আনাড়ি মহিলার উচ্ছৃঙ্খলতা (ধারাবাহিক উপন্যাস, পঞ্চম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
491

“ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবুকে তোমাদের জন্য উতলা দেখলাম । সম্ভবত তিনি তোমাদের সাথে দেখা করে কোনো দরকারি কথা বলবেন” গদাই জানালো ।
“কখন যাবে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে দেখা করতে” ? ইমলি গদাইকে জিজ্ঞাসা করলো ।
“আজই এবং সেটা কিছুক্ষণ পরেই । পরপর কয়েকটা বাস ঢোকায় দোকানে এখন খরিদ্দারের ভিড় । আপাতত দোকানের খরিদ্দারদের ভিড় সামলাই । তারপর ব্যাঙ্কের বাবুদের দুপুরের টিফিনের আগেই ব্যাঙ্কে পৌঁছে যাবো” । মাথা নেড়ে ইমলি গদাইয়ের প্রস্তাবের সম্মতি জানালো ।
ইতাস এই অবসরে গদাইকে বললো, “ভায়া, আজও কিছু পেয়ারার ব্যবস্থা করো । আমি মাথায় নিয়ে বিক্রি শুরু করি । হাত একেবারে শুন্য । এই সময়টা পেয়ারা বিক্রির মোক্ষম সময় । চারিদিক থেকে পরপর বাস ঢুকছে । বর্দ্ধমান থেকে আসা দুখানা লোকাল বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে । এইমাত্র ‘বর্দ্ধমান – কাটোয়া’ এক্সপ্রেস যাওয়ায় লোকাল বাসগুলি ছাড়তে দেরী করছে । সুতরাং তুমি সত্বর গিয়ে এক ঝুড়ি বারুইপুরের পেয়ারা এনে দিলে আমি কাজে নামতে পারতাম” ।
গদাই ইতাসকে নিয়ে ছুটলো ফলের দোকানে । এক ঝুড়ি পেয়ারা মাথায় নিয়ে ইতাস বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের কাছে গিয়ে হাঁকলো, “পেয়ারা ! পেয়ারা চাই ! বারুইপুরের এক নম্বর পেয়ারা” ! তারপর বাসের ভিতর ঢুকে প্রত্যেক প্যাসেঞ্জারকে একবার করে জিজ্ঞাসা করলো, “পেয়ারা খাবেন । ভাল পেয়ারা । বারুইপুরের পেয়ারা । স্বাদে অতুলনীয়” ।
অল্প বয়স্ক বাসের প্যাসেঞ্জার পেয়ারা হাতে নিয়ে বললেন, “একটু বিট নুন মাখিয়ে খন্ড খন্ড করে কেটে দিন” ?
ছোট ছুড়ি দিয়ে পেয়ারাটা টুকরো-টুকরো করলো বটে, কিন্তু বিট লবন তার কাছে না থাকায় বিট লবন মাখাতে পারলো না । তাই কাঁচুমাচু হয়ে ইতাস ভদ্রলোককে বললো, “দাদা, আমি খুব দুঃখিত । আমার কাছে বিট লবন না থাকায় পেয়ারায় মাখাতে পারলাম না । আজ কষ্ট করে বিট লবন ছাড়া খান । পরেরদিন অবশ্যই পেয়ারায় বিট লবন মাখানো থাকবে” । ইতাসের মিষ্টি ব্যবহারে তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না । এই রকমই ইতাসের ব্যবহার । “খরিদ্দারের তুষ্টি”, ইতাসের ব্যবসার অন্যতম টার্গেট ।
দু-ঘন্টার মধ্যে ঝুড়ির অর্দ্ধেক পেয়ারা বিক্রি শেষ । ইতাসের প্রচন্ড চেষ্টা, বাস স্ট্যান্ডে বা আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমস্ত মানুষের কাছে পেয়ারা নিয়ে পৌঁছে যাওয়া এবং সবাইকে তার পেয়ারা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করা । তার মিষ্টি ভাষার আর্জির জন্য এমন কিছু খরিদ্দার জোটে যাঁরা পেয়ারা কেনার কথা কখনও ভাবেননি, তাঁরাও পেয়ারার চেহারা দেখে তাঁদের মনে পেয়ারা খাওয়ার ইচ্ছা জাগে এবং তাঁরাও পেয়ারা কেনেন । ইতাসের অভিনব কায়দায় পেয়ারা বিক্রির মার্কেটিং এখানেই সার্থক । যার জন্য তার ঝুড়ির পেয়ারা বিক্রি তাড়াতাড়ি ঘটে ।
অর্দ্ধেক পেয়ারা বিক্রি শেষ হওয়ার পর পরেই ইতাসকে গদাইয়ের ডাক, “দাদা, আসুন । ব্যাঙ্কে যেতে হবে । শিগ্‌গির আসুন” ।
ব্যাঙ্কে তেমন ভিড় নেই । কাউন্টারের সামনে সর্বসাকুল্যে দশজন গ্রাহক দাঁড়িয়ে । সম্ভবত টাকা তোলার জন্য চেক জমা দিয়েছেন । তিনজন গ্রাহক ক্যাশিয়ারের কাউন্টারের সামনে ক্যাশিয়ারের খাঁচার দিকে তাকিয়ে । গদাইয়ের ধারণা, তাঁরা টাকা জমা দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন । কুসুমগ্রামের এই গ্রামীণ ব্যাঙ্কে ঢুকলে গদাইয়ের ব্রাঞ্চের ভিতরের পরিবেশটা খুব ভাল লাগে । পরিপাটিভাবে সাজানো গোছানো । কর্মীদের ব্যবহারও তেমনি ভীষণ আন্তরিক । দুই বছর আগে এই শাখায় গদাইয়ের একটা অঘটন ঘটেছিলো । সেই ঘটনা আজও তার মনে উজ্জীবিত । “চা পাতা, গুড়ো দুধ ও চিনি কেনার জন্য হঠাৎ টাকার দরকার । হন্যে হয়ে ব্রাঞ্চে ছুটলো । ব্রাঞ্চ থেকে চটজলদি পাঁচ হাজার পাঁচ শত টাকা তুললো । টাকাটা তোলার পর সেই টাকাটা ব্যাঙ্কের ভিতর না গুনে সরাসরি নিজের দোকানে ঢোকে । দোকানে তখন চা খাওয়ার জন্য বেশ কয়েকজন খরিদ্দার । খরিদ্দারদের চা দিতে গিয়ে ঐ টাকাটা আর গোনা হয় না । ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলে গোনার কথা বেমালুম ভুলে যায় গদাই । দুপুরবেলায় বাজারের নটহরির দোকানে চা পাতা, গুড়ো দুধ কেনার পরে টাকা মেটাতে গিয়ে গদাই লক্ষ্য করলো তার কাছে চার শত টাকা কম । টাকাটাতে একশ টাকার নোট একচল্লিশটা এবং দুটো পাঁচ শত টাকার নোট । গদাইয়ের মাথায় হাত ! তার ছোট ব্যবসা । অল্প লাভ । তার মধ্যে চার শত টাকার গচ্ছা ! নটহরির দোকানে চা পাতা ও দুধের ব্যাগটা রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো ব্যাঙ্কে । ব্যাঙ্কে পৌঁছে জানলো, ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার বাবু বাজারে সোনালী মাসির দোকানে টিফিন খেতে গেছেন । সোনালী মাসির দোকানের পাউরুটি ও ঘুগনি ভীষণ সুস্বাদু । অফিসের বাবুরা সাধারণত সেখানেই টিফিন খান । গদাই টেনশনে ঘামছে । সোনালী মাসির দোকান শুনেই গদাই ছুটলো মাসির দোকানে । চার-পাঁচজন অন্যান্য অফিসের কর্মীরা তখন খাওয়ায় ব্যস্ত । সকলের আবদার সেঁকা পাউরুটি ও তার সঙ্গে ঘুগনি খাওয়ার । এই তল্লাটে সবাই জানে, মাসি খরিদ্দারদের আবদার মেটাতে তাঁদের মনের মতো খাবার বানাতে অভ্যস্ত । গদাই মাসির দোকানে পৌঁছে দেখে, ক্যাশিয়ার বাবুর খাওয়া শেষ । পেছনের পকেট থেকে মানি-ব্যাগ বের করে সোনালী মাসিকে পেমেন্ট মেটাচ্ছেন । গদাইকে দেখে ক্যাশিয়ার বাবু চিন্তিত মুখে বললেন, “কী ব্যাপার গদাই ? তোমাকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে কেন“?
ক্যাশিয়ার বাবু, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে ।
সর্বনাশ ! কী বলছো গদাই ?
হ্যাঁ । সকালে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুললাম, সেখানে চার শত টাকা কম ।
“চার শত টাকা কম” ! ক্যাশিয়ার বাবু আশ্চর্য হয়ে গদাইকে বললেন, “কেন টাকা কম পেলে, বুঝতে পারছি না । এরকম ভুল হওয়ার কথা নয় । তুমি নিশ্চিন্ত থাকো আমার ভুলের জন্য হলে পুরো চার শত টাকা তো ফেরত পাবেই উপরন্তু তোমাকে আমি মাসির দোকানে খাইয়ে দেবো । ব্যাঙ্কে চলো গদাই । আমি খাতার হিসাব দেখে তোমাকে সব বলছি । মানুষের ভুল হতেই পারে । তবে সাধারণত আমার টাকা পয়সার ক্ষেত্রে ভুল হয় কম” ।
ক্যাশিয়ার বাবু গদাইয়ের টাকা তোলার উইথড্রয়াল ফর্ম বের করলেন । উইথড্রয়াল ফর্মের পেছনটা খতিয়ে দেখে বললেন, ভুলটা তাঁর । পাঁচ শত টাকা ভেবে একশত টাকার নোট দেওয়া হয়েছে । একচল্লিশ পিস্‌ এক শত টাকার নোট এবং পাঁচ শত টাকার দুটি নোট । যার জন্য চার শত টাকা কম । টাকাটা ফেরত দিয়ে ক্যাশিয়ার বাবু খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে গদাইকে বললেন, “তোমার টেনশনের জন্য আমি দুঃখিত । চলো তোমাকে আমি খাওয়াবো” । আবেগে গদাইয়ের চোখে জল । ব্যাঙ্কের বাবুরা এত সৎ এবং এত সুন্দর তাঁদের অমায়িক ব্যবহার তার ভাবনার অতীত । তাই সে ক্যাশিয়ার বাবুকে বললেন, “টাকাটা ফেরত পেয়ে আমি খুশী । এইজন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ” । বলে গদাই ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে নটহরির দোকান থেকে মালপত্র নিয়ে তার চায়ের দোকানে ফিরেছিলো । সেইদিন গদাই বুঝতে পেরেছিলো, ব্যাঙ্কের ব্যবসাটা অনেকটাই বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল ।
তারপর তিনজনে সোজা ম্যানেজার বাবুর চেম্বারে । রিতম বাবু গদাইকে দেখতে পেয়ে হেসে হেসে বললেন, “এসো গদাই । তোমার দিদি-জামাইবাবুকে সঙ্গে নিয়ে এসে ভালই করেছো । আমার দরকার তোমার দিদি-জামাই বাবুর সঙ্গে” ।
ইতাস ও ইমলি রিতম বাবুর মুখের দিকে তাঁর কথা শোনার জন্য একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো । রিতম বাবু ইতাসকে বললেন, “আপনারা হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন বুঝতে পারলাম না । যার জন্য আমি গদাইয়ের দোকানে গিয়ে আপনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছি” ।
ইতাস আমতা আমতা করে রিতম বাবুকে বললো, “আমরা কুসুমগ্রামে রাত্রি কাটাবার অবলম্বন খুঁজে না পেয়ে অন্যত্র গিয়েছিলাম । সেখানে এই কটা দিন কাটিয়ে আজই ফিরলাম । এবার আপনি বলুন স্যার, আমাদের থাকার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিলেন” ?
“আপনাদের দুর্দশাগ্রস্থ জীবনের কথা ভেবে এবং আপনাদের অনুরোধ মোতাবেক, আপনাদের থাকার ব্যাপারে আমি ব্রাঞ্চের সমস্ত স্টাফদের নিয়ে মিটিংয়ে বসেছিলাম । সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আপনাদের ব্যাঙ্ক বিল্ডিংয়ের বারান্দায় থাকতে দেওয়া হবে, কিন্তু শর্তে” ?
“শর্তে” ? রিতম বাবুর কথাটার পুনরক্তি করে ইতাস নড়েচড়ে বসলো ।
হ্যাঁ । আমাদের ব্রাঞ্চে সব মিলিয়ে বারোজন স্টাফ । এখানে ক্যান্টিন চালু নেই । অথচ ক্যান্টিন চালু করার সমস্ত ব্যবস্থা ও সরঞ্জাম রয়েছে । ম্যাডামকে ক্যান্টিনে স্টাফদের জন্য দুপুরের খাবার রান্না করতে হবে । ক্যান্টিনে কাজ করার জন্য অল্প সামান্য কিছু মাসোহারা পাবেন । সুতরাং ক্যান্টিনে কাজ করলে বরং আপনাদের থাকার ব্যাপারে এলাকার কারও আপত্তি থাকবে না । আরও একটা কথা, ক্যান্টিনে কাজ করার সুবাদে রাত্রি ছাড়া ম্যাডামের খাওয়ার চিন্তা রইলো না । এছাড়া এখানে যিনি পার্ট-টাইম স্যুঈপার হিসাবে কাজ করছেন, তার তিন মাস পর অবসর । সেই জায়গায় আপনি আংশিক সময়ের জন্য ঝাড়ুদার (পার্ট-টাইম স্যুঈপার) হিসাবে কাজ করতে পারবেন । পার্ট-টাইম স্যুঈপার নিয়োগ করাটা এখনও পর্যন্ত ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের হাতে । সুতরাং সেইদিক দিয়ে আপনার একটা মাসোহারার হিল্লে হবে । আপনাদের জন্য পেছনের বারান্দাটা আমরা ত্রিপল দিয়ে ঘিরে দিয়েছি । যাতে বৃষ্টি নামলে থাকায় কোনো অসুবিধা না হয় । তবে এখানে থাকার ব্যাপারটা কিন্তু সাময়িক । আপনাদের অন্যত্র ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আপনারা এখানে থাকতে পারবেন । থাকা নিয়ে একটা সমস্যা রয়েছে, সেটা হচ্ছে বাথরুম । কলের পাশে আমরা তার ব্যবস্থা শীঘ্রই করছি । বাথরুমের ব্যবস্থা আমাদের দায়িত্ব । ওটা আমাদের উপর ছেড়ে দিন । আরও একটা কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই, “আমাদের ব্যাঙ্কের কাজ কর্ম চলে বিশ্বাসের উপর । সেই বিশ্বাসের মর্যাদা আপনাকে রাখতে হবে । অন্যথা হলে আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবো না । মোটামোটি আমি সব খুলে বললাম । শর্তে রাজী থাকলে আজ থেকে আপনারা পেছনের বারান্দায় থাকা শুরু করতে পারবেন ।
এতগুলি কথা বলে রিতম বাবু থামলেন । টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেলেন ।
ইতাস ও ইমলি একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো । গদাই রিতম বাবুর দিকে তাকিয়ে বললো, “এটা অতি উত্তম প্রস্তাব স্যার” ।
গদাইয়ের কথায় রিতম বাবু একটু হাসলেন । তারপর সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, “আপনারা একট বসুন । এই ফাঁকে আমি টিফিন করে আসি” ।
ইতাস প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললো, “হ্যাঁ স্যার । আপনি টিফিন করতে যান । আমরা বরং গদাইয়ের দোকানে যাচ্ছি । সন্ধ্যার আগে আপনার সাথে কথা বলতে পুনরায় আসছি” ।
“ঠিক আছে ইতাস বাবু । এই সময়টাতে আপনারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে নিতে পারবেন । আপনাদের অস্থায়ীভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের ব্যবস্থা আমি আমার সাধ্যমতো করেছি এবং সেই সঙ্গে ম্যাডামের কিছুটা উপায়ের পথ বাতলে দিলাম । এবার সিদ্ধান্ত আপনাদের” ? কথাগুলো বলেই তিনি টিফিন খেতে ম্যানেজারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
ইতাস বাকী পেয়ারাগুলি বিক্রির জন্য বাস স্ট্যান্ডে হাঁকতে লাগলো, “পেয়ারা চাই, পেয়ারা ! ভাল ডাসা পেয়ারা । বারুইপুরের পেয়ারা” ।
ইমলি গদাইয়ের চায়ের দোকানে খরিদ্দারদের নিকট চায়ের ভাঁড় পৌঁছে দিচ্ছে । এইসব টুকটাক কাজ করতে ইমলির ভালই লাগে । কিন্তু সোনারগাঁও কলোনীতে থাকলে জমির চাষের কাজে তাদের প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হোতো যেটা তাদের শরীর নিতে পারতো না । তারা ছোট বয়স থেকে পড়াশুনার মধ্যে মানুষ । সোনারগাঁও কলোনীতে বাস করে ঐরূপ মাঠের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটা তাদের দ্বারা অসম্ভব হোতো । তাছাড়া পুরোমাত্রায় গ্রামটা তৈরী হতে অনেক দেরী । রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে । সুতরাং রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘর, তৈরীর পেছনে যেমনি খাটুনি তেমনি সময়সাপেক্ষ । মাঠের ফসল কেমন হবে সেটাও ভবিষ্যতের ব্যাপার । ইতাস সেই সোনারগাঁও কলোনীতে থাকার জন্য গোঁ ধরেছিলো বটে, কিন্তু তাদের পক্ষে স্থায়ীভাবে থাকাটা স্বাচ্ছন্দ্যের হোতো না । সোনারগাঁও কলোনীতে তাদের সাংসারিক জীবন যাপন ভবিষ্যতের কথা ভাবলেও স্বস্তির ছিলো না । সন্তানাদির মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রেও সোনারগাঁও কলোনী থেকে তাদের মানুষ করা দুর্বিষহ যন্ত্রণার হোতো । সুতরাং কুসুমগ্রামে ফিরে আসাটা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত ।
মাঝে মাঝে গালে হাত দিয়ে ইমলি ভাবে, কতো মেহনত করে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করে একটা ডিগ্রি নিলো । অথচ এই দেশে আসার পর সেই ডিগ্রির কোনো মূল্যেই পেলো না । ইতাসও তেমনি । ওপারের ডিগ্রিতে এপারে চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দুরাশার ন্যায় । তাই তারা ডিগ্রি নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করতে নারাজ ! এখন বাঁচার লড়াই । বেঁচে থাকার লড়াই । তারপর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা । এই মুহূর্তে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবুর প্রস্তাব তাদের জীবনে বেঁচে থাকার অক্সিজেন । ম্যানেজার বাবু তাদের আর্থিক দৈনদশার কথা ভেবে তার জন্য একটা কাজের বন্দোবস্থ করে রেখেছেন । হোক ঝাড়ুদারের কাজ, তাতে কী ? জীবিকা উপার্জনের জন্য ইমলির কাছে উত্তম পথ । শাখার কয়েকজনের জন্য রান্না, তার বিনিময়ে সারাদিন সেখানে খাওয়া । বরং লোকজনের মধ্যে কাজ করলে মন ভাল থাকবে । নিজেকে ব্যস্ত রাখা সম্ভব । ইমলি মনেপ্রাণে ব্যাঙ্কের ক্যান্টিনের ও ঝাড়ুদারের কাজ করতে আগ্রহী । ইতাসেরও দ্বিমত নেই । থাকার জায়গাটা পাকাপোক্ত । থাকার জন্য আলাদা খরচা নেই । ম্যানেজার বাবু সহৃদয়বশত তাদের জন্য বাথরুম রেডি করছেন । ম্যানেজার বাবুর সিদ্ধান্তের প্রতি ব্রাঞ্চের সমস্ত স্টাফের সহমত রয়েছে । সুতরাং ম্যানেজার বাবুর উদারতার জন্য তাঁর প্রতি ইমলির অনেক অনেক শ্রদ্ধা ।
গদাই ডাকলো, “দিদি, এদিকে একটু আসবে” ?
ইমলি গদাইয়ের কাছে যাওয়া মাত্র বললো, “দিদি, একটা কথা বলবো” ?
যা বলবি ভনিতা রেখে স্পষ্ট ভাষায় বল্‌ । আমি তোর কথা শোনার জন্য মুখিয়ে রয়েছি ।
বলছি কী, তোমরা ম্যানেজার বাবুর কথায় রাজী হয়ে যাও । রাজী হলে, তোমাদের পক্ষেই মঙ্গল ।
তোর ইতাস দাদা কী বলে শোনা যাক্‌ ।
ইতাস দাদাকে রাজী করানোর দায়িত্ব আমার ।
তাদের কথোপকথনের মধ্যে ইতাস এসে হাজির । মাথা থেকে খালি পেয়ারার ঝুড়ি নামিয়ে হিসাব কষে দেখলো পেয়ারা কেনার টাকা মিটিয়ে তার নব্বই টাকা লাভ । খুশীতে ইতাসের চোখ দুটি জ্বলজ্বল । ইমলি ইতাসকে বললো, “ব্যবসার হাত তোমার লাভজনক । তোমার হাতে ব্যবসা রয়েছে । তুমি ব্যবসা চালাতে পারবে” ।
সূর্য অস্ত যাওয়ার পথে । ইতাস গদাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “চলো ভায়া, ব্যাঙ্কে যাই । নতুবা রাত কাটানো আবার সমস্যা” ?
কিন্তু ব্যাঙ্কে গিয়ে কী বলবেন দাদা ?
আবার দ্বিমত কেন ? আমরা ম্যানেজার বাবুর প্রস্তাবে রাজী ।
তারপর তিনজনে ব্যাঙ্কে পৌঁছে দেখে ম্যানেজার বাবু ও আর একজন সাব-স্টাফ রয়েছেন । প্রায় সন্ধ্যা ৭টা । রিতম বাবু ইতাস ও ইমলিকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কী সিদ্ধান্ত নিলেন” ?
আপনার ইতিবাচক প্রস্তাবে আমরা রাজী । শুধুমাত্র আপনাকে আমাদের অনুরোধ, বাথরুমটা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বানালে উপকৃত হতাম স্যার ।
“তাহলে আজ থেকেই থাকা শুরু করুন” । রিতম বাবু অনুরোধ করলেন ।
“ঠিক আছে স্যার । আমরা একটু পরেই ঢুকছি । আপনাকে অনুরোধ, ঢোকার মুখের গেটটায় তালা দেবেন না” । ইতাস ম্যানেজার বাবুকে অনুরোধ করলো ।
“পেছনের বারান্দা ত্রিপল দিয়ে ঘিরে দিয়েছি । প্রথম কয়েকদিন অসুবিধা হবে । আপনাদের মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে । তবে এটাও ঠিক, বাস করতে করতে আপনারা নিজেদের মতো গুছাতে পারবেন । আজ থেকে রাত্রি যাপনের ব্যাপারে আপনাদের হতাশায় ভূগতে হবে না । সর্বোপরি আমরা রইলাম আপনাদের পাশে । আমি চাই, ম্যাডাম আগামীকাল থেকে ক্যান্টিনে কাজ শুরু করুন ।“ রিতম বাবু ইতাস ও ইমলিকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বললেন । তারপর আরও বললেন, “অনেকটা রাত হয়েছে । এবার আমরা ব্রাঞ্চ বন্ধ করবো । এতক্ষণ আপনাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম । যাই হোক আপনাদের থাকার ব্যাপারে কথা দিয়ে কথা রাখতে পেরে এই মুহূর্তে আমি ভীষণ খুশী ।“
গদাইয়ের দোকানে পুনরায় তারা হাজির । গদাই ইমলি দিদিকে বললো, “দিদি আমিও বাড়ি ফিরবো । তোমরা বরং এদিক-ওদিক না ঘুরে ব্যাঙ্কের বারান্দায় গিয়ে বিশ্রাম নাও ।“
তারপর ইমলি ব্যাঙ্কের পেছনের বারান্দায় ত্রিপল টাঙানো দেখে তাজ্জব । তাদের মনে হচ্ছে একটা ঘর । ঐ ঘরের ভিতর একটি বাল্ব লাইট ঝুলছে । ইলেক্ট্রিক তার টেনে ব্যাঙ্ক বাবুরা বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন । ফলে ঘরে যথেষ্ট আলো । নীচে অর্থাৎ মেঝেতে নতুন শতরঞ্চি পেতে দিয়েছেন । সুতরাং ব্যাঙ্কের বারান্দায় তাদের রাতে শুয়ে ঘুমাতে আর অসুবিধা রইলো না । ব্যবস্থাপনা দেখে তারা রীতিমতো খুশীতে ভরপুর । তারপর টিউবওয়েলে গিয়ে জল দিয়ে ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে তারা রাতের খাবার নিয়ে বসলো । পাউরুটি ও ঘুগনি । তারপর ঘুম । বলা চলে সুখ নিদ্রা । অনেকদিন পর নিরাপদ জায়গায় নিশ্চিন্তে শান্তির ঘুম ।
সকাল সাড়ে আটটা । তখনও তারা ঘুমোচ্ছে ।
কুলিন সোরেন আধা হিন্দী ও আধা বাংলায় তাদের ডাকছে, “সাহেবজী, নিদ্‌ সে উঠ্‌ যাইয়ে” ।
আধো আধো চোখে ইমলি তাকিয়ে দেখে রোগা-পটকা বয়স্ক একজন মানুষ তাদের ডাকছে । ইমলি ইতাসকে ধাক্কা দিয়ে বললো, “দেখো তো কে ডাকছে” ?
“আমি, এই ব্রাঞ্চের স্যুঈপার আছি মানে ঝাড়ুদার আছি” ।
ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে ইতাস লক্ষ্য করলো ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা । অগত্যা বিছানা থেকে উঠে ইমলি কুলিন সোরেনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “হঠাৎ আমাদের ডাকছেন কেন” ?
“ম্যানেজার বাবু পিছের বারান্দায় ঝাঁট দেনে কে লিয়ে বল্‌ গিয়া” । কুলিন সোরেন ইমলিকে বললো ।
কথা বলার সময় কুলিন সোরেনের মুখ থেকে বিশ্রি গন্ধ । মনে হচ্ছে কুলিন সোরেন ঠিকমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না । তার উপর মুখ থেকে বিশ্রি গন্ধ । নাকে কাপড় দিয়ে ইমলি কুলিন সোরেনকে জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি কী খেয়েছো ? তোমার মুখে পচা দুর্গন্ধ কেন ?”
“মাইজি ! একটু খেয়েছি” ।
“কী খেয়েছো, সেটাই তো জানতে চাইছি ? বিশ্রি গন্ধ কেন ?” ইমলি উদ্গ্রিব হয়ে জানতে চাইলো ।
“আমার শরম লাগছে । আমি বলতে পারবোক নাই” ।
ইতাস গন্ধটা পেয়েই বুঝতে পেরেছে । কুলিন সোরেন নির্ঘাত মদ খেয়েছে । তাই ইমলিকে ইতাস বললো, “ব্যাঙ্কের স্যুঈপার সাহেব কী খেয়েছে, আমি পরে বলছি” ।
ঝাঁট দিয়ে কুলিন সোরেন চলে গেলো ।
থাকার ভাল ব্যবস্থাপনার জন্য ইতাস মনে মনে রিতম বাবুকে ধন্যবাদ দিলো । ঘেরাও জায়গা । ব্যাঙ্কের বদান্যতায় থাকার জন্য ইলেক্ট্রক লাইট, শতরঞ্চি, রান্নার ব্যবস্থা । ঐদেশে থাকার সময় ব্যাঙ্কের কথা অনেক শুনেছে । কিন্তু কখনও নিজে ব্যাঙ্কিং কাজকর্ম সারতে কোনো ব্যাঙ্কেই কোনোদিন ইতাস ঢোকেনি । শুধুমাত্র শুনে এসেছে, ব্যাঙ্কের বাবুদের অত্যধিক ঠাটবাট । ব্যাঙ্কের বাবুরা ভাল বেতন পান । সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যাঙ্কের বাবুরা সাধারণত মেলামেশা কম করেন । কিন্তু এখানে এসে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কাজকর্ম ও কর্মীদের আচরণ দেখে ইতাস হতবাক ! ইতাস এখানে এসে উপলব্ধি করতে পারলো, ব্যাঙ্কের বাবুরা অনেক ভদ্রলোক এবং যথেষ্ট আন্তরিক । তেমনি তাঁদের মিষ্টি ব্যবহার । ইতাস আর সময় নষ্ট করলো না । কলে স্নান সারলো । তারপর ছুটলো ফল বিক্রেতা গোবর্ধন কলিতার কাছে । গোবর্ধন কলিতা বহুদিন আগে আসামের ডিব্রুগড় থেকে এসেছেন । তাঁর শ্বশুরবাড়ি মন্তেশ্বরে । মন্তেশ্বর একটা থানা এলাকা । কুসুমগ্রামের থানা ও ব্লক অফিস আবার মন্তেশ্বরে । বহুকাল আগে শ্বশুরবাড়ি এসে গোবর্ধন আর আসামে ফিরে যাননি । তখন থেকেই কুসুমগ্রামের বাজারে তাঁর ফলের দোকান । তবে গোবর্ধন বাবুকে সবাই কলিতা নামেই চেনেন । তাছাড়া বাজারের ব্যবসায়ীরা তাঁকে কলিতা নামেই ডাকেন । কলিতা দাদার সাথে ইতাসের এখন সরাসরি সম্পর্ক । কলিতা দাদা বুঝে গেছেন, ইতাস আর যাই হোক অসৎ নয় । তাকে ফল ধার দিলে টাকা শোধ না করে ইতাস পালাবার মানুষ নয় । ইতাস পৌঁছেই কলিতা দাদাকে বললো, “শিগ্‌গির এক ঝুড়ি বারুইপুরের পেয়ারা দেন কলিতা দাদা । আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে । সকালের এক্সপ্রেস বাসগুলি বিশেষ করে কৃষ্ণনগরের, কাটোয়ার, বর্দ্ধমানের, ডানকুনির এক্সপ্রেস বাসগুলি এতক্ষণ কুসুমগ্রাম ছেড়ে চলে গেছে । ঐ বাসগুলিতে বারুইপুরের পেয়ারা বিক্রি ভাল । কলিতা দাদা ইতাসকে বললেন, “তুমি অতো টেনশন করো না, এর পরেও অনেক লোকাল বাস রয়েছে । সারাদিনে তুমি সমস্ত পেয়ারা বিক্রি করতে পারবে” । এইভাবে গোবর্ধন কলিতা ইতাসকে পেয়ারা বিক্রির ব্যাপারে উৎসাহ জোগালো । ইতাস ঝুড়ি মাথায় নিয়েই হাঁকতে শুরু করলো, “পেয়ারা চাই, পেয়ারা । বারুইপুরের পেয়ারা । স্বাদে অতুলনীয়” ।
বেলা তখন দশটা ।
কুলিন সোরেন এসে ইমলিকে বললো, “ম্যানেজার বাবু আপকো বুলা রহা হ্যায়”।
“কী ! তুমি কী বলছো । আমি বুঝতে পারছি না । ম্যানেজার বাবু কী হ্যায়” ?
ম্যানেজার বাবু আপনাকে ডাকিছে ।
“এই যে সোরেন দাদা । আমাদের সাথে বাংলায় কথা বলবে । আমরা বাংলা বুঝতে পারবো” । ইমলি কুলিন সোরেনকে বললো । তারপর সোরেনের দিকে তাকিয়ে বললো, “এবার চলো, ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে দেখা করি” ।
ম্যানেজার বাবুর ঘরে ইমলিকে নিয়ে গিয়ে কুলিন সোরেন বললো, “মেম সাহেবকে ধরে এনেছি” ।
রিতম বাবু ইমলিকে দেখা মাত্র বললেন, “আজ থেকে আপনি ক্যান্টিনের কাজে লেগে পড়ুন” । বলেই ক্যাশিয়ার বাবুকে ডাকলেন ।
ক্যাশিয়ার বাবুকে দেখতে পেয়ে ম্যানেজার বাবু বললেন, “ইমলি ম্যাডামকে ক্যান্টিন ঘর দেখিয়ে রান্নার সরঞ্জাম বুঝিয়ে দিন । আজ থেকে ম্যাডাম রান্না শুরু করুক । এবার ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রিতম বাবু বললেন, “এখন আপাতত এককাপ গরমা-গরম চা হয়ে যাক” ।
ইমলি হেসে বললো, “ঠিক আছে ম্যানেজার বাবু । আমি খুব তাড়াতাড়ি আপনাদের জন্য চা বানিয়ে আনছি” ।
“যখনই যে খাবার বানান না কেন, আপনার খাবার অবশ্যই বানাবেন । আজ থেকে আপনিও আমাদের কুসুমগ্রাম শাখার পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ” । রিতম বাবু ইমলিকে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিলেন ।
সেই সময় কুলিন সোরেন ম্যানেজার বাবুকে উদ্দেশ্য করে বললো, “স্যার আমার ব্যাপারটা আপনি ম্যাডামকে বলে রাখুন” ।
পুনরায় ইমলির দিকে তাকিয়ে রিতম বাবু বললেন, “আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি । আগামীকাল থেকে এক সপ্তাহের জন্য আপনাকে কুলিন সোরেনের জায়গায় কাজ করতে হবে । সকালে অফিস খোলার আগে অফিস ঘর ও চেয়ার-টেবিল ঝাঁড়ু দিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে । বাথরুম সাফা করতে হবে । আর কী কী করতে হবে, সোরেন আপনাকে বুঝিয়ে দেবে । কুলিন সোরেন সাতদিন ছুটি নেবে । ঐ সাতদিন আপনাকে তার জায়গায় বদলী ঝাড়ুদার হিসাবে কাজ করতে হবে” ।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ইমলি ।
ক্যান্টিন ঘরটি নেহাত ছোট নয় । বেশ বড় । ট্যাপের জল । ছাদের উপরে জলের ট্যাঙ্কি । সেখান থেকেই জলের ব্যবস্থাপনা । খাবারের জলের আলাদা ব্যবস্থা । যাকে বলে অ্যাকোয়াগার্ড । গ্যাসের উনুন । ইতিপূর্বে উনুন মাঝে মধ্যে চা বানানোর কাজে লাগতো, অগোছালো উনুনের অবস্থা দেখে সহজেই অনুমেয় । ব্রাঞ্চের ক্যাশিয়ার বাবু ক্যান্টিন ম্যানেজার । তাঁর নির্দেশেই ইমলিকে ক্যান্টিনে দৈনন্দিন রান্না-বান্নার কাজ-কর্ম করতে হবে । ক্যাশিয়ার বাবু অর্থাৎ ননীগোপাল জোয়ার্দার খুব হাসি খুশী এবং মজার মানুষ । প্রথম দিন থেকেই ইমলিকে “বৌদি” ডাকতে শুরু করলেন । ক্যাশিয়ার বাবুকে ব্রাঞ্চের সমস্ত স্টাফ ননীদা সম্মোধনে ডাকেন । তাই ইমলিও তাঁকে ননীদা সম্মোধনে ডাকতে শুরু করলো । তাতে ননীদা কোনো আপত্তি করলেন না । ননীদা ইমলিকে বললেন, “ব্রাঞ্চের সকলেই আপনার ভাইয়ের মতো । এই ভাইগুলির ভাল-মন্দ আপনাকে দেখতে হবে । খাওয়া-দাওয়া, চা ছাড়াও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ভাইদের বিভিন্ন আবদার মেটাতে হবে । কখনই মুখ গোমড়া করে থাকলে চলবে না । অফিসে ম্যানেজার বাবুর পরেই আপনি আমাদের অভিভবাবক” ।
ননীদার কথা শুনে আবেগে ইমলির চোখে জল । মানুষ এত সহৃদয়, ব্যাঙ্কের বাবুদের সাথে না মিশলে ইমলির জীবনে একটা শূন্যতা থেকে যেতো ।
ইমলির নীরবতা লক্ষ্য করে ননী বাবু বললেন, “আপনি কী আমার কথায় রাগ করলেন বৌদি” ?
ইমলি এবার হেসে দিলো । রাগ করবো কেন ভাই । তোমাদের মতো একসঙ্গে অনেকগুলি ভাই পাচ্ছি, এটা আমার জীবনে বড় পাওনা । আপনাদের মতো ভাইদের সান্নিধ্য পেয়ে আমি খুব গর্ব বোধ করছি । কিন্তু ভাই একটা জিনিস আমি বুঝতে পারলাম না ?
“কী সেটা” ? ননী বাবু তৎক্ষণাত ইমলির দিকে তাকালো ।
“বিভিন্ন আবদার” ব্যাপারটা বুঝলাম না ।
ননী বাবু এবার হেসে দিয়ে বললেন, “এটা ক্রমশ প্রকাশ্য । তবুও একটা সূত্র দিই — স্টাফদের জন্মদিন এলে আপনাকে ধুম-ধাম সহকারে পালন করতে হবে” ।
ইমলি হেসে হেসে বললো, “এই কথা ! ভাইদের মনোরঞ্জনের স্বার্থে এটা আমার কর্তব্য” ।
“আমি আসছি বৌদি । কাউন্টারে ভিড় জমে গেছে । সামলাতে হবে । চা তৈরী করে সবাইকে দিয়ে দিন” । ননীদা তারপর ক্যাশ কাউন্টারে চলে গেলেন ।
ইমলি বাড়িতে যে চা বানাতো, সেটা কন্ডেন্সড মিল্কের । ওপারের দেশে চা খাওয়ার দোকানে কন্ডেন্সড মিল্কের ব্যবহার বেশী । এখানে চা-পাতা অন্যরকম । গুড়ো চা ও পাতা চা । ব্রাঞ্চে সকলে পাতা-চা দিয়ে চা খেতে অভ্যস্ত । ইমলির সমস্যা হচ্ছে পাউডার দুধের পরিমান নিয়ে । ওপারের দেশে কন্ডেন্সড মিল্ক ছাড়া শুধুমাত্র গরুর দুধ । এখানে গদাইয়ের দোকানে ইমলি চাক্ষুষ দেখেছে, ডেস্কি বোঝাই দুধ । প্যাকেটের দুধ কেবলমাত্র বাজারে এসেছে, কিন্তু খরিদ্দারদের গরুর দুধ দিয়ে তৈরী চা খেতে পছন্দ । গরুর দুধ দিয়ে চা বানানোর কায়দা গদাইয়ের কাছ থেকেই শিখেছে । পাউডার দুধ দিয়ে এই প্রথম তার চা বানানো । তাই আলাদা জল গরম করে তাতে পাউডার দুধ মেশালো । দুধটার ঘনত্ব বুঝে চা পাতা দিয়ে প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে এককাপ চা নিজের জন্য বানালো । নিজে খেয়ে বুঝতে পারলো, দুধটাতে আর একটু গরম জল মেশালে চায়ের স্বাদ ভাল হোতো । পুনরায় এককাপ চা বানিয়ে ননীদাকে দিয়ে বললো, “চা খেতে কেমন হয়েছে আগে বলুন, তারপর সবার জন্য বানাচ্ছি’ ।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ননী বাবু বুঝতে পারলেন তাঁদের বৌদি অনেক কসরত করে, চা বানিয়েছেন, সত্যিই অতুলনীয় । তাই বৌদির দিকে তাকিয়ে খুশীর মেজাজে ননীদা বললেন, “চলবে মানে ! খুব সুন্দর চলবে” । তারপর আবার বললেন, “পরের লটে যে চা বানাবেন, সেখানেও যেনো আমার জন্য এক কাপ চা বরাদ্দ থাকে” ।
ননীদার কথা শুনে মুচকী হেসে ইমলি ক্যান্টিন ঘরে ঢুকলো ।
রিতম বাবু চা খেয়ে অবাক ! চায়ের ফ্লেভার অপূর্ব । ভীষণ সুস্বাদু চা ।
চা বানানোর পরীক্ষায় ইমলি পাশ ।
ইমলি দুপুরের রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠলো । প্রথমদিন স্বল্প বাজার । ননীদা বলেছেন, পরেরদিন থেকে বাজার করার দায়িত্ব ইমলির । দুপুরে মাছ, মাংস, ডিম যেটাই রান্না হোক, তার ব্যবস্থা ইমলিকেই করতে হবে । প্রথমদিনে ননী বাবু বলেছেন, কোনোরকমে সেদ্ধ-ডাল ভাত হলেই যথেষ্ট ।
বারোজন স্টাফ ছাড়াও সোরেন জানিয়েছে, সে দুপুরে ব্যাঙ্কে খাবে । তাকে নিয়ে মোট চৌদ্দ জনের রান্না ! চাল কতটা লাগবে হিসাবটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না । মসুরির ডাল এক কড়াই রান্নাতে সে সিদ্ধহস্ত । ডাল রান্নায় ইমলি ভীষণ পারদর্শী । সুতরাং ডাল রান্না নিয়ে সমস্যা নেই । কিন্তু চৌদ্দজন স্টাফের ভাত খাওয়ার জন্য সেদ্ধ চাল কতোটা লাগবে সেই সমস্যায় ইমলি চিন্তান্বিত । অবশেষে ননীদাকে ডাকলো । ননীদাও চিন্তান্বিত । তাঁরও এই ব্যাপারে অভিজ্ঞতা জিরো । তাই রিতম বাবুর কাছে গিয়ে আলোচনায় বসলেন ননী বাবু । রিতম বাবু ননী বাবুকে পরামর্শ দিলেন, “আপনি বরং সোনালী মাসির ঘুগনির দোকানে নিজে যান । সোনালী মাসিকে জানালে আশা রাখি তিনি চাল নেওয়ার ব্যাপারটা বোঝাতে পারবেন” ।
ননী বাবু বললেন, “আপনি যথার্থ পরামর্শ দিয়েছেন স্যার” ।
সোনালী মাসি বললেন, “প্রথম দিন এক সের চাল নিতে বলুন । ভাতের পরিমান বুঝে পরেরদিন থেকে রান্নার-মাসি বেশী-কম চাল নিয়ে ভাত রান্না করতে পারবে” ।
মাখানো আলু সেদ্ধ ও পিঁয়াজ দিয়ে মসুরির ডাল রান্না । দুপুরের খাবার খেয়ে সকলেই পরম তৃপ্ত । খুশীতে বিভোর । ম্যানেজার বাবু প্রস্তাব দিলেন, “এত সুন্দর খাওয়ার পর একটা করে রসগোল্লা খেলে ষোলোকলা পূর্ণ হোতো” ।
ক্ষুধার্ত পেটে ভাত খেতে বসে ইমলির ইতাসের কথা মনে পড়লো । বেচারা পেয়ারা বিক্রির মাঝখানে দুপুরের খাবার খেলো কিনা ? এতদিন দুজনে একসঙ্গে হাবিজাবি খেয়ে পেট ভরিয়েছে । তার বারংবার মনে হচ্ছিলো, তার নিজের খাবারটা নিয়ে দুজনে একসঙ্গে বসে খাবে । কিন্তু পরক্ষণেই ইমলির মনে অন্য চিন্তা, ক্যান্টিনে কাজ করার জন্য তার খাওয়াটা ফ্রি । খাবার বাড়ি নিয়ে গেলে, ব্রাঞ্চের স্টাফদের মধ্যে তার সম্বন্ধে ভুল ধারণা জন্মাতে পারে । স্টাফেরা ভাবতে পারেন, ইমলি বৌদি নিজেদের বাঁচাতে ক্যান্টিনের জিনিসপত্র সরাচ্ছেন । তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, তখন প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে দাঁড়াবে । সেটা আরও বিড়ম্বনার । ইমলি মরে গেলেও তার প্রতি ব্রাঞ্চের মানুষের যে অগাধ আস্থা সেটা কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না । যতোটুকু সে বুঝেছে, ব্যাঙ্কের কাজকর্ম বিশ্বাসের উপর চলে । তাই খেতে বসে ইতাসের জন্য চোখের জল ফেলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারলো না । ইমলির মতে ক্যান্টিনের এত ভাল খাবার, তবুও সে পেট পুরে খেতে পারলো না । থালা থেকে ভাতের প্রতিটা গ্রাস তোলার সময় ইমলির বারংবার ইতাসের ক্ষুধার্ত মুখখানা ভেসে আসছে । আর তার দু-চোখ জলে ভরে যাচ্ছে । ননীদা হঠাৎ ক্যান্টিনে ঢুকে লক্ষ্য করলেন, “বৌদি খেতে বসে কান্না করছেন” ।
“একি বৌদি, আপনি কাঁদছেন কেন” ? ননী বাবু সরাসরি বৌদিকে জিজ্ঞাসা করলেন ।
ননীদাকে দেখে ইমলি চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলো না । কান্নার জন্য তার আর খাওয়া হোলো না । থালার অবশিষ্ট ভাতে জল ঢেলে দিলো ইমলি । তারপর কান্না ভেজা গলায় বললো, “এত সুন্দর খাবার মনে হচ্ছে এক যুগ পরে খাচ্ছিলাম । তাই বুকের ভিতর খুব কষ্ট হচ্ছিলো” ।
“না, বৌদি । আপনি যতোই লুকান, খাওয়ার সময় আপনার আপন মানুষের কথা নিশ্চয় মনে পড়ছিলো” ।
ইমলি করুণ দৃষ্টিতে ননীদার দিকে তাকালো ।
ননীদা তাঁর বৌদির করুণ দৃশ্যের মর্ম অনুধাবন করতে পারলেন । তবুও তাঁরও হাত-পা বাঁধা । ননীদা উপযাজক হয়ে বললেন, “সোনালী মাসিকে আমি বলে রাখবো, আপনার স্বামী খিদের সময় অবশ্যই যেনো সেখান থেকে আমার নাম করে খেয়ে যান । মাসের শেষে সেই খাওয়ার বিল আমি মেটাবো” ।
“জোড় হাত করে ইমলি বললো, সেটার দরকার হবে না ভাই । আপনার বড় মনের পরিচয় পেয়ে আমার মনে হচ্ছে, ওপারের দেশ থেকে তাড়া খেয়ে সব হারিয়ে এদেশে এসেও আমরা হারিয়ে যাই নি । বরং ঈশ্বরের অশেষ করুণায়, আপনাদের মতো একটা বড় পরিবার পেয়েছি । এই পরিবার আমাদের কাছে বাঁচার অনুপ্রেরণা । আপনাদের ছত্র ছায়ায় আমরা ধন্য”।
ইমলি তারপর ক্যান্টিন ঘরের ট্যাপের জলে চোখেমুখে জল দিলো । এরপর বিকালের চা বানানোর জন্য ইমলির প্রস্তুতি ।
 ( চলবে )