কৃত কর্মের ফলভোগ অনুশোচনা অনুতাপ : স্বামী আত্মভোলানন্দ (পরিব্রাজক)।

ওঁ নমঃ শ্রী ভগবতে প্রণবায়।
আমাদের অপূর্ব সুন্দর মূল্যবান মনুষ্য জীবনে সত্য সনাতন ধর্মে মহান মহাকাব্য গুলির মধ্যে একটি হল রামায়ণ। রামায়ণ সমাজে বিভিন্ন সম্পর্কের ও পারস্পরিক কর্তব্য বর্ণনার পাশাপাশি আদর্শ স্বামী, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ পুত্র, আদর্শ স্ত্রী ও আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক, আদর্শ রাজার চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে আদর্শ মানবসমাজের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমরা জানি রাজার ছেলে, রাজবাড়িতে বড় হবেন, উত্তরাধিকার সূত্রে রাজসিংহাসন লাভ করে ভোগ আর ঐশ্বর্যময় জীবন যাপন করবেন। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু রামায়ণেই আমরা দেখছি, সিংহাসন থেকে মাত্র এক পা দূরে তিনি তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে চোদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যেতে হচ্ছে রামচন্দ্রকে। নিজের সৎ-মায়ের ষড়যন্ত্রের ফলে, পিতৃআজ্ঞা পালনের জন্য এক লহমায় রাজ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে একেবারে সাধারণ ভিক্ষু তপস্বীর মত জীবন যাপন। ইনিই হলেন আমাদের ভগবান পুরুষোত্তম রামচন্দ্র। আর এই হল আমাদের মহাকাব্য রামায়ণ এখানেই আমাদের মহাকাব্যের সার্থকতা।

রামচন্দ্র,ভরত একদিন সন্ধ্যেবেলায় তিন ভাইয়ে একসাথে সর্যু নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে ভরত দাদা শ্রীরামকে বললেন, আমি কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি? দাদা। আপনাকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য মন্থরার সাথে মাতা কৈকেয়ী যে ‘ষড়যন্ত্র’ করেছিলেন, তা কি দেশদ্রোহিতা নয়?
তাদের ‘ষড়যন্ত্রের’ কারণে একদিকে রাজ্যের ভবিষ্যৎ মহারাজ (রামচন্দ্র) ও মহা রানীকে (সীতা) চোদ্দ বছরের নির্বাসন সহ্য করতে হল। অন্যদিকে পিতা দশরথের (মহারাজের) মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এমন ‘ষড়যন্ত্র’ (সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে মাতা কৈকেয়ীকে শাস্তি দিলেন না কেন?

রাম হেসে বললেন, “তুমি কি জানো, ভরত? কোনো পরিবারে চরিত্রবান ও ধার্মিক পুত্রের জন্ম হলে, তার জীবন তার অসংখ্য প্রজন্মের পূর্বপুরুষদের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করে। “মা” কৈকেয়ী ভরতকে যিনি জন্ম দিয়েছেন। একজন মহাত্মার কাছে তাকে কিভাবে শাস্তি দেওয়া যায়?”
রামের কথাই ভরত সন্তুষ্ট হল না। কহিল, দাদা- এটা আসক্তি এবং রাজার শাস্তি আসক্তিমুক্ত। দয়া করে রাজার মতো উত্তর দিন, কেন মাকে শাস্তি দিলেন না? মনে করেন, এই প্রশ্নটি আপনার ছোট ভাই ভরত নয়, অযোধ্যার একজন সাধারণ নাগরিক জিজ্ঞাসা করছেন। রাম গম্ভীর হয়ে উঠল…। কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর বলল, তোমার মাতার কোনো অপরাধের শাস্তি না দেওয়াই এই পৃথিবীতে ‘কঠোর শাস্তি’ ভরত!

*”মা কৈকেয়ী তার একটি ভুলের জন্য কঠিন শাস্তি ভোগ করেছেন। চৌদ্দ বছরের প্রবাসে আমরা চার ভাই নিজ নিজ জায়গা থেকে পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেছি। কিন্তু মা কৈকেয়ী প্রতিমুহূর্তে মারা যাচ্ছেন। তার একটি ভুলের কারণে, তিনি তার স্বামীকে হারিয়েছেন, তার চার পুত্রকে হারিয়েছেন, তার সমস্ত সুখ এবং সম্মান হারিয়েছেন, তবুও তিনি নিজেকে সেই “অপরাধ” থেকে মুক্ত করতে পারেননি। নির্বাসন শেষ হলে… পরিবারের বাকি সদস্যরা সুখী ও সন্তুষ্ট হয়ে ওঠে, কিন্তু সে কখনো সুখী হতে পারেনি। একজন ‘রাজা’ একজন ‘নারী’কে এর চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কী দিতে পারে? তিনি যতদিন বাঁচবেন অনুশোচনা অনুতাপের অনলে দগ্ধ হবেন।”*

“আমার কারণে, আমার মাকে কোনো কারণ ছাড়াই এমন কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে” ভেবে আমি সবসময় দুঃখ পাই। রামের চোখ জলে ভরে গেল এবং ভরত ও আরও ভাইরা চুপ হয়ে গেল। রাম আবার বললেন…আর কেন তার ভুলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে ভরত! যদি আমি নির্বাসিত না হতাম, পৃথিবী ‘ভরত’ এবং ‘লক্ষ্মণ’- এর মতো ভাইদের অবিশ্বাস্য ভ্রাতৃপ্রেম জানত না, আমি কীভাবে দেখতে পেতাম? আমি কেবল আমার পিতামাতার আদেশ পালন করেছি, কিন্তু তোমরা উভয়েই আমার প্রেমে চৌদ্দ বছরের নির্বাসন সহ্য করেছ। যদি *”নির্বাসন”* না থাকত তাহলে এই পৃথিবী কিভাবে শিখবে… ভাইদের মধ্যে সম্পর্ক কি? ভরত রামের কথাই চুপ হয়ে গেল। সে তার বড় ভাইকে অনিচ্ছায় জড়িয়ে ধরল!

তাই, রামায়ণে রাম একটি স্লোগান নয়। রাম একটি আচার, একটি চরিত্র, একটি “জীবনশৈলী”। তাই, রামায়ন আমাদের শিক্ষা দেয় জীবনে আমাদের কী করা উচিত। মহান ধর্মগ্রন্থ আমাদের রামায়ণ। তাই, আমাদের পারিবারিক, সামাজিক জীবনে মা-বাবা, দিদি-দাদা, ভাই-বোন, শিক্ষক-শিক্ষিকা,ধর্মগুরু, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, ইত্যাদি গুরুজন ব্যক্তির কাছ থেকে শিখতে হয় নত মস্তকে, মাথা নিচু করে। কিন্তু, এই পৃথিবীতে জীবন সংগ্রামে বাঁচতে হয় উনত মস্তকে, মাথা উঁচু করে। কারণ, আমাদের জীবনে বিশ্বাস, সম্মান অর্জিত হয়, কিন্তু, সততার প্রশংসা হয়। আমাদের জীবনে ভবিষ্যত এমন কিছু নয় যাতে আমরা প্রবেশ করি, বরং, আমাদের ভবিষ্যত এমন কিছু যা আমরা নিজেরা তৈরি করি।এটাই মনুষ্য জীবনে আদর্শ।
ওঁ গুরু কৃপা হি কেবলম্ ।
স্বামী আত্মভোলানন্দ *পরিব্রাজক*

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *