মহিলা ঢাকির ঝাঁঝ (ধারাবাহিক উপন্যাস, ষষ্ট পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
541

কুহকের মা একটু হেসে বললেন, “তোর প্রশ্নটা, বলা চলে একটা কঠিন প্রশ্ন ? তোর বাবার ঐরূপ নেতিবাচক ব্যবহারের কার্যকারণ বোঝার আমিও গভীরভাবে চেষ্টা করছি । তোর অবগতির জন্য জানাই, যদিও তোর বিশ্বাস নাও হোতে পারে । খেমটির প্রতি তোর বাবার ব্যক্তিগত কোনো রাগ বা আক্রোশ নেই । সমাজে যেহেতু তোর বাবা একজন বিশিষ্ট মানুষ, তাই নীচু জাতের সাথে সম্বন্ধ করাতে আপত্তি । আর এব্যাপারে তোর বাবাকে কতিপয় তথাকথিত গোঁড়া কুলিন ব্রাম্মণ মদত দিচ্ছেন । তাতে তিনি আরও ভড়কে যাচ্ছেন । বেশ কিছুদিন আগে আমার সামনেই তোর বাবাকে গাঁয়ের হিরণ চ্যাটার্জী ও দীনদয়াল মুখার্জি যেভাবে ভয় দেখালেন, তাতেই তিনি কুপেকাত । ভয়ে ঘাবড়ে গেছেন” ।
“ভয় দেখাচ্ছে ?” আত্‌কে উঠলো কুহক ।
তবে বলছি কী ? তাঁদের বক্তব্য, “ঐ মেয়েকে ঘরে তুললে আপনাকে সমাজের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে । গাঁয়ের মানুষ আপনাকে কিছুতেই ছেড়ে দেবেন না । ব্রাম্মণ হয়ে অশাস্ত্রীয় কাজের জন্য আপনাকে সমাজে “এক ঘরে” হিসাবে বাস করতে হবে । আর তাছাড়া ব্রাম্মণ সমাজের মাথা হয়ে আপনি কিছুতেই বেজাতের ও নিম্নবর্গীয় মেয়ের সাথে আপনার একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিতে পারেন না । যদি জোর করে আপনার ছেলে ঐ গর্হিত কাজটি করে, তাহলেও তার ফল আপনাকেই ভোগ করতে হবে । আমরাও কিন্তু তখন নিরুপায় । সুতরাং এখনও সময় রয়েছে ছেলেকে বোঝান, তাকে অন্যত্র বিয়ে দিন” ।
তবে মা ?
তবে কী বাবা ?
খেমটির জেদ, সে বাবাকে রাজী করিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে ।
আজকালকার মেয়েদের মতো খেমটি সেধরনের মেয়ে নয় । তার মতো বিচক্ষণ মেয়ের এটাই উপযুক্ত ও যুক্তিপূর্ণ কথা । তারপর কুহকের মা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন এবং কুহককে বললেন, “তুই কী কাটিহার যাবি” ?
পূজোর পরে যাবো মা । পূজোর সময় খেমটির খুব কাছাকাছি থাকতে হবে । কেননা ঢাকের বাজনার বায়না তারা অনেক আগেই নিয়ে রেখেছে । খেমটির বাবার শারীরিক অবস্থা শোচনীয় । শারীরিক কারণে ঠিকমতো ঢাক বাজাতে পারবে কিনা সন্দেহ ? সেই ক্ষত্রে খেমটিকে ঢাক নিয়ে পূজোয় বাজাতে ছুটতে হবে । তখন আমি কাছাকাছি না থাকলে গাঁয়ের মোড়ল মাতবর খেমটিকে মহিলা ঢাকির তকমা দিয়ে এবং ঢাক বাজাতে অছ্যুত ও নীচু জাতের বাহানা দিয়ে পূজা মন্ডপ থেকে তাড়িয়ে ছাড়বেন । খেমটিকে নিয়ে অযথা জল ঘোলা করতে পিছপা হবেন না । তাছাড়া খেমটির বাবা শিবু বায়েনের শারীরিক স্থিতির জন্য ডাক্তারের কাছে ছুটতে হোতে পারে । সেইজন্য এখন আমি কাটিহারে যাচ্ছি না মা ।
“আমি এখন রান্না ঘরে ঢুকছি । তোর প্রিয় ছোলার ডালের পকোড়া ভাঁজছি । খেয়ে বের হবি ।“ কুহকের মা কুহককে উদ্দেশ্যে করে বললেন ।
তারপর কুহকের মা রান্না ঘরে ঢুকে গেলেন । ঠিক সেই সময় কুহকের বাবা কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকলেন । যতোটুকু কুহক বুঝতে পারলো, “তার বাবা সম্ভবত বেলডাঙ্গার হাটে গিয়েছিলেন ।“ দুইহাতে দুটো বড় ব্যাগ ভর্তি সংসারের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন ।
তারপর…………।
তারপর দুর্গাপূজা আসন্ন । শরতের পরিস্কার আকাশ । আকাশে দুই এক টুকরো সাদা মেঘের আনাগোনা । চারিদিকে ঝোপে জঙ্গলে কাশ ফুলের সমারোহ । আকাশে বাতাসে আনাচে কানাচে আসন্ন দুর্গা পূজার কলকোলাহল ধ্বনির ঘনঘটা । শিশু থেকে বয়স্ক, সকলের মধ্যে মা দূর্গার আগমনের বার্তায় আনন্দানুভূতি ।
শিবু বায়েন আকন্দপুরের বারোয়ারি দুর্গাপূজায় ঢাক বাজানোর বায়না নিয়েছে । ষষ্টির দিন থেকে একাদশী পর্যন্ত ঢাক বাজানোর চুক্তি । এদিকে তার শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে । জ্বরটা কিছুতেই কমছে না । কাশি রয়েছে বরং কাশির প্রকোপ বাড়ছে । শরীর খুব দুর্বল ।
অবস্থা বেগতিক দেখে খেমটি তার বাবাকে চৌরিগাছার জেনারেল ফিজিসিয়ানকে দেখালো । ডাক্তার বাবু বললেন, “তার রক্ত পরীক্ষা করতে হবে ।“ এছাড়া আরও কতকগুলি প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট দিলেন ।
খেমতী তার বাবাকে বহরমপুরে নিয়ে গিয়ে সমস্ত টেস্টগুলি করালো । টেস্টের রিপোর্ট আনতে আবার একদিন সে বহরমপুরে ছুটলো । টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে পুনরায় চৌরিগাছার ডাক্তার বাবুর কাছে দেখাতে গেল খেমটি ।
রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বাবু বললেন, “ভয়ের কারণ নেই । ঔষধ দিচ্ছি, অচিরেই সেরে উঠবে । তবে…।“
তবে কী ডাক্তার বাবু ?
“তবে বাবাকে পরে সময়মতো লিভারজনিত অভিজ্ঞ ডাক্তার বাবুকে দেখিয়ে নেওয়া দরকার অথবা গ্যাস্ট্রোলজিস্ট ডাক্তার বাবুর পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন ।“
কেন ডাক্তার বাবু ?
“লিভারের আশে পাশের দিকগুলির রিপোর্ট ভাল নেই । তাতে আমার সন্দেহ লিভারের ফাংশন ঠিকমতো হচ্ছে না বা গল্ড ব্লাডারের সমস্যা থাকতে পারে । নতুবা লিভারের পাশে মারাত্মক কিছু একটা হয়েছে যেটা আমি ধরতে পারছি না । সমস্যা জটিল মূলত লিভার কেন্দ্রিক । সুতরাং দুর্গাপূজার পরে তাকে অভিজ্ঞ ডাক্তার বাবুকে সত্বর দেখিয়ে নেবেন ।“ চৌরিগাছার ডাক্তার বাবু সবিস্তারে শিবু বায়েনের বর্তমান শারীরিক অবস্থা খেমটিকে জানিয়ে দিলেন ।
ডাক্তার বাবুর ঔষধ নিয়মিত খাওয়ার পর সন্ধ্যায় আর জ্বর আসছে না, কিন্তু কাশি অনবরত । ব্যাপারটা ভাল না লাগার দরুন খেমটি চৌরিগাছার ডাক্তার বাবুর পরামর্শগুলি কুহককে জানালো ।
“তবে কী তোমার বাবাকে কলকাতার বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাও ?” কুহক সরাসরি খেমটিকে জিজ্ঞাসা করলো ।
“বাবাকে কলকাতার নামী ডাক্তার বাবুকে দেখাতে হবেই, তবে সেটা দুর্গা পূজার পর ।“ খেমটির উত্তর ।
ইত্যবসরে শিবু বায়েন তার ছোট মেয়ে খেমটিকে ডাকলো ।
“বাবা আমাকে ডাকছিলে” ? খেমটি চটজলদি বাবার কাছে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলো ।
ভাবছি, ঢোল বাজনার সব ধরনের বোল তোকে শিখিয়ে দেবো ।
সেইক্ষেত্রে বাবা, আমাদের ঢোল প্রয়োজন ?
“ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে । পাড়ার শ্রীহরি বায়েন ঢোল বাজায় । তার ঢোলটা এনে আগামীকাল থেকে তোকে ঢোলের তাল, বোল শেখানো শুরু করবো” । শিবু বায়েন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো ।
পরেরদিন খুব ভোরে শিবু বায়েন ছুটলো শ্রীহরির বাড়িতে । তার ঢোলটা সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ি ফিরলো । বাড়িতে ঢুকে দেখে মেয়ে তখনও ঘুম থেকেই ওঠেনি । মেয়েকে বিছানা থেকে ডেকে তুললো এবং তারপর তাকে শিগগির হাতমুখ ধুয়ে তার কাছে ঢোল বাজাতে বসতে বললো । শিবু বায়েন আবার খেমটিকে বললো, “শ্রীহরির কাছ থেকে ঢোলটা চেয়ে এনেছি, তাই বেশ কয়েকটা বোল তোকে শেখাবো । তুই সময় নষ্ট না করে আমার পাশে বোস্‌ ।“
শিবু বায়েন এদিক ওদিক নানান মানুষের মুখ থেকে জানতে পেরেছে, ঢাকের সাথে সাথে ঢুলিদের কদর ক্রমশ বাড়ছে । এখন আর তর্জা বা কবি গান বা আলকাপ গানের মধ্যে ঢোলের বাজনা আবব্ধ নয় । দেশের প্রতিষ্ঠিত গায়ক-গায়িকারা তাঁদের উৎকৃষ্ট সঙ্গীত পরিবেশনের সময় ঢোলের বাজনার ব্যবহার করছেন । তার নিজের দেখা টিভিতে সা-রে-গা-মা গানের অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতায় ঢোলের বাজনার রমরমা । এসব দেখেশুনে তার স্থির বিশ্বাস, ঢাকের সঙ্গে সঙ্গে ঢোলের কদর দিনদিন আরও বাড়বে । তাই মেয়েকে সবরকম ঢাক ঢোলের বোল শিখিয়ে দ্রৌপদীবিশেষ বানাতে চায় শিবু বায়েন । বায়েনদের মেয়ে, সুতরাং হাতের কাজ এবং বাজনার মতো শিল্পকলা জানা থাকলে তার মেয়ের আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা আরও বাড়বে । আখেরে তার অবর্তমানে মেয়ের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে এই জাতীয় শিক্ষা, জীবিকার্জনে প্রচুর কাজে আসবে ।
ঢোল বাজনা কিছুটা হলেও খেমটি ছোটবেলা থেকে জানে । তবে বোলগুলি একটু ধন্দে । শিবু বায়েন মেয়েকে ঢোল বাজানোর বোল প্রথমেই যেটা শেখালো ঃ
“দাদাবাবু নমস্কার”
“দাদাবাবু নমস্কার”
খেমটি ঢোলের ডাইনে বাঁয়ে কাঠি মেরে ঢোল বাজিয়ে ঐ বোল খুব সহজেই করায়ত্ব করলো ।
মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার শিল্পীরা সাধারণত যে বোল তুলে থাকেন, সেটাও খেমটিকে শেখালো ঃ
ধান কুড়াতে যাবি দিদি,
ধান কুড়াতে যাবি ।
আবার
তাক তেরে কেটে তাক তাক ।
দিদি তোর মাধবকে ডাক ।
ধিনি তাক তিনি তাক
তোর মা রেঁধেছে পুই শাক ।
কবি গানের আসরে বিভিন্ন রকম বোল ব্যবহার হয় । সাধারণত কবি গানের শেষে যে বোলটা ঢুলির মুখে শোনা যায় ঃ

চোখে মুখে মারো ঢিল ।
চোখে মুখে মারো ঢিল ।।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে মেয়েকে ঢোলের বোল তোলা প্রশিক্ষণ দিলো শিবু বায়েন । তারপর খেমটির বাবা সময়ে অসময়ে বাজানোর জন্য যে বোলের কথা বললো, সেটা “হরে কৃষ্ণ” বোল । এই “হরে কৃষ্ণ” বোলটা নবদ্বীপ অঞ্চলে বেশী জনপ্রিয় । কল্যাণীর ঘোষপাড়ার সতী মায়ের মেলার জনপ্রিয় বোল শেখালো শিবু বায়েন ঃ
ঘোষপাড়ার মেলা দাদা
সতী মায়ের খেলা ।
এরকম বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন জেলার উপযোগী বোল শিবু বায়েন ধরে ধরে খেমটিকে শেখালো । খেমটি খুব সহজে ঐ বোলগুলি রপ্ত করে নিলো । শিবু বায়েনের মতে, এই বোলগুলি জানা থাকলে যে কোনো আধুনিক গানের সঙ্গে অনুশীলন করে প্রয়োজনে ঐ গানের উপযোগী বোল সে অনায়াসে নিজেই সৃষ্টি করতে পারবে । সৃষ্টির আনন্দ আলাদা । শিবু বায়েন চায়, তার মেয়ে ঢাকি ও ঢুলি হিসাবে আজকের সমাজে প্রতিষ্ঠা পাক্‌ । নিজের প্রতিভার, সৃষ্টির মর্যাদা পাক্‌ । সে শিক্ষিত মেয়ে । তাই শিবু বায়েনের দৃঢ় বিশ্বাস, তার মেয়ে ঢাক ও ঢোল বাজনার প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসাবে দেশে একদিন স্বীকৃতি পাবেই । তার আশা, খেমটি একদিন নিজের প্রতিভার আলোর উদ্ভাসে বায়েন পাড়ার মুখ দেশের মধ্যে গৌরবোজ্জ্বল করবে ।
যখন মেয়ের সামাজিক মর্যাদার কথা আড়ালে আবডালে শিবু বায়েন ভাবে, তখন তার চোখে জল আসে । বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে সে ঢাক, ঢোল বাজিয়ে আসছে । পূজার অনুষ্ঠান ছাড়াও বিয়ে, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, মিটিং-মিছিল এমনকি শবদেহ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার সময় ঢাক, ঢোল বাজিয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি বা বেসরকারি স্বীকৃতি মেলেনি । বরং নীচু সম্প্রদায় হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে লাঞ্ছিত হয়েছে । কপালে লাথি ঝাটাও বাদ পড়েনি । সেইসব ব্যথিত অতীত দিনগুলির কথা ভাবলেই তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে । মানসিক অতৃপ্তিতে ভোগে । যার জন্য “খেয়ে না খেয়ে” মেয়েদের শিক্ষার প্রতি শিবু বায়েনের ছিলো শেনদৃষ্টি ।
খেমটি তার বাবার শেখানো ঢোলের বোলগুলি যেমন ঢোল বাজিয়ে তুললো, তেমনি খাতায় লিখে রাখলো । খেমটির এটা চিরাচরিত স্বভাব, ঢাক ও ঢোলের বোল, তাল ইত্যাদি খাতায় যথাযথভাবে লিখে রাখা । কেননা ভবিষ্যতে লেখাটা প্রয়োজন হয়ে যেতে পারে । সকলেই জানে, খেমটির প্রতিভা তুখোড় । যার জন্য বোল, তাল সহজেই সে করায়ত্ব করে নেয় । তাছাড়া বাজনার নতুন নতুন বোল, তাল তোলার ক্ষেত্রে খেমটির সৃষ্টির নেশা অবিসংবাদিত ।
তারপর দুর্গা পূজার আগমনবার্তা ।
মাথার উপরে নীল আকাশ । সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ । পুকুর, জলাশয়ের আশে পাশে এবং খোলা মাঠে সাদা কাশবনের প্রাচুর্যতা । গরমের তীব্রতা ক্ষীণ, হিমেল বাতাসের আগমন । প্রকৃতির অপূর্ব মাধুর্য । আকাশে বাতাসে চতুর্দিকে শরতের বার্তা । শরতের অপরুপ সৌন্দর্যের মধ্যে খেমটির মন উদাস্‌ । উদ্বিগ্নতায় ভরপুর । শরতাকাশের দিকে তাকিয়ে খেমটি পুরোপুরি ভাবনার জগতে নিমজ্জিত । বাবার শারীরিক অবনতির কথা ভেবে তার ভাব-উচ্ছ্বাস, প্রাণচঞ্চলতা নিস্প্রভ ।
ঠিক সেই মুহূর্তে এক গাল হাসি নিয়ে কুহকের হঠাৎ আগমন ! খেমটিকে খোলা আকাশের নীচে উদাস্‌ভাবে বসা অবস্থায় দেখতে পেয়ে তার প্রশ্ন, “তুমি এইভাবে একা বসে কী আজগুবি ভাবছো” ?
আমার ভাবনার শেষ নেই ।
এড়িয়ে যাচ্ছো কেন ? বাইরের প্রকৃতি কতো সৌন্দর্যময় । শরতের সূর্যোজ্জ্বল দিনে প্রকৃতির অপরুপ মাধুর্য । ঝলমলে শরতের রৌদ্র । নীল আকাশে এক ফোঁটা সাদা মেঘের চিহ্ন নেই । অথচ তুমি গম্ভীর মুখে এমনভাবে বসে রয়েছো যেনো তোমাদের বাড়ি ঘর বন্যার জলে ভেসে গেছে ! তাই তুমি অসহায় !
আমাকে দেখামাত্র আবোল-তাবোল কথা শুরু করলে ?
“আয়নায় মুখটা দেখে প্লীজ আমাকে বলো, তোমার বর্তমান স্থিতি কোন্‌ পর্যায়ের !” কুহক আবার একগাল হেসে কথাগুলি বললো ।
ভাবছিলাম……!
কী ভাবছিলে, সেটাই আমি জানতে চাইছি ?
বারো-সতেরো ভাবছিলাম ।
হঠাৎ উদ্ভট ভাবনার অবতারণা কেন, জানালে বাধিত হতাম ?
তোমার কাছে উদ্ভট্‌ ! কিন্তু আমার কাছে সিরিয়াস্‌ ।
“তাহলে তোমার সিরিয়াস্‌ কথাগুলি আমার সঙ্গে শেয়ার করলে, দেখবে তূমি হাল্কাবোধ করবে ।“ কুহক খেমটিকে হাল্কা করার প্রয়াস অব্যাহত রাখলো ।
সব সময় হাসি-ঠাট্টা-মস্করা আমার ভাল লাগে না ।
হাসি-ঠাট্টা নয়, শুধু আমি তোমার বিমর্ষতার হেতু জানার চেষ্টা করছি ?
বাবার হালের শারীরিক স্থিতি তোমার জানা নেই । গরীবের বাড়িতে অনেকদিন পরে এলে । তোমার কোনো খবরও পাচ্ছিলাম না । আমি ভাবছিলাম, গাঁয়ের মোড়ল মশায় অর্থাৎ তোমার বাবা তোমাকে শায়েস্তা করার জন্য ঘরে বন্দী করে রেখেছে । আমি এই মুহূর্তে বাবার শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তিত !
তোমার বাবার কী হয়েছে প্লীজ খুলে বলো ?
প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলায় জ্বর । চৌরিগাছা ডাক্তারের পরামর্শমতো ঔষধ চলছে । তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাবা শীঘ্রই ভাল হয়ে উঠবেন । অথচ ভাল হওয়ার চেয়ে খারাপের দিকেই ঝোঁক । এদিকে দুর্গা পূজায় ঢাক বাজনার বায়না নেওয়া ! বায়না যখন নিয়েছে তখন দুর্গাপূজার সময় টানা পাঁচদিন পূজা প্যান্ডেলে তাকে ঢাক বাজাতে হবে । তাছাড়া প্রত্যেকদিন পূজা প্যান্ডেলে সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি এবং দফায় দফায় নৃত্যানুষ্ঠান এবং সেই নৃত্যানুষ্ঠানে ঢাকের বাজনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সুতরাং দুর্গা পূজায় ঢাক বাজানোর কথা ভেবে বাবার শরীর সত্বর চাঙা হওয়া প্রয়োজন !
“আমি একটা কথা বলবো ?“ কুহক উদগ্রীবভাবে খেমটিকে জিজ্ঞাসা করলো ।
তুমি কী বলতে চাইছো, শোনাও । আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি ।
“সম্ভব হলে আগামীকাল বাবাকে নিয়ে বহরমপুরে চলো । সেখানে নামকরা একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের খবর আমার কাছে আছে । আমার বাবাকেও একবার ঐ ডাক্তার বাবুকে দেখিয়েছিলাম । সেই ডাক্তার বাবুর ঔষধ খেয়ে আমার বাবা সেই সময় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ।“ বহরমপুরের ডাক্তার বাবুর খবর বিশদে জানালো ।
ডাক্তার বাবুর নাম কী ?
ডা. পিযুষ কৈবর্ত ।
কোথায় বসেন ?
বহরমপুর কোর্টের পাশে তাঁর নিজস্ব বাড়ি । বাড়িতেই তিনি রোগী দেখেন ।
বাবার সঙ্গে কথা বলি । আর তাছাড়া …।
আর তাছাড়া কী ?
তুমি তো জানো এই মুহূর্তে সংসারে পয়সার তীব্র সঙ্কট !
“পয়সার ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও । পয়সা নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই । তারজন্য আমি প্রস্তুত ।“ আশ্বাস দিলো কুহক ।
পরেরদিন তিনজনে সকালের ট্রেনে বহরমপুরে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে হাজির । ডাক্তার বাবু তখন চেম্বারের ভিতরে রোগী দেখতে ব্যস্ত । ডাক্তার বাবুর রোগী হিসাবে লিস্টে শিবু বায়েনের নাম লেখালো । খেমটির বাবার নাম তেইশ নম্বরে । ইতিমধ্যে বারোজন রোগী দেখা হয়ে গেছে । পরের রোগী চেম্বারে ঢোকার জন্য দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে । ডাক্তার বাবুর ফি ছয় শত টাকা ।
যে হারে রোগীদের ভিড় এবং চেম্বারের ভিতর রোগীর রোগ দেখতে ডাক্তার বাবুর সময় নেওয়ার ধরন তাতে কুহকের ধারণা, খেমটির বাবার ডাক্তার বাবুকে দেখানোর জন্য চেম্বারে ডাক পড়তে বেলা গড়িয়ে প্রায় দুটো । তাই যে মেয়েটা ডাক্তার বাবুর ব্যক্তিগত সহকারী রোগীদের নাম লিখছে ও চেম্বারে রোগী ঢোকার জন্য ডাকাডাকি করছে, তাকে কুহক অনুরোধ করলো খেমটির বাবাকে তাড়াতাড়ি ডাক্তার বাবুকে দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য । কেননা তারা অনেক দূর থেকে এসেছে এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা তেমন ভাল না । অনুরোধে কাজ হোলো । ঠিক ঘন্টা খানেকের মাথায় ডাক্তার বাবুর সহকারী ডাক দিলো, “এর পরের রোগী শিবু বায়েন ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকবে ।“
শিবু বায়েন হাত তুললো ।
মেয়েটি শিবু বায়েনের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি দরজার কাছে দাঁড়ান । ভিতরে যে রোগী গেছেন তিনি বের হলেই আপনি ঢুকবেন ।“
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে শিবু বায়েন দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ।
মিনিট পাঁচেক পর ভিতরের রোগী বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তিনজন একত্রে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে ঢুকলো ।
টেবিলের উপর শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার বাবু কিছু সময় ধরে শিবু বায়েনকে দেখেই তিনি বললেন, “ আপনার শরীরের হাল ভীষণ খারাপ” । তারপর তার শারীরিক বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিলেন । শিবু বায়েন ছাড়াও খেমটির কাছে রোগীর খবরাখবর জিজ্ঞাসা করলেন । ডাক্তার বাবুকে সহযোগিতা করার জন্য পাশে বসা একজন সহকারী মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাদের কথোপকথন কম্পিউটারে রেকর্ড করলেন । প্রায় আধ ঘন্টা । ডাক্তার বাবু নিজেও তাঁর কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নিলেন । তারপর ডাক্তার বাবু তার আগের সমস্ত রিপোর্টগুলি মনোযোগ সহকারে দেখলেন । তারপর শিবু বায়েনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার আপনি টেবিলের উপর আবার শুয়ে পড়ুন ।“ তিনি পাশের উচু টেবিল দেখিয়ে শুতে বললেন । ডাক্তার বাবু পেটে হাত চেপে অনেকক্ষণ দেখলেন । পিঠে, বুকে, স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে হৃদস্পন্দন, শ্বাসধ্বনি বা আনুসঙ্গিক উপসর্গ বোঝার চেষ্টা করলেন । স্টেথোস্কোপ ঘাড়ের ঠিক নীচে পিঠে লাগিয়ে শিবু বায়েনকে বললেন, জোরে জোরে শ্বাস নিতে । এইভাবে অনেকক্ষণ চললো ডাক্তার বাবুর পরীক্ষা নীরিক্ষা । তারপর শিবু বায়েনকে বললেন, “এবার উঠে চেয়ারে বসুন ।“ কুহক উঠে গিয়ে খেমটির বাবার হাত ধরে টেবিল থেকে নামিয়ে চেয়ারে বসালো । এবার তাদের দৃষ্টি ডাক্তার বাবুর প্রেসক্রিপশন লেখার দিকে ।
প্রেসক্রিপশন কিছুটা লেখার পর ডাক্তার বাবু চোখ তুলে খেমটির দিকে তাকালেন এবং বললেন, “বাবার অসুখ খুব ক্রিটিক্যাল । ভয়ংকর রোগ বাধিয়েছেন । তারপর কুহকের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি রোগীর কে হন ?”
শিবু বায়েন কিযেনো বলতে যাচ্ছিলো, কুহক তাকে থামিয়ে দিয়ে ডাক্তার বাবুকে বললো, “আমি তার ভাবী জামাই ।“
“ভেরী গুড । তাহলে আপনার স্কন্ধে দায়িত্ব বেশী ।“ ডাক্তার বাবু হেসে হেসে কুহককে বললেন ।
“কী রকম স্যার ?” কৌতুহলি দৃষ্টিতে কুহক ডাক্তার বাবুর দিকে তাকালো ।
ডাক্তার বাবু খেমটিকে বললেন, “বাবাকে বাইরে বসিয়ে রেখে আপনি ভিতরে আসুন ।“
বাবাকে বাইরে বসিয়ে রেখে খেমটি পুনরায় ডাক্তার বাবুর চেম্বারে ঢুকে উদগ্রীবভাবে ডাক্তার বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “ডাক্তার বাবু, বাবার কোনো খারাপ কিছু ?”
“আমি অনুমান করছি, আপনার বাবার শরীরে ক্যানসার রোগ । সেটা লিভারের পাশে । কয়েকটা পরীক্ষা দিলাম । এই মুহূর্তে তিনি সুস্থ । এখন ঐ ক্যানসার রোগটি আপনার বাবার শরীরে চুপিসারে লুকিয়ে রয়েছে, আপনার বাবাকে সেভাবে আক্রমন করতে পারেনি । পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেলে আমার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হবে । সামনে পূজো । তাই পূজোটা যাক । পূজোর ঠিক পরে পরেই পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে পুনরায় আসুন । তখন সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যাবে । তবে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন, আপনার বাবার ক্যানসারের চিকিৎসা সত্বর শুরু করতে হবে । নতুবা তার জীবন মরণ সমস্যা ! এই মুহূর্তে মাত্র দুটো ঔষধ দিলাম । সকাল ও রাত্রিতে খাওয়ার পরে । ভয়ের কারণ নেই । এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত । সুতরাং আপনার বাবা ভাল চিকিৎসা পেলে অচিরেই ভাল হয়ে উঠবেন ।
কুহক কৌতুহলি দৃষ্টিতে ডাক্তার বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো, “ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য কোন্‌ হাসপাতালে ভর্তি করাটা যুক্তিযুক্ত ।“
দেখুন প্রাইভেট হাসপাতাল রয়েছে । টাটাদের একটা হাসপাতালে কলকাতায় ক্যানসার চিকিৎসা চলছে । তবে আমার মতে, ঠাকুরপুকুরের সরকারি ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি করাটা যুক্তিযুক্ত ।“
খেমটি ডাক্তার বাবুর কাছে জানতে চাইলো, “বাবা দুর্গা পূজোতে ঢাক বাজাতে পারবেন কিনা” ?
“নিশ্চয় পারবেন । এমনকি স্বাভাবিক জীবন যাপন করবেন । তাকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না, তিনি শরীরে একটা ভয়ংকর রোগ বহন করছেন । সুতরাং স্বাভাবিক জীবন যাপনে আপনারা তাকে উৎসাহ দেবেন ।“ ডাক্তার বাবু আবার দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেস্ট অফ লাক্‌ । পূজার পরে আবার আমাদের দেখা হচ্ছে ।“
চেম্বার থেকে বেরিয়ে দুজনেই নীরব । বিষন্নতায় ভরপুর ।
খেমটি শিবু বায়েনকে বললো, “রোগটা তেমন কিছু নয় । মাত্র দুটো ঔষধ দিয়েছেন । তুমি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে । এমনকি পূজোতে মনের সুখে ঢাক বাজাতে পারবে” ।
শিবু বায়েন তখন হেসে বললো, “বাড়িতেই আমি বলেছিলাম আমার কিচ্ছু হয়নি । প্রেসার নেই, সুগার নেই । আমি সম্পূর্ণ সুস্থ । তোরাই জোর করে আমাকে বহরমপুরে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে এলি । এবার আমার কথা তোদের বিশ্বাস হোলো তো । ডাক্তার দেখাতে কতোগুলি টাকার অপচয় ?”
খেমটি বাবার কথা শুনে তাৎপর্যপূর্ণ এক ঝলক হাসি দিলো মাত্র ।
তারপর কুহক বহরমপুর থেকে বাড়ি ফিরে তার মায়ের কাছে শোনে তার বাবা শিবদাস মোড়ল রেগে আগুন ! গাঁয়ের সনাতন মাস্টার পুনরায় তাঁর ল্যাবটব সঙ্গে নিয়ে এসে অনল ও খেমটির ঢাক বাজানোর ভিডিওটা তোর বাবাকে দেখিয়েছেন । সেই সময় মুখে বলেছিলেন, এখন চাক্ষুষ দেখানোতে তিনি তোর উপরে চটে অগ্নিশর্মা । কুহকের মা আরও বললেন, “তোর বাবা সম্ভবত সনাতন মাস্টারের বাড়ি গেছেন । তিনি বাড়ি ফিরলে বাড়িতে নির্ঘাত একটা দক্ষযজ্ঞ বাধাবেন” ?
কেন মা ? খেমটি সকল মানুষের সামনে সন্ধ্যাপূজা চলাকালীন ঢাক বাজিয়েছে ! এতে রেগে যাওয়ার কী আছে, সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না ।
কুহকের মা আরও বললেন, “অনলকে দেখেই তোর বাবার বেশী রাগ ! তাঁর ধারণা, অনলের মতো অনেক ছেলের সাথে খেমটির ওঠাবসা । তাদের সাথে বন্ধুত্ব । সুতরাং খেমটির স্বভাব চরিত্র সন্দেহজনক” !
কিসব আজে বাজে চিন্তা ! অনল দেখতে ভাল । হৃষ্টপুষ্ট চেহারা । ওরা সমবয়সী । এক কলেজে পড়েছে । তাই বলে খেমটির স্বভাব খারাপ ?
কুহকের মা বাড়ির কাজে অন্যত্র ছুটলেন ।
হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে কুহক সবেমাত্র নিজের ঘরে বসেছে, ঠিক ঐ সময় তার বাবা শিবদাস মোড়ল বাড়ি ঢুকে কুহকের উপস্থিতি বুঝতে পেরে প্রচন্ড লম্ফঝম্ফ ! তাঁর গর্জনের আস্ফালন !
কুহকের মায়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন, “তোমার নবাব পুত্রকে বলে দাও খেমটির মতো একটা কুলাঙ্গার মেয়ের সাথে সে যেনো আর না মেশে । তার সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কোনো সম্পর্ক রাখা চলবে না । চারিদিকে ছি ছি পড়ে গেছে । ঢাক নিয়ে বেপাড়ার ছেলের সাথে কোমর দুলিয়ে হেলেদুলে বিশ্রি বেঢপ নাচ ! সুস্থ সংস্কৃতির দফারফা । খেমটি নাকি শিক্ষিত । এইসব নোংরামী কী শিক্ষিত মেয়ের নমুনা ? নিজের গাঁয়ের ছেলে নয়, এমনকি পাড়ার কেউ না । অথচ বেপাড়ার উটকো মরদ যুবকের সাথে ঢলাঢলি । অভব্যতার চূড়ান্ত । সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল । বেহেল্লাপনার ভিডিও এখন ঘরে ঘরে । তোমার নবাব পুত্রের আবার সেই মেয়ের সাথে ভাব ভালবাসা । তার সঙ্গে গাটছড়াঁ বাঁধার তোড়জোড় । ঐ মেয়ের অসভ্য নৃত্যের কথা ভাবতেই আমার গা ছমছম ! কী যুগে আমরা বাস করছি । সমাজের সংস্কৃতি ঐসব ছেলেমেয়েদের জন্য আজ রসাতলে ?”
কুহকের মা ঘর থেকে বের হয়ে এসে শিবদাস মোড়লকে বললেন, “খুব তেজ দেখিয়েছো । এবার দয়া করে ঘরে চলো । তোমার চা বানাচ্ছি” !
“রাখো তোমার চা ! গরম চা তোমার গুণধর পুত্রকে খাওয়াও, তাতে যদি তোমার পুত্রের মতিগতির পরিবর্তন হয় ।“ মোড়ল মশায়ের তখনও তেজ সমানে উজ্জীবিত ।
কুহক তার ঘরে আর নীরবে বসে থাকতে পারলো না । খেমটিই তাকে শিখিয়েছে, ন্যায্য কথাটা সহজভাবে বলাটাই সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ । তোমার বাবা আমার প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতেই পারেন । তাঁদের একমাত্র সন্তান তুমি । তোমাকে নিয়ে তাঁদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা অনেক । এটাই স্বাভাবিক । সেই ক্ষেত্রে তোমাকে ঠান্ডা মাথায় শান্তভাবে বাবাকে বোঝাতে হবে, “তুমি খেমটিকে ভালবাসো” । ভালবাসাটা প্রত্যেক মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি । জীবনের নিজস্ব ছন্দের, নিজস্ব গতির প্রতিফলন । এতে অন্যায় কিছু নেই । সহজ কথাটা খুব সহজভাবে বলবে, তাতে তোমার বাবা রাগ করলে সেই মুহূর্তে তুমি সম্পূর্ণভাবে চুপচাপ থাকবে । পরবর্তী সময়ে তিনি নিশ্চয় উপলব্ধি করবেন, কুহক খেমটিকে খুব ভালবাসে । এটা তুমি মনে রাখবে, আইনের চোখে তুমি সাবালক । জীবনের ভাল-মন্দ সিদ্ধান্ত নেওয়ার তোমার অধিকার রয়েছে । সুতরাং কোনো কিছুতে ডরাবে না । শুধুমাত্র তোমাকে নিশ্চিত থাকতে হবে, “তুমি কোনো অন্যায় করছো কিনা ?” আর তাছাড়া খেমটি বারংবার স্পষ্ট করে একটা কথা বলেছে, “তোমার বাবা মায়ের অনুমতি নিয়েই সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে । নচেত নয় ।“ বাবা মাকে আঘাত দিয়ে কোনো শুভ কাজে সফল হওয়া যায় না । সুতরাং মনে রাখবে, “বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়েই পরবর্তী চিন্তাভাবনা, গাটছড়াঁ বাঁধা” ।
সরাসরি বাবার সামনে গিয়ে কুহক স্পষ্ট গলায় বললো, “তুমি এভাবে খেমটিকে অপমান করছো কেন বাবা ?”
এটা অপমান কিসের ? সে যেটা করেছে, সেটাই আমি বলেছি ।
তোমার ভাষাটা রুচিপূর্ণ নয় । তুমি ভালভাবেই জানো, আমি খেমটিকে ভীষণ ভালবাসি ।
আবার ভালবাসার কথা আমার সামনে । তোর ঐ ভালবাসা-বাসি আমার অসহ্য ! খেমটির সাথে মেলামেশা এবার বন্ধ কর্‌ । নতুবা ………।
নতুবা কী বাবা ?
“নতুবা আমাকেই ব্যবস্থা নিতে হবে । ব্রাম্মণের ঘরে কিছুতেই বেজাতের, নীচু জাতের অভব্য মেয়ের স্থান নেই ।“ চোখ গরম করে ধমকের সুরে কুহককে কথাগুলি বলে তিনি পুনরায় সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
কুহক এবারে ষোলোআনা নিশ্চিত, তার বাবা কিছুতেই তাদের গাঁটছড়াঁ বাধার সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন না । প্রতি কথায় খেমটিকে জাত তুলে কথা শোনান । তার শিক্ষাগত মর্যাদার কথা, ঢাক-ঢোল শিল্পকলার কথা কখনই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না । সব সময় তার বাবার ভিতরে ব্রাম্মণ হিসাবে অহংবোধ । অথচ বাবার ক্রোধ কিভাবে শান্ত হবে সেই ভাষা কুহকের জানা নেই ।
মা এগিয়ে এসে কুহককে বললো, “তুই বাবার উপর রাগ করিস্‌ না । ধীরে ধীরে তিনি স্বাভাবিক মতিগতিতে ফিরে আসবেন” ।
“সেই লক্ষণ নেই মা । আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না । সর্বক্ষণ খেমটি ও তার বাবার উপর অকারণে আস্ফালন” ! কুহক আক্ষেপের সুরে তার মাকে বললো ।
মা আর কথা বাড়ালেন না । ছেলেকে নিয়ে ভিতরের ঘরে ঢুকলেন । ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য বানানো নারিকেলের নাড়ুর বয়ম, খেমটির জন্য কুহকের হাতে তুলে দিলেন । মেয়েটার নারিকেলের নাড়ু ভীষণ পছন্দ । নাড়ু পেলে তার মুখে হাসি ফুটবেই । তুই বরং নাড়ুটা খেমটিকে দিয়ে আয় । খেমটির সঙ্গে কথাবার্তা বললে বা তার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করলে তোর দুশ্চিন্তা খানিকটা স্বাভাবিক হবে ।
বিগলিত হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কুহক বললো, “তোমার সব দিকেই খেয়াল । তুমি আমার কাছে সাক্ষাৎ দেবী” ।
তারপর ভরা সন্ধ্যাবেলায় সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল । উদ্দেশ্য খেমটিদের বাড়ি । মা লুকিয়ে খেমটির জন্য একটা সুন্দর শাড়ি কিনেছেন, পূজোতে পরবার জন্য । সেই শাড়িটা ও এক বয়ম নাড়ুর সঙ্গে নিয়ে খোশমেজাজে কুহক চললো খেমটিদের বাড়ি ।
পৌঁছে দেখে খেমটি বাড়ি নেই । হাটে গেছে । ঘোড়াডাঙা প্রাইমারী স্কুল মাঠে সপ্তাহে একদিন হাট বসে । হাটে সংসারের দৈনন্দিন জিনিসপত্র সমস্তকিছু পাওয়া যায় । বাড়িতে বাজার কিছুই ছিলো না, তাই বড় ব্যাগটা নিয়ে তার হাটে যাওয়া ।
খেমটির মা এসে কুহককে বললো,”তুমি খেমটির ঘরে গিয়ে বসো বাবা । আমি তোমার জন্য কফি বানিয়ে আনছি ।“
“কাকাবাবু কী কফি এখন খাবেন না ?” জিজ্ঞাসা করলো কুহক ।
হ্যাঁ । তোমরা দুজনে কফি খেতে খেতে গল্প করো । ততক্ষণে খেমটি হাট থেকে ফিরে আসবে । গুচ্ছের বাজার করতে তার হাটে যাওয়া ।
মাথা নেড়ে খেমটির মায়ের কথার সম্মতি জানালো কুহক ।
কুহক খেমটির মুখে শুনেছে, তার মা বড় বংশের মেয়ে । খেমটির মায়ের বাবা ছিলেন তদানীন্তন কালের পুলিশ অফিসার । দাদা একজন ইঞ্জিনিয়ার, উচ্চ সরকারি পদে কর্মরত । খেমটির বাবা দেখতে সুপুরুষ ছিলেন । পুলিশ অফিসার হিসাবে নামডাক ছিলো । খেমটির মা যখন স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ছিলো, তখন ঐ সময় তার বাবা শিবু বায়েন একই ক্লাসে পড়ছিলো । খেমটির মা জানতেন, শিবু বায়েন নীচু ঘরের সন্তান । ঢাক বাজানো তাদের পারিবারিক পেশা । অন্যদিকে শিবু বায়েন পড়াশোনার বাইরে তার বাবার কাছে ঢাক ও ঢোল বাজানো শিখতো । খেমটির মা যেহেতু শিবু বায়েনকে ভালবেসেছে, সেইজন্য তাদের সম্পর্কের কথা তার মা সরাসরি বাড়িতে জানিয়ে দিয়ে বলেছিলো, “সে শিবু বায়েনকে ভালবাসে এবং শিবু বায়েনকেই বিয়ে করবে” । কিন্তু কিছুতেই মেনে নেননি খেমটির মায়ের বাবা । তখন ঐ বয়সেই স্কুল থেকে পালিয়ে দুজনে মা-কালির মন্দিরে গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে । সেই থেকে সুখে দুঃখে, সংসারের উত্থান-পতনে দুজনে একসঙ্গে । দুজনের মেলবন্ধন আজও দৃঢ় অটুট । খেমটির মা চেয়েছে, মেয়ে দুটিকে মানুষ করতে আর শিবু বায়েন চেয়েছে মেয়ে দুটিকে স্বাবলম্বন করতে । যার জন্য লেখা পড়ার পাশাপাশি বড় মেয়ে দর্জির কাজে দক্ষ এবং ছোট মেয়ে ঢাক ঢোল বাজনার শিল্প কলায় পারদর্শী । মনের দিক থেকে খেমটির বাবা-মা মেয়েদের নিয়ে সুখী ।
“কতোক্ষণ ?” কুহককে দেখা মাত্র প্রশ্ন করলো খেমটি ।
প্রায় আধ ঘন্টা ।
এক মিনিট বসো । বাজার রেখে আসছি ।
খেমটিকে ভালবেসে কুহক মনের দিক থেকে ভীষণ উৎফুল্ল । কেননা খেমটির নিজস্বতা কুহকের ভাল লাগে । সোজা কথা সোজাভাবে বলতে সে অভ্যস্ত । তার কর্মঠ শরীর, সেখানে অলসতার স্থান নেই । সর্বক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখে । তার স্যাররা জানেন খেমটি কথা দিয়ে কথা রাখে । তার পরিশ্রমের প্রতি তাঁদের ভীষণ আস্থা । গবেষণার জন্য সে এখন নিজেকে তৈরী করছে । কিন্তু এই মুহূর্তে তার মাথায় বিশাল চিন্তা, বাবার দুরারোগ্য অসুখ । ক্যানসার । টাকা নেই, পয়সা নেই অথচ বাবার জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন ।এই চিন্তাটাই খেমটিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে । যদিও সে জানে তার পাশে কুহক সর্বক্ষণ । তবুও সে বাবাকে নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন । উৎকুন্ঠায় নিমজ্জিত ।
“চা খেয়েছো ?” খেমটি কুহককে জিজ্ঞাসা করলো ।
চা নয়, কফি খেয়েছি ।
“খুব ভাল । কিন্তু তোমার বাবার বকুনি খেয়েছো শুনলাম ।“ আন্দাজে ঢিল ছুড়ে দিলো খেমটি । অসময়ে আগমনের হেতু জানার জন্য ।
হ্যাঁ খেয়েছি ।
সেটা আমি আন্দাজ করেছি ।
কিভাবে আন্দাজ করলে ?
বাবার বকুনি খেয়েছো বলেই তো অসময়ে তোমার দর্শন ! নতুবা ভরা সন্ধ্যার অন্ধকারে এই চত্বরে তোমার আগমন নৈব-নৈব-চ ।
নাড়ুর বয়মটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “মা পাঠিয়েছেন ।“
আর বা-হাতে ব্যাগটা কিসের ?
“এটাও মা পাঠিয়েছেন ।“ শাড়িটা খেমটির হাতে ধরিয়ে দিলো ।
শাড়ি ও নাড়ু, দুটোই খেমটির প্রিয় । ছুটে ভিতরে গিয়ে শাড়িটা পরলো খেমটি । বিজলি বাতির আলোয় শাড়ি পরিহিত অবস্থায় খেমটি নিজে নিজেকে চিনতে পারছে না । এরপর শাড়ি পরিহিত অবস্থায় কুহকের সম্মুখে উদয় হোলো খেমটি । কুহক একবার খেমটির দিকে তাকিয়েই মুখে এক ঝলক হাসি দিয়ে বলে উঠলো, “অপূর্ব ! ভীষণ সুন্দর” । মোবাইলে শাড়ি পরা খেমটির ছবি তুললো কুহক । খেমটির চেহারায় একটা মনকাড়া মাদকতা । তেমনি তার লক্ষ্মীশ্রী মুখটা । অন্যদিকে যেমনি উচু লম্বা তেমনি তার শারীরিক গঠন । বায়েন পরিবারে জন্ম না হয়ে কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরে জন্মালে খেমটির সৌন্দর্য আচ্ছা আচ্ছা পুরুষ মানুষের নজর কাড়তো ।
তারপর পুনরায় এক গ্লাস টক দই’এর সরবত খেয়ে বাড়ি ফিরলো কুহক ।
তারপর ………।
তারপর রাত পোহালেই মহাপঞ্চমী ।
আকন্দপুরের সার্বজনীন দুর্গাপূজা মন্ডপে শিবু বায়েন ঢাক বাজাবে । পূজার বিশাল তোড়জোড় । পূজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দিপনা তুঙ্গে । ইতিমধ্যে আকন্দপুরের পূজা কমিটির কতৃপক্ষ টেলিফোন করে শিবু বায়েনকে জানিয়েছেন, ষষ্টির দিন সকালে ঢাক নিয়ে পূজা মন্ডপে পৌঁছে যেতে । এবছর নিয়ে শিবু বায়েনের তৃতীয়বার হবে আকন্দপুরের সার্বজনীন দুর্গাপূজায় ঢাক বাজানো । তাঁদের সমস্ত ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, কিন্তু ঢাকির রাত্রিতে থাকার ব্যবস্থাটা বড্ড দৃষ্টিকটু । মা দুর্গার মন্ডপের একপাশে তাকে শুয়ে থাকতে হয় । যেমনি মশার কামড়, তেমনি ফাঁকা জায়গার কারণে কন্‌কনে ঠান্ডা হাওয়া । থাকার জায়গার অবস্থার কথা ভেবে প্রতিবার শিবু বায়েন সঙ্গে কম্বল রাখে ।
প্রতিবারের মতো এবারও শিবু বায়েন আকন্দপুরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় মশারি ও কম্বল সঙ্গে নিলো । তারপর মহাষষ্টির দিন সকাল সকাল ঢাক কাঁধে আকন্দপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো শিবু বায়েন । অনেকটা পথ । রাস্তার অবস্থা তথৈবচ । ঢাক কাঁধে নিয়ে পায়ে হেঁটে শিবু বায়েনের পক্ষে আকন্দপুর যাওয়া অসম্ভব । তাই খেমটি ভ্যান রিক্সা ডাকতে ছুটলো । অন্যদিকে খেমটি বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ঠিকমতো ঔষধ খেতে । আর কোনোরকম শারীরিক অসুবিধা বুঝলে তাকে সত্বর জানাতে ।
কৃষি এলাকায় ভ্যান রিক্সার প্রাদুর্ভাব কম । ফসল কাটার সময় ভ্যান রিক্সার কদর বেশী । সেই সময় চাষি মানুষের গরুর গাড়ির চেয়ে ভ্যান রিক্সার ব্যবহার বেশী । অন্যান্য মরশুমে ভ্যান রিক্সার ব্যবহার গাঁয়ের মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রে তুলনামূলকবভাবে কম । কেননা তারা পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে যাতায়াতে বেশী স্বচ্ছন্দ । খেমটি অতীব কষ্টে ইঞ্জিন লাগানো একটা ভটভটি ভ্যান রিক্সা জোগাড় করলো । ভ্যানের এক পাশে ঢাকটা নামিয়ে রেখে অন্যপাশে শিবু বায়েন বসলো । সঙ্গে একটা বড় পুটুলি । ঐ পুটুলিতে গামছা, এক সেট অতিরিক্ত জামা কাপড়, কম্বল, মশারি, গায়ে মাখা সাবান, দাঁত মাজার ব্রাস ও মাজন, ছোট একটা বোরোলিন, ইত্যাদি । টানা পাঁচ দিনের প্রোগ্রাম । ঠাকুর বিসর্জনের দশমীর পরের দিন দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঢাক বাজিয়ে তবেই তার ছুটি । তার জন্য পুটুলিতে এতসব সরঞ্জাম ।
“তোরা সাবধানে থাকিস্‌ ।“ খেমটির দিকে তাকিয়ে শিবু বায়েন বললো । অদূরে খেমটির মা করুণ দৃষ্টিতে শিবু বায়েনের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে !
ভ্যানরিক্সাওয়ালা ভ্যানে উঠে যখন ভ্যান চালাতে শুরু করবে ঠিক তখন দূর থেকে কুহক চিল্লাচ্ছে, “কাকাবাবু একটু দাঁড়ান । আমি এসে গেছি” ।
খেমটি কুহকের উপর রেগে গিয়ে ধমকের সুরে বললো, “দিলে তো বাবার যাত্রাটা মাটি করে ? বেআক্কেলের মতো বাবাকে পেছন ডাকলে ?”
“তোমাকে আগেই বলেছি, অহেতুক কুসংস্কারের প্রতি ঝুঁকবে না “। কুহক চোখ বড় বড় করে খেমটিকে বললো ।
পেছনে ডাকাটা কুসংস্কার, তুমি সেটা কী করে বুঝলে ?
আলবৎ কুসংস্কার !
দুজনের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে শিবু বায়েন কুহকের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি ওদের একটু খেয়াল রেখো বাবা ।“
সেটা আমি রাখবো । আর একদিন ………।
“আর একদিন” কী বাবা ?
আর একদিন আমি ও খেমটি আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবো । আর তাছাড়া শারীরিক অসুবিধা বুঝলে অবশ্যই আমাদের খবর দেবেন । কোনোরকম শারীরিক অসুবিধা চেপে রাখবেন না । আমরা কিন্তু আপনার চিন্তায় রইলাম ।
মাথা নেড়ে কুহকের কথায় সায় দিলো শিবু বায়েন ।
তারপর । তারপর ভূপতি জানিয়ে দিলো, সে এই বছর নিজের গাঁয়ের সার্বজনীন দুর্গা পূজার দায়িত্বে থাকার কারণে ঘোড়াডাঙা বায়েন পাড়ায় শ্বশুর বাড়িতে পূজোর সময় থাকতে পারবে না । তনিমাও ভূপতির সঙ্গে গাঁয়ের পূজোতে দিনগুলি কাটাতে চায় । ইতিমধ্যে বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে কুহক জেনেছে, ভূপতি ও তনিমাদের দাম্পত্য জীবন মধুরভাবে কাট্‌ছে । তাছাড়া ভূপতি তাদের বাড়ির জায়গায় রাস্তা ঘেঁষে একটা দোকান ঘর তৈরী করেছে তনিমার দর্জির ব্যবসার জন্য । তনিমা নাকি সেখানে লেডিস্‌ টেলারিং খুলবে । কুহকের কাছে তনিমার টেলারিং দোকান খোলার খবর পেয়ে কাকীমা খুব খুশী । তার বড় মেয়ে অন্তত স্বাধীনভাবে উপার্জন করে সংসারের কাজে লাগাতে পারবে । আজকের দিনে যেটা খুব দরকার । নিজস্ব উপার্জনের বন্দোবস্থ থাকলে মেয়ের নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস দড়ো হবে । এমনকি তাদের সংসারেরও আর্থিক দিক দিয়ে শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে । কুহকের মুখে বড় মেয়ের দৈনন্দিন জীবনের কড়চা শুনে খেমটির মা ভীষণভাবে আহ্লাদিত ।
ইতিমধ্যে কুহক কাউকে না জানিয়ে খেমটি ও তার মাকে দুর্গাপূজার কটা দিন পরবার জন্য সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছে । অন্যদিকে খেমটি অনেক কষ্টে কুহকের জন্য এক সেট সাফারি বানিয়েছে । শাড়ি পেয়ে কাকীমা ও খেমটি যেমন আনন্দিত তেমনি সাফারি সেট পেয়ে কুহকও খুশীতে ভরপুর ।
বায়েন পাড়ার প্রত্যেকের বাড়িতেই ঢাক । তাই বায়েন পাড়ার মানুষ দুর্গা পূজোর সময় কোথাও না কোথাও ঢাক বাজাতে ছোটে । যার জন্য ঘোড়াডাঙার বায়েন পাড়া পূজোর সময় প্রায় ফাঁকা । প্রত্যেক ঘরের মরদেরা দুর্গা পূজার সময় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছোটে উপার্জনের তাগিদে । এবারও তার ব্যতিক্রম নয় । কয়েকজন জেলা ছেড়ে বেশী আয়ের উদ্দেশ্যে ভিন্ন জেলায় পাড়ি দেয় । ফলে পূজোর কয়েকটা দিন গোটা বায়েন পাড়ায় বৌ-ঝি ও তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরে থাকে । ঢাকিদের অনেকেই তাদের ছোট ছোট ছেলে বা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যায় ঢাকের সাথে কাসি বাজানোর জন্য । অবশিষ্ট মানুষেরা সাধারণত দুর্গা পূজা দেখতে ঘোড়াডাঙা সার্বজনীন পূজা মন্ডপে ভিড় করে । ঘোড়াডাঙা গ্রামটি বড় হওয়ার সুবাদে দুর্গা পূজার আয়োজন বিশালাকার । জাকজমক পূজা । পূজোর মাঠে মেলা বসে । ঠাকুর দর্শনে অনেক মানুষের সমাগম । খেমটি পূজোর কটাদিন বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সময় কাটায় । কিন্তু কুহক তার জীবনের আসার পর পূজোর রূটিন তার পালটে গেছে । গতবছর বহরমপুরে ঠাকুর দেখতে বের হয়েছিলো । কিন্তু এবছর পূজোয় ঘোরার সমস্ত পরিকল্পনা বাতিল । খেমটির কান খাড়া তার বাবার জন্য । বাবার শারীরিক অবনতির জন্য তার মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত । যতোটুকু সে বুঝেছে, তাতে তার ধারণা বাবার পৃথিবী থেকে বিদায়ের সময় আসন্ন । বাবার মারণ রোগ ক্যানসার নিয়ে সে যতো ভাবে ততোই তার মন বিষন্নতায় ভরে উঠে । চোখের জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ে । তার একটাই সান্ত্বনা, তার বিপদের দিনে পাশে সর্বক্ষণ কুহক ।
অথচ কুহককে নিয়েও তার চিন্তা অহরহ । শিবদাস মোড়ল খেমটিকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য বেশী মাত্রায় সক্রিয় । নানানভাবে খেমটি খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছে, কুহকের বাবার মাথাটা গাঁয়ের সনাতন মাস্টার চিবিয়ে খাচ্ছেন । সারাক্ষণ মোড়ল মশায়ের মাথায় ঢুকিয়ে যাচ্ছেন, “নীচু জাতের মেয়েকে ঘরে তোলা ব্রাম্মণ সমাজের মানুষের কাছে একটা গর্হিত অপরাধ ! আগেকার দিনে চামার মুচিদের সাথে কোনো ব্রাম্মণের ছোঁয়া লাগলে সেই ব্রাম্মণকে গঙ্গায় স্নান করে নিজেকে শুদ্ধিকরণ করতে হতো । সনাতনবাবুর মতে, সেসব ঘটনা বেশীদিন আগেকার নয় । সেই নিম্ন বর্গের মেয়েকে আপনার ছেলে বিয়ে করতে চায় । তাহলে বুঝতে পারছেন, আপনার ছেলের কতো বড় আস্পর্ধা ! এখনই কড়া হাতে এর বিহিত না করলে আখেরে আপনাকে ভীষণ ভাবে “ছেলের ঐ মুচির মেয়েকে বিয়ে” করার জন্য ফল ভোগ করতে হবে । এমনকি গোটা ব্রাম্মণ সমাজ আপনাকে “একঘরে” করে রাখতে পারেন ।
সনাতনবাবুর উস্কানীর জন্য মোড়ল মশায় আরও বেশী খেমটির প্রতি আক্রমণাত্মক । তিনি যদি কুহককে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করেন, তাহলে তাদের জীবনে সমূহ বিপদ ! অর্থ সঙ্কটে নাজেহাল হতে হবে । গভীর অর্থ সঙ্কটের মধ্যে তারা ঢুকে পড়বে । তবুও ঘাবড়ে যাওয়ার মেয়ে খেমটি নয় । ভাল সময় হোক বা মন্দ সময়, এমনকি খুব খারাপ সময় মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে খেমটি । এইটাই তার চলমান জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
কুহকের বাবাকে নিয়ে টেনশনের অন্ত নেই । কুহক সরল সাদামাটা । কিছুটা গোবেচারা ধরনের । মায়ের নেওটা । মায়ের আদরে তার বড় হওয়া । কুহকের কাছে তার মা দেবীর মতো । মায়ের আশীর্বাদ থাকার জন্য পয়সার অভাব কুহক কোনো দিন অনুভব করেনি । আরও একটা জিনিস কুহকের জীবনে লক্ষ্য করছে খেমটি, মায়ের শিক্ষার তীব্র ক্ষুরধার থাকার দরুন কুহকের নৈতিক জীবন বরিষ্ঠ ও স্বচ্ছ । একটা ভদ্রলোকের যতোগুলি গুণাবলি থাকা উচিৎ, সব কটি কুহকের মধ্যে রয়েছে । সে যতোটা সম্ভব ঝগড়াঝাটি এড়িয়ে চলে । তবে তার রাগটা বেশী । জেদও ষোলোআনা । কুহকের এহেন ভদ্রতার কারণে মোড়ল মশায় তাকে ভড়কাতে সিদ্ধহস্ত । পাশে তার মা বিশেষ করে খেমটি না থাকলে তাদের মিষ্টিমধুর ভালবাসার সম্পর্ক মোড়ল মশায় ভেঙ্গেই ছাড়তো ।
খেমটির টেনশন আরও একটা কারণে । গাঁয়ের অন্যান্য গোঁড়া বামুনদের উস্কানিতে মোড়ল মশায় তাদের ক্ষতি না করলেই মঙ্গল । ইতিমধ্যে খেমটির কানে এসেছে, খেমটি তার জীবন থেকে কুহককে না ছাড়লে মোড়ল মশায় তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবেন । নতুবা গ্রাম থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাঁর রাগের জ্বালা মেটাবেন । আবার খেমটি নিজেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ভাবছে এটা তার ভ্রান্ত ধারণা । কল্পনার খুঁটিনাটি । অবাস্তব চিন্তা । তাই তার বিশ্বাস, বাস্তবে মোড়ল মশায়ের হৃদয়ে চৈতন্যের উদ্রেক ঘটবে এবং খেমটিকে ছেলের বৌ হিসাবে মেনে নেবেন । সেদিন হবে তার দুশ্চিন্তার অবসান ।
(  চলবে )