্রিটিশদের আগমন, আর মুঘল যুগের গৌরব—সবই যেন একসঙ্গে জীবন্ত হয়ে ওঠে এই জেলার বুকে। সেই মুর্শিদাবাদের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ, যা শুধু স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শনই নয়, বরং বাংলার ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষীও বটে।
অবস্থান ও পরিচিতি
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ অবস্থিত মুর্শিদাবাদ শহরের কেন্দ্রস্থলে, ভাগীরথী নদীর পূর্ব তীরে, হজরাদুড়ি পার্কের মধ্যে। নাম শুনেই বোঝা যায় — এই প্রাসাদে রয়েছে “হাজার দরজা”, যার মধ্যে প্রায় ৯০০টি সত্যিকারের দরজা এবং ১০০টি ভুয়ো দরজা, যা প্রহরীদের বিভ্রান্ত করতে ব্যবহৃত হত।
এই প্রাসাদটি আজ ভারতের অন্যতম ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI)-র অধীনে সংরক্ষিত।
️ নির্মাণ ইতিহাস
হাজারদুয়ারি প্রাসাদের নির্মাণ শুরু হয় ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে, নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহ-এর আমলে। এর স্থপতি ছিলেন মেজর জেনারেল ডানকান ম্যাকলিওড, যিনি ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে পুরো প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
প্রাসাদটির কাজ শেষ হয় ১৮৩৭ সালে। ব্রিটিশ প্রভাবিত এই স্থাপত্যে গ্রিক ও রোমান কলাম শৈলীর ছাপ সুস্পষ্ট।
️ স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য
- প্রাসাদটি তিনতলা বিশিষ্ট, দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৩০ মিটার এবং প্রস্থে ৬০ মিটার।
- মূল ভবনের চারপাশে রয়েছে তিনটি বিশাল বারান্দা, যার প্রতিটি স্তম্ভ মার্বেল ও বেলেপাথরে খোদাই করা।
- প্রাসাদের প্রতিটি দরজা, জানালা ও ছাদে দেখা যায় সূক্ষ্ম নকশার কাজ — যা সেই সময়ের ইউরোপীয় শিল্পের প্রভাব প্রকাশ করে।
- ভিতরে রয়েছে ৬০টিরও বেশি বিশাল কক্ষ, যেখানে রাখা আছে নবাব আমলের অসংখ্য সামগ্রী, রাজকীয় পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, ঘড়ি, আসবাব ও চিত্রকর্ম।
️ মিউজিয়াম বা জাদুঘর
বর্তমানে হাজারদুয়ারি প্রাসাদটি একটি মিউজিয়াম হিসেবে খোলা রয়েছে, যা ভারত সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তর দ্বারা পরিচালিত হয়।
এখানে দেখা যায় –
- নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্যবহার করা তরবারি, কামান ও রাজদণ্ড,
- নবাবদের রাজসিংহাসন, রূপা ও সোনার গয়না,
- ইউরোপীয় শিল্পীদের অয়েল পেইন্টিং,
- প্রাচীন ঘড়ি, চায়না মৃৎশিল্প,
- এবং নবাব আমলের দলিলপত্র ও চিঠিপত্র।
প্রাসাদের একটি বিশেষ আকর্ষণ হলো ‘ডিউয়ান-ই-খাস’, যেখানে নবাবের সভা অনুষ্ঠিত হত।
প্রাসাদের চারপাশের পরিবেশ
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ঘিরে রয়েছে এক বিশাল উদ্যান, যেখানে রোপণ করা হয়েছে নানা প্রজাতির ফুল ও গাছ। চারপাশে ছায়াঘেরা পথ ধরে হাঁটলে মনে হয় ইতিহাসের পাতা যেন মৃদু হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে।
প্রাসাদের পাশেই রয়েছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা — যেমন
- নিজামত ইমামবাড়া,
- ওয়াসিফ মঞ্জিল (ছোট হাজারদুয়ারি),
- বাচ্চাওয়ালি কামান,
- এবং কাঠগোলা প্যালেস।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
হাজারদুয়ারি প্রাসাদে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয় যেন সময় পেছনে ফিরে গেছে দুই শতাব্দী আগে। বিশাল ফটক দিয়ে ঢোকার পর, চোখে পড়ে রাজকীয় প্রাসাদের মহিমা। হলুদ রঙের দেয়ালে সূর্যের আলো পড়লে তা যেন সোনালী আভা ছড়িয়ে দেয়।
প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করে ইতিহাসপ্রেমীদের মন হারিয়ে যায় অতীতে — নবাবদের সভা, রাজকীয় উৎসব, ব্রিটিশ অতিথিদের আগমন—সব যেন এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে সেই রাজকক্ষের দেয়ালে।
ভাগীরথীর ধারে বসে যখন প্রাসাদের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় এই নদীই যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী, যে দেখেছে বাংলার উত্থান ও পতন।
️ ভ্রমণের সেরা সময়
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ঘুরে দেখার জন্য অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস সবচেয়ে উপযুক্ত। এই সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং প্রাসাদের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় ধীর গতিতে।
প্রাসাদ দর্শন সময়:
সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত
(প্রতি শুক্রবার বন্ধ থাকে)
কীভাবে পৌঁছবেন
- রেলপথে: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত বহু ট্রেন চলাচল করে (যেমন ভাগীরথী এক্সপ্রেস, হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস)।
- সড়কপথে: কলকাতা থেকে বর্ধমান হয়ে NH34 পথে প্রায় ২০০ কিমি দূরত্ব।
- জলপথেও ভাগীরথী নদী ধরে বোট রাইডের ব্যবস্থা রয়েছে, যা ভ্রমণকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে।
✍️ উপসংহার
হাজারদুয়ারি প্রাসাদ কেবল একটি স্থাপনা নয়, এটি বাংলার ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। এখানে এসে আমরা দেখতে পাই নবাবদের রাজকীয় জীবন, ব্রিটিশ শাসনের ছায়া, এবং বাংলার গৌরবময় অতীত।
যে কেউ ইতিহাস, স্থাপত্য ও সংস্কৃতি ভালোবাসেন — তাঁর জীবনে একবার হাজারদুয়ারি প্রাসাদ দেখা আবশ্যক। কারণ এখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি স্তম্ভ যেন বলে ওঠে —
“এই প্রাসাদের দেয়ালে লুকিয়ে আছে বাংলার হারানো রাজ্য,
আর ভাগীরথীর ঢেউয়ে ভেসে আসে ইতিহাসের গানের সুর।”












Leave a Reply