গাছ : শতাব্দী মজুমদার।

0
448

তিনতলার নতুন ঘরে হোম যজ্ঞ করেই বিনয়বাবু পাকাপাকি নিজের থাকবার ব্যবস্থা করে নিলেন।ঘরের সঙ্গে একটা দক্ষিণমুখী ব্যালকনি অনেক দিনের শখ ছিল তার।ভেবেছিলেন ওই উঁচু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে অলসভাবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন।

জানালা গুলো স্লাইডিং কাঁচের আর দরজা বানালেন মেহগনি কাঠ দিয়ে বেশ আধুনিক ডিজাইনে।ইচ্ছে মতো খরচ করে নিজের ঘরটা মনের মতো সাজিয়ে তুললেন বিনয়বাবু।

চিরকালই তিনি একটু স্বার্থপর টাইপের মানুষ,সংসারের সেরাটাই নিজে আগে অধিকার করতে চেয়েছেন। ওনার বদমেজাজি স্বভাবের বিরুদ্ধে পরিবারের কেউ কখনো কোনো কথা বলে নি।স্ত্রীর সঙ্গে তেমন বনিবনা বিনয়বাবুর কোনো কালেই ছিল না।স্ত্রী আর দুই ছেলে তাদের পরিবার নিয়ে নিচতলার ঘর গুলিতে যেমন ছিলেন তেমনই থেকে গেলেন। শুধু বিনয়বাবু স্থান পরিবর্তন করে তিনতলায় সবার মাথার ওপরে বিরাজ করলেন।আসলে তিনতলার নতুন ঘরে বসে আলো, হাওয়া সহ প্রাকৃতিক শোভা সব তিনি একাই উপভোগ করতে চাইলেন।

সারা জীবন বিনয়বাবু কষ্ট করেছেন অনেক, বাবার অকাল মৃত্যুতে অর্থ কষ্টে লেখা পড়া সেভাবে এগোয়নি।স্কুলের গণ্ডিটা আর না পেরিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তিতে কেটেগিয়েছিল তার যৌবনের দিনগুলি। তারপর একসময় এদিক সেদিক করতে করতে ওই জমির ব্যবসা, মানে দালালি শুরু করলেন ।

কত লোককে জমি কিনিয়ে দিয়েছেন একসময়, তারপর সেখানে যখন বিশাল অট্টালিকা তৈরি হতে দেখেছেন তখন মনে মনে নিজেও স্বপ্ন দেখেছেন তার নিজের একটা বাড়ির, সুন্দর রাজপ্রাসাদের মতো একটা বাড়ি।অথচ মফস্বল এলাকায় জমির দালালিতে অংশীদারদের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা করে যা হাতে পেতেন তা দিয়ে সংসার চালানোই তখন খুব কষ্টদায়ক হয়ে যেত, রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি তো ছিল দুরস্ত।কিন্তু এরপর যখন তিনি জমির দালালির সঙ্গে সঙ্গে ওই গাছের ব্যবসাটা শুরু করলেন মানে সরকার অধিকৃত জমির গাছ বেআইনি ভাবে কেটে বিক্রি ,সেখানে অংশীদার থাকলেও পয়সার মুখ দেখলেন ।

গাছ কাটা আইন বিরুদ্ধ ,বিশেষত এই বড় বড় প্রাচীন গাছ কিন্তু এর অর্থমূল্য যে প্রচুর। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অর্থাৎ কোথায় কত ঘুষ দিয়ে নির্বিঘ্নে এক একটা অর্থকরী গাছ কেটে ফেলা যায় তা বিনয়বাবু ভালোমতো রপ্ত করে ফেলেছিলেন।

তার এলাকা পঞ্চায়েত অধীন,পঞ্চায়েত থেকে বছরে একবার দু’বার ঘটা করে বৃক্ষরোপন পালন হয়।কিন্তু ওই যে বহু পুরোনো বেশ কয়েকটা সেগুন গাছ রেল লাইন পাড়ের বড় খেলার মাঠটার চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বা স্কুলের সামনে নিরীহ শিরীষ গাছ টা, বা বড় রাস্তার মোড়ে পুরোনো মেহগনি গাছ টা ওদের কেটে ফেললেই তো হয়!ভাবনাটা বিনয়বাবুর মাথায় খেলে যাওয়ার পর আর দেরি করেন নি।স্থানীয় পঞ্চায়েত কে সহজে বাগে এনে ফেললেন মুনাফার বড় একটা অংশের অংশীদারি করে নিয়ে।

পরিবেশপ্রেমী দু’একজন এলাকাবাসী রে রে করে ছুটে এলেও বিশেষ অসুবিধা কিছুই হয়নি।যেহেতু নতুন চারাগাছ নিয়মমাফিক বসানো হয় সেই অজুহাতে পুরোনো গাছ সাফাই করে দেওয়া যেতেই পারে ,যদিও সেই সব চারাগাছ সঠিক পরিচর্যা পেল কিনা তা নিয়ে আর পঞ্চায়েতের কোনো মাথা ব্যাথা থাকে না।
…………………………

পঞ্চান্ন বছর বয়সী বিনয়বাবু আজকাল অনিদ্রায় ভুগছেন।মধ্যরাতে তার ঘুম ভেঙে যায়।ঘরের মধ্যে কার যেন উপস্থিতি টের পান অথচ এ ঘরে তো সেভাবে কেউ আসে না।রোজই উঠে গিয়ে বাথরুম ঘুরে জল টল খেয়ে ঘরের চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করেন কিন্তু সহজে আর ঘুম আসে না।কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করেন তবুও ঘুম আসে না ।

ওপরের ঘরে একলা থাকতে ভয় করে কি তার!ধুর কিসের ভয় !

একবার ভাবেন লাইট জ্বালিয়ে ঘুমোবেন পরক্ষণেই সেই ভাবনা মাথা থেকে তাড়িয়ে নীলচে নাইট ল্যাম্পের মৃদু আলো মাখা ঘরে ঘুমোনোর চেষ্টা করেন কিন্তু ঘুম আর রাতে আসে না ভোরের দিকে চোখ লেগে আসে।রোজই বিছানা ছাড়তে দেরি হয় তার।

ঘরের মধ্যে বিশ্রী একটা আওয়াজ সেদিন তার ঘুমটাকে এক্কেবারে চটকে দিল। তাড়াতাড়ি উঠে ঘরের বড় লাইটটা জ্বালিয়ে ওই আওয়াজের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলেন বিনয় বাবু।

কিন্তু কোথায় সেই আওয়াজ !কিছু নয় তো ! হয়তো তার মনের ভুল।

লাইট অফ করে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে আবার বিছানায় এসে দু’ চোখের পাতা বন্ধ করতেই
শুরু হলো সেই রকম আওয়াজ,অনেকটা যেন গোঙানির মতো ।ভালো করে কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলেন বিনয়বাবু।স্পষ্ট শুনলেন কে যেন যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে।

কিন্তু কোথায় কে !

বুঝলেন ওই দরজার দিক থেকেই এরকম আওয়াজটা আসছে।

দক্ষিণের হাওয়ার সঙ্গে ব্যালকনির দরজার পাল্লার সদ্ভাব না থাকায় এরকম আওয়াজ হচ্ছে কিন্তু আওয়াজটা বেশ বিরক্তিকর,উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আবার ঘুমনোর চেষ্টা করলেন বিনয়বাবু।

দরজা বন্ধ করে ঘুমোলেও রোজ ই মধ্যরাতে তার ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় দরজায় কেউ হয়তো ধাক্কা দিচ্ছে।

কিন্তু ব্যালকনির দিকের দরজায় আবার কে ধাক্কা দেবে!

হ্যাঁ, আবার সেই দক্ষিণের হাওয়া ।ওই হাওয়াই মেহগনি কাঠের সুদৃশ্য শক্ত পোক্ত দরজায় আঘাত হানছে ,নিজের মন কে সে কথা বুঝিয়ে ঘুমোনোর ব্যর্থ চেষ্টায় রোজই বাকি রাত টুকু শুধু এপাশ ওপাশ করেন বিনয়বাবু।

………………………….

রাতে ঘুমোনোর আগে পান করা তার বহুদিনের অভ্যেস ছিল ,এতে নাকি এক ঘুমে সকাল হয়ে যায়।ইদানিং ফ্যাটি লিভারের কারণে ডাক্তার ওটা খেতে একদম বারণ করেছে কিন্তু কে শোনে আর সেকথা। জীবনে শখ তো একটু থাকবেই এবং তা মেটাতেও হবে।এখন যখন একটু পয়সা হয়েছে তখন বিদেশি বোতলের স্বাদ থেকে কেনই বা আর নিজেকে বঞ্চিত রাখবেন।কদিন একটু বিরতি দিয়ে আবার সেদিন কিছুটা পান করেই বিনয়বাবু রাতে ঘুমতে গেলেন।কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করার পরও যখন ঘুম আসছে না ,তখন দরজা খুলে তার শখের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন।

জোৎস্না রাত বড়ই মধুর, রাতের প্রকৃতি কত সুন্দর।এই সুন্দরকে উপভোগ করার মতো সময় আগে তিনি পাননি রোজগারের ধান্দায় সময় দিতে গিয়ে।
ধুর নিকুচি করেছে সৌন্দর্যের ,মনে মনে বললেন বিনয়বাবু।

ল্যাম্প পোস্টের আলোয় বড় রাস্তার দুপাশে সারি সারি শাল গাছ গুলোকে তার ব্যালকনি থেকে দেখতে বেশ লাগছে।গাছগুলি যেন এরমধ্যে পুরুষ্ট হয়ে উঠেছে অনেকটাই।তবে আর দেরি কেন!কালই এ বিষয়ে একটা পাকাপোক্ত বোঝাপড়া করে ফেলতে হবে ।যেখানে যা দেওয়ার দিয়েও যা আসবে হাতে তা ব্যাংকে রেখে সেই ইন্টারেস্টেই বাকি জীবনটা তার বহাল তবিয়তে কেটে যাবে।আজকাল কেউ কি আর ছেলেদের ওপর ভরসা করে!

শালগাছ গুলো সাফ করার কথা ভেবে গভীর রাতেও তার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো ,এবার নিশ্চয়ই ঘুমটা ভালো হবে এই ভেবে
ঘরের নাইট ল্যাম্পের আলোয় চারদিক দেখে নিয়ে ব্যালকনির দরজাটা বন্ধ করতে গেলেন বিনয়বাবু।

কিন্তু এ কি! ঘরের নীলচে আলো আর ব্যালকনি থেকে আসা চাঁদের আলোয় এ কি দেখছেন তিনি!

এ যে একটা গাছের স্পষ্ট অবয়ব ,তার দরজার গায়ে ভেসে উঠছে ।ডাল পালা মেলে পাতায় মোরা গাছটি দেখে মুহূর্তে চিনে ফেললেন তিনি, এটা মেহগনি গাছ।

কিন্তু এই গাছটা এভাবে এখানে কেন !ওর মোটা শক্ত গুড়ি তো কবেই মাটি থেকে উপড়ে নেওয়া হয়েছে।ওর শক্ত ডালপালা কেটে কবেই কাঠের দোকানে চেরাই হয়ে ফার্নিচার এর শোরুমে চলে গেছে! উনি না হয় ওই গাছের কাঠ দিয়ে দরজা বানিয়েছেন ।

মেহগনি গাছ টা এবার যেন নড়ে উঠলো।

ডালপালা গুলো ক্রমশঃ বিনয়বাবুর দিকে এগিয়ে আসছে ।

একি ও তো স্থবির ,এগিয়ে আসছে কিভাবে ও! না না এ হতেই পারে না।ভুল দেখছেন তিনি।

পালাতে চাইলেন বিনয়বাবু কিন্তু নড়তে পারলেন না এক ইঞ্চিও।হাত পা অসাড় ,চিৎকার করে ছেলেদের ডাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু গলায় আওয়াজ কই!কোনো শব্দই তার গলা থেকে বেরোলো না।

গাছ টি এবার তার ডালপালা দিয়ে জাপটে ধরলো বিনয়বাবুকে।

উফঃ কি অসীম শক্তি ওর ,আর তো পারা যাচ্ছে না ।আবারো আপ্রাণ চেষ্টা করলেন ওই ভয়ংকর গাছটার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, না পেরে উঠলেন না আর কিছুতেই ওই দানব মেহগনি গাছটার সঙ্গে।দম যেন বন্ধ হয়ে এলো ওর শাখা প্রশাখার মধ্যে পিষে গিয়ে।

ওই বৃদ্ধ গাছটার এতো শক্তি যে একদম ধরাশায়ী করে ফেললো বিনয়বাবুকে।
……………………….

সকালে চা দিতে এসে বড় ছেলের বউ প্রথম দেখেছিল মেঝেতে অচেতন হয়ে পড়ে আছেন বিনয় বাবু।সারা শরীরে ধস্তাধস্তির চিন্হ।শরীরের না না জায়গায় আঁচড়ের দাগ।

বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানোর পর তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হলো।হাত পা অসাড়, কথা একদম বন্ধ।মস্তিস্ক সক্রিয় থাকলেও শরীর নিষ্ক্রিয় ।

বিছানায় শুয়ে থাকা শরীরটার দৃষ্টি সারাক্ষন স্থির ওই ব্যালকনির দরজার দিকেই।

কি ভাবেন বিনয়বাবু !

সেই রাতের নিরীহ নিশ্চল একটা জীবনের ভয়ংকর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা!

না,বছরের পর বছর একই জায়গা দখল করে থাকা স্থবির প্রাণ গুলিকে কুঠারের আঘাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার কথা!

তিনতলার ঘরে ওনাকে আর একা রাখা হলো না ,স্ত্রী এসে থাকা শুরু করলেন ওই ঘরে।বাড়ির সবাই বিনয়বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও প্রথমে
ছোট ছেলের নজরে পড়েছিল দরজার ফাটলগুলো।মেহগনি কাঠে তৈরি এরকম মজবুত দরজায় এতো ফাটল ধরলোই বা কিভাবে!

এরপর বিনয়বাবু স্ত্রীর যত্নে আরও কয়েকটা বছর বেঁচে ছিলেন ওই তিনতলার ঘরেই জীবন্ত লাশ হয়ে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here