
ইতালির দক্ষিণ অংশে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক শহর নেপলস (Naples) — যাকে বলা হয় “দক্ষিণ ইতালির প্রাণকেন্দ্র”। এটি এমন এক শহর যেখানে অতীতের রাজকীয় ইতিহাস, ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি, আগ্নেয়গিরির রহস্য আর ইতালীয় খাবারের সুবাস একসঙ্গে মিশে গেছে এক জাদুকরী অভিজ্ঞতায়। নেপলস মানেই রোমান সভ্যতার ছায়ায় বেঁচে থাকা এক পুরনো ইউরোপীয় শহর, যা আজও প্রাণবন্ত, রঙিন এবং অনন্ত জীবন্ত।
️ নেপলসের পরিচয় ও ইতিহাস
নেপলসের প্রাচীন নাম ছিল Neapolis, যার অর্থ “নতুন শহর”। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে গ্রিকদের দ্বারা। রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই নেপলস ছিল সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের এক প্রধান কেন্দ্র। ইউরোপের অনেক রাজা, শিল্পী ও চিন্তাবিদ এই শহরে এসে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
দীর্ঘ ইতিহাসে এটি একাধিকবার রাজ্য পরিবর্তনের মুখ দেখেছে — রোমান, নরম্যান, স্প্যানিশ, ফরাসি — সবাই কোনো না কোনো সময় শাসন করেছে এই ভূমি। সেই ইতিহাস আজও লুকিয়ে আছে নেপলসের দুর্গ, গির্জা, প্রাসাদ আর গলিগুলির মাঝে।
মাউন্ট ভিসুভিয়াস — আগুনের পাহাড়ের রহস্য
নেপলস শহরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত আগ্নেয়গিরি Mount Vesuvius। খ্রিস্টাব্দ ৭৯ সালে এর ভয়ংকর অগ্নুৎপাতেই ধ্বংস হয়েছিল পম্পেই ও হারকুলেনিয়াম — দুটি সমৃদ্ধ রোমান শহর। আজ সেই স্থানগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে পরিণত হয়েছে, যেখানে সময় যেন থেমে আছে।
ভিসুভিয়াসের গায়ে চড়ে যখন পর্যটকরা উপরে ওঠেন, নিচে তখন দেখা যায় নেপলস উপসাগরের অপূর্ব দৃশ্য — একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে পাহাড়, আর মাঝখানে এক জীবন্ত শহর।
নেপলস শহরের দর্শনীয় স্থানসমূহ
Castel Nuovo (নিউ ক্যাসেল)
নেপলস বন্দরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এই বিশাল মধ্যযুগীয় দুর্গ, যা ১৩শ শতকে নির্মিত। কালো পাথরে গড়া এই দুর্গের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয় যেন রণক্ষেত্রের রাজ্যে প্রবেশ করেছেন।
Teatro di San Carlo
ইউরোপের প্রাচীনতম ও অন্যতম সুন্দর অপেরা হাউস। এর অভ্যন্তরের সোনালি অলংকরণ ও শিল্পসম্ভার আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের মুগ্ধ করে রাখে।
⛪ Naples Cathedral (Duomo di San Gennaro)
এই গির্জাটি শহরের রক্ষাকর্তা সেন্ট জানুয়ারিও-এর নামে নির্মিত। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে এখানে তাঁর অলৌকিক “রক্ত তরল হওয়ার” উৎসব পালিত হয়, যা হাজারো ভক্তের ভিড় টানে।
️ National Archaeological Museum of Naples
বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, যেখানে সংরক্ষিত আছে পম্পেই ও হারকুলেনিয়ামের অবশিষ্ট শিল্পকর্ম, মূর্তি, ও প্রাচীন রোমান ফ্রেস্কো।
নেপলস উপসাগর — নীল জলের শহর
Gulf of Naples ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর উপসাগরগুলির একটি। এখানে ভেসে থাকা ছোট ছোট দ্বীপ — Capri, Ischia, Procida — যেন সমুদ্রের বুকের রত্নখানি।
ক্যাপ্রি দ্বীপের Blue Grotto গুহায় ঢুকে যখন সূর্যের আলো নীল জলে প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয়, প্রকৃতি নিজেই যেন সংগীত বাজাচ্ছে।
নেপলস — পিজ্জার জন্মভূমি!
নেপলস মানেই Pizza Napoletana। এখানেই জন্মেছিল বিশ্বের প্রথম আসল পিজ্জা — Margherita, যা বানানো হয় টমেটো, মোজারেলা চিজ এবং তুলসীপাতা দিয়ে।
শহরের পুরোনো পাথুরে গলিতে বসে যখন এক টুকরো গরম পিজ্জা হাতে নেওয়া হয়, তখন বোঝা যায় — খাবারও হতে পারে ইতিহাসের অংশ।
♀️ নেপলসের গলিপথে হাঁটাহাঁটি
নেপলসের পুরোনো শহর Spaccanapoli যেন জীবন্ত এক জাদুঘর। সরু গলিগুলিতে ঝুলে থাকা কাপড়, মোটরবাইক, বাজারের ডাক, গির্জার ঘণ্টাধ্বনি, আর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা রাস্তার কফিশপ — সব মিলিয়ে এক অসাধারণ ইউরোপীয় প্রাণচাঞ্চল্য।
রাতের বেলায় এই গলিগুলো আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে — আলো, গান আর মানুষের উচ্ছ্বাসে।
নেপলসের সূর্যাস্ত
যখন সূর্য ধীরে ধীরে ভূমধ্যসাগরের জলে মিশে যায়, তখন দূরে আগ্নেয়গিরির ছায়া আর শহরের আলো মিলে তৈরি করে এক অপূর্ব চিত্র। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে বুঝতে পারা যায় — এই শহর ধ্বংসের মুখ দেখেছে, আবার নতুন জীবনে ফিরে এসেছে বারবার।
✨ শেষ কথা
নেপলস এমন এক শহর, যেখানে ইতিহাস ও আধুনিকতা পাশাপাশি হাঁটে। একদিকে প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ, অন্যদিকে সজীব রাতের রাস্তা। আগ্নেয়গিরির ছায়ায় গড়ে উঠেও এই শহর বারবার পুনর্জন্ম নিয়েছে।
তাই বলা যায় —
“নেপলস শুধু দেখা যায় না, নেপলসকে অনুভব করতে হয়।”












Leave a Reply