শ্রীধাম নবদ্বীপের ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডে অবস্থিত সুবিখ্যাত শ্রীমদনমোহন মন্দির। এই মন্দিরে কোজাগরী পূর্ণিমা তিথির পবিত্র ,শুভ লগ্নে মহাসমারোহে ও সুগভীর নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয় দেবী শ্রীমহালক্ষ্মীর পূজা। এই মহালক্ষ্মী পূজার এক অদ্ভুত ইতিহাস আছে । স্বয়ং শ্রীরাধাই নাকি পূজা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন শ্রীমহালক্ষ্মী রূপে । আর ,তা কোন আশ্চর্য্যজনক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে , আসুন তা জেনে নিই।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ তখন। নবদ্বীপবাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য দাস বাবাজীর সেবিত শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন যুগলবিগ্রহ ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন যে তাঁরা ,প্রভুপাদ শ্রীপ্রাণগোপাল গোস্বামীর সেবা গ্রহণ করতে আগ্রহী এবার থেকে। সেইমত স্বেচ্ছাময় শ্রীভগবানের ইচ্ছাপূরণ করতে কৃষ্ণচৈতন্য দাস বাবাজী বিগ্রহের সেবাভার প্রভুপাদের শ্রীহস্তে সমর্পণ করে নিজে চলে গেলেন বৃন্দাবনে। প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী কিছুকাল পর প্রতিষ্ঠা করলেন রাধামদনমোহন মন্দির। মন্দিরের বিগ্রহ শ্রীশ্রীরাধামদনমোহনের প্রতিভূবিগ্রহ বা বিজয়বিগ্রহ রূপে আনয়ণ করা হল এক ক্ষুদ্রাকৃতি যুগলবিগ্রহকে।
একবার প্রতিভূ বিগ্রহতে সেবা চলাকালীন সময়ে ঘটল এক মহা অঘটন। হল কি, পূজারীজী বিগ্রহকে স্নান করানোর পর যখন শৃঙ্গার করছেন তখন তাঁর হস্তচ্যুত হল শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহটি। মণিময় কৃষ্ণপ্রস্তরে (গ্রানাইট) নির্মিত ছিল শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীরাধার বিগ্রহ অষ্টধাতুর ছিল। স্বভাবতঃই, শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ ভূমিতে পতিত হয়ে আর অক্ষত রইলো না । ভগ্ন হয়ে গেল। এখন ভগ্নবিগ্রহে তো আর সেবা হয়না । তাই পূজারীজী ছুটলেন প্রভুপাদের কাছে নিজেই। যখন প্রাণগোপাল প্রভুপাদ শুনলেন সব , তিনিও গর্ভগৃহে ছুটে এলেন। তিনি বললেন, “বেশ নতুন করে শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হবে তাহলে।” নবনির্মিত বিগ্রহ আনা হল। কিন্তু, এবারও ঘটল আবার অঘটন । এবার আর স্নান করানোর সময় নয় , বা, পূজারীজীর দ্বারাও নয় , এমনিতেই অজানা কোন কারণে শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ কেমন করে ভগ্ন হয়ে গেল । এখন কথা হল যে , বিগ্রহ ভগ্ন হওয়া মহা অশুভ ও অলক্ষণের ব্যাপার । পূজারীজী শশব্যস্তে তাই এলেন প্রভুপাদের কাছে। ভীত অন্তরে দুঃসংবাদ জানালেন। তিনি ভেবেছিলেন যে প্রভুপাদ নিশ্চয়ই এবার তাকে খুব তিরস্কার করবেন , বকাঝকা করবেন । কিন্তু প্রভুপাদ তেমন কিছুই করলেন না।
প্রভুপাদ জানতেন যে, যাঁর ইচ্ছা ভিন্ন বৃক্ষের একটি পত্রও আন্দোলিত হয় না , তাঁর ইচ্ছেতেই সব রকম ঘটন-অঘটন যা কিছু ঘটে। তাই তিনি খুব শান্ত ,স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, “আবার না হয় নতুন করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হবে।” নতুন করে শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ আনার উদ্যোগ করা হতে থাকলো । এরই মাঝে একদিন রাত্রে প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন রয়েছেন ,তখন তাঁকে স্বপ্নদর্শন দিলেন একলা হয়ে যাওয়া সেই শ্রীরাধা বিগ্রহ। শ্রীরাধা বললেন, “একটা কথা বলোতো আমায় , তোমার কন্যা যদি পতিহারা হয়ে যায় ,তবে কি তুমি তাকে এভাবে বারবার বিবাহ দেবে ? নিশ্চয়—না। তাহলে আমার বেলায় কেন এমন করছো ? শোনো, আমি এখন থেকে একলাই থাকতে চাই এই মন্দিরে, যেমন আছি তেমন। কিন্তু, রাধা হয়ে তো কৃষ্ণ ছাড়া থাকতে পারবো না । তাই এবার থেকে মহালক্ষ্মী রূপে আমায় আরাধনা করবে। আমি মহালক্ষী রূপেই বিরাজ করবো এখানে। মহালক্ষ্মী হয়েই পূজা গ্রহণ করব তোমার ।”
প্রভুপাদের নিদ্রাভঙ্গ হল । শ্রীরাধার এমন কৃপায়, এমন জাগ্রত হয়ে দর্শন দানে তিনি তখন ভাববিহ্বল, আবেগাহিত। আঁখি অশ্রুপূর্ণ তাঁর। স্বয়ং শ্রীরাধা প্রকট হয়ে পূজা গ্রহণ করতে চেয়ে মন্দিরে নিজের সাক্ষাৎ অবস্থিতির সাক্ষ্য দিয়ে গেলেন —–এ যে পরম সৌভাগ্যের কথা! ভাষায় প্রকাশ হয় না যে আনন্দানুভূতির কথা ! পরম প্রশান্তির পরশ তাঁর প্রাণ পেল।
সেসময় থেকেই মদনমোহন মন্দিরে মহালক্ষ্মীর পূজার প্রচলন শুরু হল। অতএব, এই পূজার আনুমানিক প্রাচীনত্ব একশো বৎসরের অধিক কাল তো বটেই । বছরে তিনবার মহালক্ষ্মীর আরাধনা করা হয় মহাসমারোহের সাথে এই কোজাগরী পূর্ণিমায়, দীপাবলীর দিন ও পঞ্চম দোলে। দীপাবলীর দিন তো ১১০৮ টি প্রদীপ জ্বালিয়ে নিবেদন করা হয় মহালক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে। আর, এই দীপদান উৎসব হয় তাঁরই আদেশানুক্রমে । এইসব অনুষ্ঠান বড়ই আন্তরিক ও নিষ্ঠাপূর্ণ নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে পালন করা হয় ।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে ,বর্তমানে মদনমোহন মন্দিরের দায়িত্বে রয়েছেন প্রভুপাদ শ্রীনিত্যগোপাল গোস্বামী ও তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রভুপাদ শ্রীপ্রেমগোপাল গোস্বামী।
সমাপ্ত
ভক্ত-কৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।