ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজী : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
1417

বড়দিনের বড় ভাবনায়__

স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগোতে গিয়েছিলেন ১৮৯৩ সালের Parliament of Religion নামক প্রথম বিশ্বধর্ম সম্মেলনে । আর তার ৪০ বৎসর পর ওই চিকাগোতেই অনুষ্ঠিত World Fellowship of Faiths নামক দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিলেন যিনি, তিনি হলেন ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজী । স্বামীজী যেমন ভাবে সমগ্র পাশ্চাত্য দেশকে সেদিন জয় করেছিলেন তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতায় , সনাতন হিন্দু ধর্মের মানবিকতার বাণীতে , তেমন করেই ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজীও জয় করে এসেছিলেন সমগ্র পাশ্চাত্য বাসীদের হৃদয়, মুগ্ধ করেছিলেন তাদের মনকে। গিয়েছিলেন মাত্র তিন মাসের মেয়াদের ভিসায় , অথচ ,তাঁকে সেখানে থাকতে হয় টানা পাঁচ বছর আটমাস কেবলমাত্র তাঁর অসাধারণ ভাষণ বা বক্তৃতার চাহিদায়।

দ্বিতীয় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে মহানামব্রতজী দিয়েছিলেন চারটি ভাষণ। কিন্তু, সেই চারটি ভাষণের সারবত্তা এতটাই প্রাঞ্জল ,বলিষ্ঠ এবং হৃদয়স্পর্শী ছিল যে , বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থা থেকে অসংখ্য আমন্ত্রণ আসলো বক্তৃতা প্রদানের জন্য। International Fellowship of Faiths একটি কমিটি গঠন করলেন Inter cultural Committee নামে। সেই কমিটির সেক্রেটারি করা হল মহানামব্রতজীকে। এই সম্মান কেবলমাত্র প্রথম ভারতীয় হিসেবে নয় , প্রথম এশীয়াবাসী হিসেবে তিনিই পেয়েছিলেন । তাঁর ভাষণের চাহিদা সমগ্র আমেরিকা , ইউরোপের এত জায়গা থেকে আসে যে দেখা যায় তিন মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে একবছর সময় লাগবে সব জায়গায় ভাষণ সম্পূর্ণ করতে। কমিটির পক্ষ থেকে উপায় বের করা হল, যদি মহানামব্রতজী ওদেশে ছাত্র হন , তবে ষ্টুডেন্ট ভিসা পেয়ে তিনি থেকে যেতে পারবেন আরও কিছু কাল। চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে Ph.D.র জন্য আবেদন করলেন মহানামজী। World Fellowship of Faiths-র সহায়তায় আবেদন মঞ্জুর হল। ভিসার মেয়াদ বেড়ে গেল।বৈষ্ণব দর্শন নিয়ে গবেষণা করতে থাকলেন মহানামব্রতজী।

শুরু হল ভাষণের ভাগীরথী স্রোত । অচিরেই এমন অবস্থার অবতরণ হল যে , তাঁর ভাষণের ডেট বুক করতে হলে এক বছর আগে থাকতে করতে হত, তাহলে পরের বছর তাঁকে পাওয়া যেত। পরিসংখ্যান জানায় , ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমেরিকার ৬৩ টি শহরে মোট ৩৪৫টি সভায় ভাষণ দেন World Fellowship-এর উদ্যোগে। এছাড়া অন্যান্য সংস্থার অতিথি হয়ে ৪৭৬টি ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর অসাধারণ পান্ডিত্য , পরিবেশনের সহজ-সরল ভঙ্গী, বিশ্ববাসীর মন হরণকারী গুণ-প্রভাব দেখে ধর্মসভার প্রধান কর্মকর্তা(সভাপতি) মিষ্টার ওয়েলার তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন–‘a rare combination of wisdom and wit’ —জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার এক বিরল সমন্বয় তিনি।বাগ্মীতার ওজস্বিতা কতখানি থাকলে এমনটা সম্ভব তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়।বিশ্বজয় করা বিদগ্ধ এই পন্ডিতের গ্রহণীয়তা স্বামী বিবেকানন্দের থেকে এতটুকুও কম নয় , বরং যদি বলা হয় বেশী হলেও হতে পারে, তবে কিন্তু অত্যুক্তি হয় না।

ডঃ হারাণবন্ধু ব্রহ্মচারীজীর লেখা থেকে একটি ছোট ঘটনা জানতে পেরেছি মহানামব্রতজীর বক্তৃতার অপ্রতিম আকর্ষণী ক্ষমতা সম্বন্ধে। ঘটনাটি এমন– মহানামব্রতজী একবার লক্ষ্য করেছিলেন , তাঁর প্রায় প্রতিটি সভায় এক শ্রোতা উপস্থিত থেকে অত্যন্ত মনোযোগসহ শোনেন সব কথা। একদিন সেই ব্যক্তি পরিচয় করলেন মহানামব্রতজীর সঙ্গে। ব্যক্তিটি জানালেন , তিনি ভক্ত তো নন্ই , এমনকি তিনি এতটুকুও ঈশ্বরবিশ্বাসীও নন্। মহানামব্রতজী বিস্মিত হয়ে বললেন, “তাহলে যে আপনি প্রায় প্রতিটি সভায় চলে এসে এত মন দিয়ে কথা শোনেন আমার!” ব্যক্তিটি বললেন, ” হ্যাঁ, শুনি তো বটেই। আর ,প্রতিদিন উপস্থিত হবার জন্য আমায় অনেক কষ্টও করতে হয়।” মহানামব্রতজী–” তাহলে আসেনটা কেন শুধু শুধু কষ্ট করে!” ব্যক্তি বললেন– “শুনতে আসি কারণ , আপনি আপনার ভাষণে এত সুন্দর সুন্দর ছোট ছোট গল্প বলে উপমা দেন যে, সেগুলো খুব শিক্ষণীয়। সেগুলো শোনার আকর্ষণে আমি না এসে থাকতে পারি না। কেমন যেন সম্মোহনী শক্তি আছে আপনার ভাষণে। আমকে টেনে নিয়ে আসে সভায় ।” মহানামব্রতজী বললেন, ” আমি হলে এমন করে কষ্ট করতাম না।” ব্যক্তিটি বললেন, ” আপনি যদি শ্রোতা হতেন আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনার কথার , তাহলে দেখতেন আপনিও না এসে থাকতে পারতেন না। আপনিও রোজ আসতেন।”

মহানামব্রতজীর প্রতিটি ভাষণের শেষে থাকতো একটি প্রশ্নত্তোর পর্ব। এই পর্বটি সকলে খুব উপভোগ করতেন,খুব আকর্ষণীয় হত শ্রোতাদের কাছে । কারণ,সেসময় যাঁর যা প্রশ্ন , জিজ্ঞাস্য থাকতো , করতে পারতেন । আর , মহানামব্রতজী তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সকল কৌতুহলের নিরসন করতেন। প্রশ্নগুলোও যেমন হত দারুণ বুদ্ধিমত্তার ও চমকদার , সাক্ষাৎ সরস্বতীদেবীর বরপুত্র মহানামব্রতজীও তেমনই সকল প্রশ্নের যাবতীয় উত্তর দিয়ে মুগ্ধ করে দিতেন সকলকে। দেখা যেত , ভারতীয় ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য , নারীদের নিয়ে পাশ্চাত্য দেশের অনেক মানুষেরাই ভ্রান্ত, হীন, ঘৃণ্য ধারণা পোষণ করতেন মনে । মহানামব্রতজী নিজের সুচারু বিশ্লেষণী ক্ষমতার দ্বারা, ক্ষুরধার বুদ্ধিতে সেসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁদের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতেন। ভারতবর্ষের সংস্কৃতির ,ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করতেন।

যেমন, প্রশ্নোত্তর পর্বে একবার একজন প্রশ্ন করেছিলেন–“ভারতে আপনাদের তো ডজন ডজন ভগবান। তাঁদের মধ্যে কাকে ডাকলে সত্যিকারের মুক্তি পাওয়া যায় , বলতে পারেন কি? ” মহানামব্রতজী উত্তর দিয়েছিলেন–” আপনার প্রশ্ন শুনে আমি বিস্মিত। ভারতের কোন শিশুও এজাতীয় প্রশ্ন করবে না। আপনার শহরে হাজার হাজার লেটার বক্স , আর আপনি হাতে কতগুলো চিঠি নিয়ে ঘুরছেন , কোন লেটার বক্সে ফেললে ঠিকঠিক যাবে ভেবে। এমনই আজব প্রশ্ন করলেন। যে লেটার বক্সেই ফেলেন না কেন, চিঠি পৌঁছাবার অর্গানাইজেশন চিঠি ঠিক গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবেন যেমন, তেমনই যে দেবতাকেই আপনি ইষ্ট জ্ঞান করে ডাকেন না কেন , তিনি নিয়ে আপনাকে শ্রীহরির চরণে ফেলে দেবেন। আপনার বার্তা সেই দেবতার মাধ্যমে শ্রীহরির কাছে পৌঁছে যাবেই। বাছাবাছির প্রয়োজন নেই।”

মহানামব্রতজী বারংবার সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে উঠে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে হিন্দুধর্ম কোন একটি আলাদা বিশেষ ধর্ম নয় , মনুর লিখিত মানব ধর্ম এটি, যা বিশ্বের যে কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । তাই এর শাস্ত্রীয় নাম সনাতন ধর্ম , যার অর্থ চিরকালের ধর্ম। পারসিকরা সিন্ধু নদের পূর্বতীরের ভূখন্ড কে বোঝাতে বলত ‘হফ্ত হিন্দ’। সেই হফ্ত হিন্দের অধিবাসীদের ধর্মকে কালে কালে বলা হল হিন্দু ধর্ম বা আর্য ধর্ম। আর্য ধর্মের কথার অর্থ Religion of Gentlemen। মহানামব্রতজী তাঁর গভীর শাস্ত্রজ্ঞান আর ধীশক্তির দ্বারা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে বর্তমান যুগসমস্যা সমাধানে যে জীবনাদর্শ মেনে চলা উচিত, সেই আদর্শের কথাই জানায় মানবধর্ম। হিন্দু ধর্ম কখনো বলে না যে তুমি হিন্দু হও, বরং বলে তুমি মানুষ হও। মনুষ্যত্ব তো অর্জন করতে হয় । মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারলেই মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, অসাম্য , বিভেদ দূর হবে। তিনি বলতেন, মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম আলাদা কোন ধর্ম নয়। প্রেমই ধর্মকে ধারণ করে রাখে। অপ্রেমের ভিত্তিতে কোথাও কোন ধর্ম গড়ে ওঠেনি। অতএব, প্রেমই ধর্ম, অপ্রেমই অধর্ম। এমন প্রেমের বাণী, মৈত্রীর বাণী, আশার বাণী, একপ্রাণতার বাণী প্রচার করে তিনি মহাপ্রভুর প্রেমধর্মের যুগপোযোগীতা প্রমাণ করেছিলেন। তিনি মানুষের মনকে মথিত করে দিতেন মনুষ্যত্বের চেতনায়। আর , এখানেই তো একজন সাধক-মহামানবের সাধনার জয় হয়। সারাটি জীবন ধরে সযত্নে যে আদর্শকে একজন সাধক জীবন পথের পাথেয় করেন তা সফলতায় ,পূর্ণতায় পর্যবসিত হয় তখন।

২৫শে ডিসেম্বর যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাব দিবস। যীশুখ্রীষ্ট শিক্ষা দিয়েছিলেন–” Love Thy Neighbor as Thyself”— যেমন করে নিজেকে ভালোবাসো , তেমন করেই তোমার প্রতিবেশীটিকেও বেসো। ডঃ মহানামব্রতজীর জন্মদিনও ২৫শে ডিসেম্বরের শুভলগ্নে । আসুন, আমরাও বড় করে তুলি আমাদের হৃদয় প্রাঙ্গনটিকে সেই এক মানবিকতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে,যা ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজীও আজীবন প্রচার করে গিয়েছেন যীশু খ্রীষ্টের মতই।
সমাপ্ত