সচল জগন্নাথের অত্যদ্ভুত লীলা : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
759

শ্রীরামদাস নামে দ্রাবিড় দেশবাসী এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি বহু কষ্টে দিন যাপন করতেন। দিনের পর দিন অন্ন না জোটায় অস্থি-চর্মসার দেহ হয়েছিল তাঁর। অনাহারে ক্লীষ্ট শীর্ণ শরীর যাকে বলে আর কী! একদিন তিনি মনে মনে ভাবলেন – “আমি পূর্ব জন্মে নিশ্চয়ই বহু পাপ করেছি। সেই পাপেরই সংস্কার বশে এত কষ্ট আমার, এত নির্যাতন! এসব পাপের প্রারদ্ধ ভিন্ন অন্য কিছু নয়! তবে শুনেছি ভগবান কলিযুগে নাকি দারুব্রহ্ম জগন্নাথ রূপে বিরাজ করছেন নীলাচলে। আচ্ছা, যদি পতিতপাবন জগন্নাথের দর্শন করে তাঁকে মনের কথা, আমার দুর্ভাগ্যের কথা জানাই তবে নিশ্চয়ই তিনি কোন একটা পরিত্রাণের ব্যবস্থা করে দেবেন ! আর যদি না করেন তবে না হয় তাঁর সামনেই জীবন ত্যাগ করবো আমি ! এত কষ্ট করে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।”—–এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই দারিদ্রতায় নীপিড়ীত ব্রাহ্মণ দ্রাবিড় থেকে চলে এলেন নীলাচলে।
শ্রীজগন্নাথের চরণে আত্মনিবেদন করে তিনি মনের দুঃখের কথা জানালেন। নীলাচলে প্রথম দিন যা প্রসাদ ভিক্ষা পেলেন ভোজন করলেন তা। সেদিনটা কাটালেন। কিন্তু কোনরূপ অর্থপ্রাপ্তি তো হল না। বা, সেই সম্ভবনাও দেখা গেল না। পরদিন বিপ্র জগন্নাথকে সরাসরি নিবেদন করলেন বহু অর্থ দান করে তাঁর দারিদ্রতা মোচন করার জন্য। শুধু তাই নয় , অর্থ প্রাপ্তির সংকল্প নিয়ে তিনি উপবাস শুরু করলেন। দেখতে দেখতে এক এক দিন করে সাতদিন অতিক্রান্ত হল। উপবাসে তিনি ক্ষীণকায় হলেন আরও। আর যে শরীর চলে না! ক্ষিদের জ্বালা সহ্য হয় না আর! পরিশেষে স্থির করলেন সমুদ্রে আত্মনিক্ষেপ করে প্রাণ বিসর্জন দেবেন। এই জন্য এলেন সমুদ্রতীরে।

“হে সমুদ্র তোমার বক্ষে আমায় স্থান দাও”- এই বলে সমুদ্রবক্ষে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলেন রামদাস। অকস্মাৎ দেখলেন সমুদ্রের জলের মধ্য দিয়ে পর্বতাকার কোন মহামানব সবেগে আসছেন। এমনই ভীষণাকার সেই পুরুষ যে সমুদ্রের জলতরঙ্গ তাঁর হাঁটু জলের সমান মাত্র। সেই মানব ব্রাহ্মণের সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই সাধারণ মানুষের আকার ধারণ করলেন। এমন অত্যদ্ভুত ঘটনা দর্শন করে ব্রাহ্মণ যারপরনাই বিস্মিত হলেন। বিপ্র রামদাস মনে মনে ভাবলেন, “ইনি নিশ্চয়ই শ্রীজগ্ননাথ । আমার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে, আমাকে দুর্দশামুক্ত করতেই তিনি এসেছেন।” আগুন্তুক মানব কোন কথা না বলে তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যেতে থাকলেন। বিপ্রও তাঁর পশ্চাৎ-এ অনুগমন করলেন। কিছুক্ষণ পর সেই মানব রামদাসকে তাঁর পশ্চাদানুসরণ করতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন – “কে তুমি? আমার সঙ্গে কেন আসছো এভাবে?” রামদাস সবিনয়ে বললেন – “আমি সাতদিনের উপবাসী দুর্বল ব্রাহ্মণ এক। তোমার দর্শনে আমার জীবন সার্থক হয়েছে। এবার বলো তো তুমি কে? যদি পরিচয় না দাও, তবে আমি এক্ষুনি আবার সমুদ্রে প্রাণ বিসর্জন করতে গমন করবো। তখন কিন্তু ব্রাহ্মণ বধের পাপ হবে তোমার। তাই গোপন না করে, আমায় তোমার সত্য পরিচয় দাও।” মানব বললেন – “আমার পরিচয়ে তোমার কী প্রয়োজন? তুমি বরং এটা বল যে , কেন তুমি এই ক্ষেত্রে বাস করেও উপবাসী হয়ে রয়েছ? এখানে, এই পুণ্যধামে জগন্নাথের প্রসাদ তো সকলে পায়। কাউকে তো উপবাস করতে হয় না।” রামদাস তখন মলিন বদনে বললেন – “দারিদ্রতায় আমার জীবন জর্জরিত। দ্রাবিড় দেশে আমার পরিবারের লোকেরা না খেয়ে মরছে। তাঁদের থেকে অপমান পাওয়া আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তাঁদের দুর্দশাও দেখতে পারছি না। দারিদ্রতা আর অপমানের থেকে এখন আমার মৃত্যু শ্রেয়। তাই জগন্নাথের কাছে ধন চেয়ে উপবাস করে আছি।”
বিপ্রের করুণবচন শ্রবণ করে মানবের মনে করুণার উদ্রেক হল । তিনি বললেন –“আমি হলাম বিভীষণ। জগন্নাথ দর্শন করতে এসেছি লঙ্কা থেকে। তুমি এক কাজ করো। মনের অন্য অভিলাষ এবার বর্জন করে নিষ্কাম হয়ে জগন্নাথ দর্শন করো। তোমার এত দুঃখের কারণ তোমার কর্মদোষ। তুমি এবার ভজন করো তাঁকে। জন্মান্তরে তখন সকল সুখ প্রাপ্ত হবে।” এই বলে শ্রীবিভীষণ সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গেলেন। রামদাস ব্রাহ্মণ কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর পশ্চাদানুসরণ করতে থাকলেন।
এদিকে কাশী মিশ্রের উদ্যানে ভক্ত পরিবৃত ‘মহাপ্রভু আমার’ উপবেশন করে আছেন। তিনি হঠাৎ গোবিন্দকে বললেন – “গোবিন্দ , চল এবার গম্ভীরায় যাব। দুইজন বিপ্র দ্বারে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। তাঁদের অপেক্ষা করানো ঠিক নয়।”
প্রভুর ইঙ্গিতে দুই’জন অর্থাৎ বিভীষণ এবং রামদাস প্রকোষ্ঠাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। বিভীষণ প্রণাম করে প্রভুর চরণ সমীপে উপবেশন করলেন আর রামদাস দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। মহাপ্রভু সস্নেহে বিভীষণের অঙ্গ স্পর্শ করে ইঙ্গিতে কুশল বার্তা সব জানলেন। রামদাস অবাক হয়ে সে দৃশ্য দেখছিলেন। তারপর গৌরহরি বিভীষণকে বললেন – “তোমার সঙ্গীর আচরণ বলিহারী। নিজের কর্মদোষে দুঃখ পায় আর জগন্নাথকে দোষের ভাজন করে। সুখের সময় নিজের সৌভাগ্যের প্রশংসা করে। কিন্তু দুঃখের সময় সব দোষ জগন্নাথকে দেয়। সাতদিন উপবাস করে মৃত্যু বরণ করতে চেয়েছিল। তাই জগন্নাথ কৃপা করে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়েছেন। এবার তুমি একে বহু ধন প্রদান করে এর দুর্দশা থেকে মুক্ত কর।” বিভীষণ সবিনয়ে “যথা আজ্ঞা প্রভু” বলে প্রণাম করে বিদায় গ্রহণ করলেন। আর সানন্দে বিপ্র রামদাস অনুসরণ করলেন তাঁকে। পথে যেতে যেতে বিপ্রের মনে এক প্রশ্ন আসল। তিনি জিজ্ঞাসু হয়ে বললেন – “আচ্ছা, আপনি যে বললেন আপনি নাকি বিভীষণ , জগন্নাথ দর্শন করতে নীলাচলে এসেছেন। তা কই জগন্নাথকে তো দর্শন করলেন না? পরিবর্তে একজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। সন্ন্যাসীর আজ্ঞা সহজেই শিরে করে এখন আবার ফিরে যাচ্ছেন জগন্নাথ দর্শন না করেই। সত্য করে তবে বলুন তো আপনার অভিসন্ধি কী আর কে এই সন্ন্যাসী?” তখন সাধারণ এক বিপ্ররূপী বিভীষণ বললেন – “শোন তাহলে, যাঁকে তুমি দর্শন করলে ইনি-ই সাক্ষাৎ জগন্নাথ। সচল জগন্নাথ কলির। তাই আর আমি অচল-বিগ্রহ জগন্নাথকে দর্শন করতে যাইনি। ইনি আদেশ দিলেন দ্রাবিড়ে ফিরে তোমায় ধন প্রদান করতে। তাই এটাই এখন আমার প্রথম কর্তব্য।”
এমন অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য, অননুমেয় সত্য শ্রবণ করে বিপ্র পরমাশ্চর্য্য হলেন। তাঁর চিত্তে এক মহানুভূতি হল। শিরে করাঘাত করে বিভীষণের চরণে পরে বহু কাকুতি-মিনতি করে বললেন – “দোহাই আপনাকে। আপনি আরও একবার আমায় দর্শন করান প্রভুর শ্রীচরণ। আমি অজ্ঞান ব্রাহ্মণ। দুর্ভাগ্যময় জীবন। তাই, আমি বুঝতে পারিনি। আপনি কৃপা করে একবার অন্ততঃ তাঁর কাছে আমায় নিয়ে চলুন। আমার ধনের প্রয়োজন নেই।”
বিপ্রের সকাতর অনুরোধে বিভীষণের মন করুণায় সিক্ত হল। তিনি পুনরায় রামদাসকে প্রভুর কাছে আনলেন। সসঙ্কোচে দুইজনা দাঁড়ালেন। প্রভু তাঁদের পুনর্বার আগমনে হেসে ফেললেন। বিভীষণ বললেন – “প্রভু, তুমি নিজেই এবার এই ব্রাহ্মণের কাছে জানতে চাও যে কেন সে ফেরৎ এল?”
রামদাস বললেন –“প্রভু, আমি তো অবোধ দরিদ্র ব্রাহ্মণ এক। আমি বুঝিনি তাই, যে ,তুমিই জগতের জীবন জগন্নাথ স্বয়ং। নিজ কর্মদোষে আমার ভাগ্যের বিপর্য্যয় ঘটেছে। সুপথ্য ত্যাগ করে কুপথ্যে আমার রতি। তুমি এবার ধন্বন্তরি হয়ে আমার এই ভবব্যাধি নির্মূল কর। আমি এই রোগের জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে মরতে বসেছি। কৃপা কর আমায়, প্রভু।”
প্রভু সহাস্যে বললেন – “তুমি জগন্নাথের কাছে ধনবাঞ্ছা করেছিলে। তিনি তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করার উপায় করে দিয়েছেন। এখন আগে ধনভোগ করে বাঞ্ছা নির্মূল করে নাও। পরে ঠিক জগন্নাথের শ্রীচরণ পাবে।” প্রভুর আশ্বাসবাণী শ্রবণ করে বিপ্রের তৃষিত অন্তর শান্তিবারি প্রাপ্ত হল। প্রেমে মগ্ন হয়ে গৌরাঙ্গের গুণগান করে তিনি আনন্দে নৃত্য করতে থাকলেন। গৌরাঙ্গ চরণই তাঁর সর্বস্ব হল। এভাবে ধন্য প্রভু গৌরচন্দ্র নানা রঙ্গ করে জীবের দুর্দশা মোচন করেন। তিনি নিজজনকে দুঃখ দিয়ে শিক্ষাদান করেন ; ভক্তকে কৃপাচ্ছলে পরিত্রাণ করেন।
ধন্য বিপ্র রামদাস। তাঁর দ্বারা মহাপ্রভু জগতের মানুষকে শিক্ষা দিলেন যে, কর্মদোষেই জীব কষ্ট পায়। সর্ব আশা ত্যাগ করে যাঁরা প্রভুর শ্রীচরণ ভজে তাঁদের সর্বদুঃখের বিনাশ ঘটে, প্রেমধন লব্ধ হয়। চির শান্তিলোকে তাঁদের বাস সম্ভব হয়।
কিন্তু, এতকিছু দেখে শুনেও আমর মত অধমার কোন শিক্ষা হয় না। নানা দুঃখ পেয়েও আবার বিষয়ের আশা করি। সংসার তাপে দগ্ধ হই পুনরায় পুনরায় তাই।
প্রার্থনা করি রামদাস বিপ্রের চরণে , কৃপাপূর্বক শুভদৃষ্টি প্রদান করে আমার বিষয়ে অনুরাগ দূরীভূত করুন তিনি । প্রভুর চরণ তো ভক্তের কৃপাপেক্ষা। তাই আপনি কৃপা করে সে চরণসেবা আমায় লব্ধ করান। স্বয়ং বিভীষণ দ্বারা আপনার বাসনা পূরণ হয়েছে, এবার তাহলে গৌরচরণ লব্ধ করার বাসনা আপনিও পূরণ করুন আমার। কৃপাভাজন করুন আপনার ।
——–নম্রানতা
ভক্ত-কৃপাভিখারিণী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক