কবি গুরুর প্রয়ান দিবস স্মরণ হোক বনোমহোৎসবের মাধ্যমে।

0
930

প্রতিবছর ২২ শে শ্রাবণ ঘুরে ফিরে আসে আমাদের জীবনে আর আমাদের মনে পড়ে যায় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহজগতে নাই। কিন্তু সত্যই কি তিনি আমাদের মধ্যে নেই? প্রতিদিন আমরা এত রবীন্দ্রনাথের গান শুনছি, রবীন্দ্রসংগীত গাইছি, তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করছি, তাঁর কবিতা পাঠ করছি যে আমাদের মনে হয় না রবীন্দ্রনাথ আর আমাদের মধ্যে নাই। তাছাড়া কবিগুরু শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে গেলেও আজও বিশ্বভারতীর পথে-প্রান্তরে-বৃক্ষলতায়, আম্রকাননে, ফুলে ফুলে পল্লবে পল্লবে- উত্তরায়নের গৃহগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর দুটি পায়ের চিহ্ন । শুধুমাত্র শান্তিনিকেতনে নয়,তাঁর উজ্জ্বল প্রতিভা ও কর্মময় জীবনের স্পর্শ বাংলা তথা ভারতের গ্রাম-গঞ্জে-শহরে-সর্বত্র আজও তার মৃত্যুর এতো বছর পরেও সমান মহিমায় বিরাজিত। একদা তিনি বাংলা সাহিত্যের কমলবনে যে সহস্রদল পদ্ম প্রস্ফুটিত করে গিয়েছিলেন তাঁর সৌরভ তো আজও মিশে আছে সর্বত্র।কালের নিয়মে তিনি এই সুন্দর ভূবন ছেড়ে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিসম্ভার। কারন তিনি যে মানুষের মনের মন্দিরে চিরভাস্মর।
আর রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো মৃত্যুকে বিশ্বাস করতেন না।তাই তাঁর কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল –
“কোথাও দুঃখ,কোথাও মৃত্যু,কোথাও বিচ্ছেদ নাই,
মৃত্যু যে ধরে মৃত্যুর রূপ,দুঃখ যে হয় দুঃখের কূপ।”
তিনি জানতেন,ইহজগতে মানুষের মৃত্যু হলেও তাঁর আত্মা মরে না, সে চিরকাল বেঁচে থাকে,অন্য দেহ গ্রহণ করে বর্তমান থাকে । আত্মা অবিনশ্বর। এজন্য তিনি মৃত্যুকে বিভীষিকা বলে মনে করতেন না। বরং তিনি নিজেকে মৃত্যুর চেয়ে বড় বলে মনে করেছেন। তাই তিনি জোর গলায় বলেছেন –
“তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড় নও,
আমি মৃত্যুর চেয়ে বড় এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে।”
তিনি ছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী। “আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়”-এমন উক্তি করার মতো স্পর্ধা কারও মধ্যে থাকা সহজ নয়। কিন্তু বিশ্বকবি কত সহজেই না এই কথাগুলি বলে গেলেন তাঁর অমর লোকে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে । তিনি মৃত্যুকে হাসি মুখে বরন করে নিয়ে বলেছিলেন –
“ মরণ রে,
তুঁহি মম শ্যম সমান।
তুঁহু মম মাধব, তুমি মম দোসর
তুমি মম তাপ ঘুঁচাও
মনরে তু আওরে আও।”
মৃত্যুকে নিয়ে তাঁর কি অদ্ভূত খেলা ! মরন রবীন্দ্রনাথকে অমৃত দান করেছে, তাঁর মনের সমস্ত দুঃখ-শোক-তাপ দূর করে দিয়েছে, মনের সমস্ত ভয়-বাধা ঘুচিয়ে দিয়ে মরণ তাঁর কাছে অভয়মূর্তি ধারণ করেছে। তাঁর কাছে মৃত্যুতো পরমেশ্বরকে পাওয়ার মতো সুন্দরতম জিনিস।
তিনি মৃত্যুকে আহ্বান করে কত সুন্দর ভাবে বলেছেন –
“ওগো মরণ, হে মোর মরন
অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও।”
মরনকে নিয়ে কবির এক নতুন ধরনের অনুভুতি!
“নব নব মৃত্যুপথে তোমারে পূজিতে যাব জগতে জগতে।”
এটাই কী ছিল কবি মনের প্রত্যাশা? তিনি কী “মরন নৃত্য ছন্দ মিলিয়ে হৃদয় ডমরু” বাজাতে চেয়েছিলেন? তিনি কী “ভীষন-দুঃখে ডালি ভরে লয়ে’ তাঁর অর্ঘ্য সাজাতে চেয়েছিলেন?
কবি সারাজীবনে ব্যক্তিগত ভাবে মৃত্যুমিছিল দেখেছিলেন- দেখেছেন আপন পত্নী ও জননীর পরলোকগমন, দেখেছেন আপন বৌদি কাদম্বরী দেবীর অকালমৃত্যু, তাঁর বুকে শেলসম বিদ্ধ হয়েছে পুত্রদ্বয় বলেন্দ্রনাথ ও শমীন্দ্রনাথ ও কন্যা রেণুকার অকালমৃত্যু , তারপরেও তার পিতৃবিয়োগ তাঁর অন্তরে এক বিরাট আঘাত হেনেছে। এত মৃত্যুমিছিল সচক্ষে দেখেও তিনি অকম্পিত,অবিচলিত, সমাধীস্থ। কতটা মনের জোর থাকলে একজন মানুষের পক্ষে এসব সহ্য করা যায়!
মাত্র কয়েকবছরের মধ্যে ছয় সাত জনের মৃত্যুজনিত আঘাত সহ্য করেও তিনি মীরাদেবীকে একটি পত্রে লিখেছিলেন-“আমাদের চারিদিকেই এত দুঃখ এত অভাব এত অপমান পড়িয়া আছে যে নিজের শক লইয়া অভিভূত হইয়া এবং নিজেকেই বিশেষভাবে দুর্ভাগা কল্পনা করিয়া পড়িয়া থাকিতে আমার লজ্জা করে।” এর কারন কবি ভাল করে জানতেন-
“আছে দুঃখ,আছে মৃত্যু,বিরহ দহন লাগে
তবু শান্তি,তবু আনন্দ,তবুও অনন্ত জাগে।”
বাস্তবিক পক্ষে ,তিনি জীবনে দুঃখ ও মৃত্যুকে স্বীকার করতে চান নি। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে , এই আত্মীয় স্বজন হারা দুঃখ শোকের মধ্যেও কবিগুরু তাঁর সাহিত্য সাধনা , সঙ্গীতচর্চা,শিল্পসৃষ্টি,স্বদেশ চিন্তা,শিক্ষাভাবনা,পল্লীসংগন , সর্বোপরি,বিশ্বের মানুষের মঙ্গল চিন্তায় সারাজীবন কাটিয়েছেন। তাঁর আশি বছরের জীবনে যেন কোনো ছেদ পরে নি। এর কারন তিনি ভাল করে জানতেন যে, মানবদেহের মধ্যে যে আত্মা আছে সে তো অক্ষয় –অমর।তাই মৃত্যু আমাদের দেহটাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেও আত্মার কোনো ক্ষতি বা পরিবর্তন হয় না, আত্মা হচ্ছে অজেয়, আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না। কবির আত্মাও আজও আমাদের চারিদিকে বিরাজ করছে।
১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখের প্রভাতে যে রবি তাঁর উজ্জ্বল ছটা নিয়ে উদিত হয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে সেই রবিরশ্মি নিঃশেষ হয়ে গেল আশিবছর বয়সে ২২ শে শ্রাবণের মধাহ্নে ।
প্রতি বছর নিয়ম করে আমরা যখন ২২শে শ্রাবণকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন হিসাবে পালন করে শোকে মূহ্যমান হই , তখন কিন্তু আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রাথের আশ্রম শান্তিনিকেতনে এই ২২ শে শ্রাবণ পালিত হয় নতুন ছন্দে,নতুন আনন্দ উৎসবে।কারন প্রতি বছর রবীন্দ্র-প্রয়ান দিবসে বৃক্ষরোপণ উৎসব খুব আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। এদিন এক বিশেষ মুহূর্তে একটি শিশু তরুকে সুসজ্জিত দোলায় নৃত্যগীত সহযোগে বয়ে আনা হয় আশ্রমের কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে এবং রোপণের আয়োজন করা হয় । শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণের সময়ে কবি নিজে যেভাবে বৃক্ষকে বন্দনা করেছিলেন তা অতুলনীয়। তার উদ্দেশ্য ছিল তরুশিশুকে মানব সমাজের সান্নিধ্যে আহ্বান জানানো।এজন্য তিনি বৃক্ষরোপণকে একটি রূপ দিয়ে বনমহোৎসব করতে চেয়েছিলেন।ক্ষিতি,অপ,তেজ,মরুৎ ও ব্যোম – এই পঞ্চভূতের আহ্বান করা হয় ।এজন্য ছাত্রছাত্রীরা এই পঞ্চভূতের রূপসজ্জায় সজ্জিত হয়ে শান্তিনিকেতনে প্রথমে বৃক্ষের বন্দনা করে, তারপর বৃক্ষশিশুকে রোপণের ব্যবস্থা করা হয় ।অরন্যের তরু শিশুকে রোপণের সময়ে নৃত্যের তালে তালে সঙ্গীত দিয়ে আহ্বান জানানো হয়-
“আয় আমাদের অঙ্গনে অতিথি বলেক তরুদল, মানুষের স্নেহ সঙ্গ নে,চল আমাদের ঘরে চল।”
গানটি শেষ হলেই বৃক্ষ শিশুকে রোপন করা হয়! বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম শ্রাবণ মাসে এই বনমহোৎসবের আয়োজন করেছিলেন, তাঁর প্রান মাতানো গান শোনা গিয়েছিল ছেলেমেয়েদের কণ্ঠে-
“মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূণ্যে হে প্রবল প্রান্তে
ধুলিরে ধন্য করো করুনার পূন্যে হে কোমল প্রাণ।”
মরুবিজয়ের কেতন উড়াতে ও ফুলে ফুলে পল্লবে পল্লবে মাধুরি ভরে তুলতেই কবিগুরুর বনমহোৎসবের ভাবনা। তিনি অনুভব করেছিলেন যে বনসৃজনের মধ্যেই রয়েছে মানুষের বাঁচার চাবিকাঠি।মানুষকে বাঁচতে হলে বৃক্ষরোপনই একমাত্র পথ। রবীন্দ্রনাথের প্রবর্তিত এই বনমহোৎসবের ধারা আজও শান্তিনিকেতনে অব্যাহত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই আধুনিক ভারতে বনমহোৎসবের প্রবর্তক বলা চলে।বর্তমান ভারতে কবি প্রবর্তিত বনমহোৎসব বা বৃক্ষরোপণের উপযোগিতা স্বীকৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ভালো ভাবে জানতেন যে বৃক্ষই মানুষের নিকটতম প্রতিবেশী। প্রাচীনকালে মানুষকে ক্ষুধার অন্ন ও মাথা গুজবার প্রথম ছায়া এই বৃক্ষই দিয়েছিল। এই বৃক্ষই আমাদের জীবনধারনের একমাত্র অবলম্বন।
আজ ২২ শে শ্রাবনের বৃষ্টি-ঝরা বাদল দিনে আমরা নতুন করে কবিকে স্মরণ করবো, কিন্তু অশ্রুসজল নয়নে নয়,কান্নায় বুক ভাসিয়ে নয়,বেদনা ভরা হৃদয় নিয়ে নয়-বরং তাঁকে স্মরণ করবো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে। তাঁর আদর্শকে উপযুক্ত মর্যাদা দেবার জন্য তাঁর বৃক্ষরোপনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমরাও এই ২২ শে শ্রাবনে বৃক্ষরোপণ করবো। তবে এ বছর করোনা ভাইরাস অতিমারীর জন্য এই উৎসবটি হবে আড়ম্বরহীন ভাবে।একস্থানে পাঁচ,দশ,পঞ্চাশ জন ব্যক্তি সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থবিধি মেনে এই বৃক্ষরোপণ উৎসব পালন করবো। তাহলেই বিশ্বকবির আত্মা তৃপ্তি পাবে-তিনি দূরে থেকে দেখতে পাবেন তাঁর আদর্শ মেনে আজকের ভারতবাসী সেই বনমহোৎসবে যুক্ত হয়েছে ।

প্রশান্ত কুমার দাস
শিক্ষারত্ন প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বাজিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়(উঃমাঃ)
পোঃ-পাথাই, ময়ূরেশ্বর-১,বীরভূম,
মোবাইলঃ-9474731116, e-mail-prasantakd1971@gmail.com