
ইতালির উত্তর-পশ্চিম উপকূলের লিগুরিয়ান সাগরের নীল জলরাশির পাশে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি মনোরম গ্রাম—মনতেরোসো, ভেরনাজ্জা, কর্নিগ্লিয়া, মানারোলা ও রিওমাজ্জোরে। সম্মিলিতভাবে এদের বলা হয় চিনকুয়ে তেরে। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষিত এই অঞ্চল যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের রঙিন জীবনের এক চমৎকার মিলনভূমি।
প্রকৃতি যেন আঁকড়ে বসেছে পাহাড়-সমুদ্রকে
লিগুরিয়ান উপকূলের খাঁজকাটা পাথুরে পাহাড়ে শত শত বছরের পুরোনো গ্রামগুলো টানানো দোলনার মতো ঝুলে আছে। রঙিন বাড়িগুলো দূর থেকে মনে হয় আঁকার খাতায় রঙ-পেন্সিল দিয়ে আঁকা কোনো স্বপ্নসমুদ্র। নীল সমুদ্র, সবুজ আঙ্গুরের বাগান, আর আকাশের নরম আলো—সব মিলিয়ে প্রতিটি গ্রামের দৃশ্য এক একটিই জীবন্ত পোস্টকার্ড।
মনতেরোসো আল মারে (Monterosso al Mare)
চিনকুয়ে তেরের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে সমতল গ্রাম। লম্বা উপকূল, সোনালি বালির সৈকত আর নীল সমুদ্রের ঢেউ—এখানে সূর্যস্নান ও জলকেলিই পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। পুরোনো শহরের সরু অলিগলি, সি-ফুড, লেবুর বাগান—সব মিলিয়ে শান্ত অথচ প্রাণবন্ত।
ভেরনাজ্জা (Vernazza): সবচেয়ে ছবির মতো গ্রাম
চিনকুয়ে তেরের সবচেয়ে ফটোজেনিক গ্রাম বলা হয় ভেরনাজ্জাকে। উঁচু ঘণ্টাটাওয়ার, নৌকায় ভরা ছোট্ট বন্দর, রঙিন বাড়ি আর কফিশপে বসে সমুদ্রের শব্দ শোনা—এখানে সময় যেন ধীরে ধীরে এগোয়। ক্লিফ-টপ থেকে দেখা সূর্যাস্তের দৃশ্য পুরো ভ্রমণের অন্যতম সেরা মুহূর্ত হতে পারে।
কর্নিগ্লিয়া (Corniglia): পাহাড়ের বুকের শান্ত গ্রাম
অন্য চারটি গ্রামের মতো কর্নিগ্লিয়ার পায়ে সমুদ্র নেই—এটি পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি আঙ্গুরের বাগানে ঘেরা। এখানকার সরু শান্ত রাস্তা, ছোট দোকান ও লেবুর সুবাস যেন আপনাকে নিয়ে যায় কয়েক শতাব্দী আগের ইতালিতে। এখানে ভিড় কম, তাই নীরবতা উপভোগ করার জন্য আদর্শ।
মানারোলা (Manarola): রঙের এক উৎসব
প্রাচীনতম গ্রামগুলোর একটা মানারোলা। সন্ধ্যায় যখন আলো জ্বলে ওঠে, তখন রঙিন বাড়িগুলো যেন সমুদ্রের ওপর ঝুলে থাকা আলোক-স্বপ্ন। এখানকার প্রাচীন গির্জা, ঢালু রাস্তা ও লিগুরিয়ান খাবারের ঘ্রাণ ভ্রমণকে করে তোলে নিখুঁত।
রিওমাজ্জোরে (Riomaggiore): সমুদ্রের সাথে প্রেম
চিনকুয়ে তেরের সবচেয়ে জনবহুল ও জীবন্ত গ্রাম। নৌকায় বসে সমুদ্রের হাওয়া উপভোগ, রেস্টুরেন্টে সি-ফুড পাস্তা, ঢালু রাস্তা ধরে নিচে নেমে বন্দরঘাটে দাঁড়িয়ে ঢেউ দেখা—সব মিলিয়ে রিওমাজ্জোরে হলো প্রাণের স্পন্দন।
কি দেখবেন ও কি করবেন
১. হাইকিং ট্রেইল
“সেন্তিয়েরো আজ্জুরো” (Sentiero Azzurro) নামে বিখ্যাত ব্লু ট্রেইল ধরে ট্রেক করলে পাঁচটি গ্রামের পুরো সৌন্দর্য ধীরে ধীরে আত্মস্থ হয়। পাহাড়ের ধারে চলা পথ, নিচে নীল সমুদ্র—রোমাঞ্চ আর শান্তি দুই-ই রয়েছে।
২. বোর্ড ট্যুর
নৌকা ভ্রমণে দূর থেকে রঙিন গ্রামগুলোকে দেখলে বোঝা যায়, কেন পৃথিবীর সেরা উপকূলগুলোর তালিকায় এর নাম আসে।
৩. লিগুরিয়ান খাবার
চিনকুয়ে তেরের পেস্টো (Pesto) সস সারা ইতালিতেই বিখ্যাত। টাটকা সি-ফুড, লেবুর তৈরি মিষ্টান্ন ‘লিমোনচেল্লো’—ভ্রমণকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।
কিভাবে যাবেন
ফ্লোরেন্স বা পিসা থেকে ট্রেনে চিনকুয়ে তেরে পৌঁছানো সবচেয়ে সুবিধাজনক। পাঁচটি গ্রামের মধ্যে বিশেষ রেললাইন রয়েছে, তাই প্রতিটি গ্রাম থেকেই পরবর্তী গ্রামে যাওয়া অত্যন্ত সহজ।
ভ্রমণ কেমন অভিজ্ঞতা দেয়?
চিনকুয়ে তেরে এমন এক জায়গা, যেখানে সময় থেমে থাকে। সমুদ্রের শব্দে ঘুম ভাঙা, রোদে ঝলমলে রঙিন ঘরবাড়ির ছায়া, পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা আঙ্গুর বাগানের নরম গন্ধ—এ যেন জীবনের গতি ধীরে এনে স্নিগ্ধতা উপহার দেয়।
যারা ভিড় ভাগাতে চান, আর প্রকৃতি ও মানুষের রঙিন সঙ্গম উপভোগ করতে চান—তাদের কাছে চিনকুয়ে তেরে হবে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।












Leave a Reply