তখন অনেক রাত। কাকের ডানার মতো নিকষ কালো অন্ধকার। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। শীতের দাপটে কাবু প্রকৃতি এখন গভীর ঘুমে মগ্ন । রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর গুলো রাস্তা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে পোড়ো বাড়ির দালানে ।একটা ঝিঁঝিঁ পোকা ধারাবাহিকভাবে ডেকে চলেছে।
হঠাৎ নবনীতার দরজায় টোকা মারার আওয়াজ। নবনীতার বাড়িতে তার বিধবা মা আর একজন ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ নাই। বাংলায় অনার্স নিয়ে বিএ পাস করে নবনীতা এখন প্রাইভেট টিউশন পড়ায়। তার টিউশন আর ফ্রিডম ফাইটার বাবার পেনশনের কিছু টাকা দিয়েই তাদের সংসারটা মোটামুটি চালিয়ে নেয়।
দরজায় টোকা পড়তেই নবনীতা বুঝতে পারে এত রাত্রে কে আসতে পারে। কারণ এই টোকা মারার ধরনটাও তার চেনা হয়ে গেছে।
ঘুম জড়ানো চোখে দরজাটা খুলতেই চকিতে আবীর তার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সারাদিন ঘরোয়া পরিশ্রমের পর নবনীতার মা এখন ঘুমিয়ে কাদা। ছোট ভাইটারও একই অবস্থা। তাই আবীরের উপস্থিতিটা নবনীতার মা এবং ভাই কেউই টের পেল না।
নবনীতা একটু রাত জেগে পড়াশোনা করে। তার ফেভারিট সাবজেক্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস। ছোটবেলায় বাবার কাছে স্বাধীনতার লড়াইয়ের গল্প শুনেই বোধহয় তার এই ইতিহাস প্রীতি।
ঘরে ঢুকে কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে সিঙ্গল খাটটাতে আবীর বসে পড়ল। অন্যদিনের থেকে আজ তাকে কেমন যেন বিমর্ষ লাগছে।
আবীর আড়মোড়া ভেঙে বলল,
– নীতা এক গ্লাস জল — নবনীতা তাড়াতাড়ি উঠে এক গ্লাস জল নিয়ে আবীরের সামনে ধরতেই একটানে ক্লাসের সমস্ত জল টুকু শেষ করে আবীর একটা আরাম সূচক আ: শব্দ করলো।
এবার নবনীতা মুখ খুলল,
– আজ এত উদভ্রান্তের মত লাগছে কেন? আবীর উত্তর দিলো – – – – -সত্যিই আজ খুব টায়ার্ড। আজ অনেকগুলো মিটিং করেছি।
নবনীতা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে। যাদের বাড়িতে টিউশন পড়াতে যায় পড়ানোর অবসরে তাদের বাড়িতে মাঝেমাঝে টিভির খবরও শোনে তাই বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে তার একটা ধারণা আছে। হঠাৎ বিদ্রূপের সুরে বলে বসল,
– মিটিং করেছো মানে কোন জায়গায় ল্যান্ডমাইন পাতা হবে, কিভাবে পুলিশের বন্দুক ছিনতাই হবে এইতো?
আবীর কেমন অবাক হয়ে যায়। এর আগে তো নবনীতা কোনদিন এইভাবে কথা বলেনি! হঠাৎ কি হলো!
– নীতা তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?
– কেন বলবো না বলো? তুমি এখন পুলিশের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড। তুমি কি জানো আমার এখানে তোমার আসাটা কতখানি রিস্কি? আমাদের বাড়িটার উপর নজরদারি করতে পুলিশের স্পাই লাগানো আছে?
আবীর হাসতে- হাসতে বলল,
– তা থাকতে পারে তবে এই শীতের রাতে একটা কুকুরও জেগে নাই,আর স্পাইরা তো মানুষ নাকি?
– তুমি হাসতে পারো, কিন্তু জানো কি প্রতিদিনের প্রতিটি ক্ষণ আমি কী গভীর উৎকণ্ঠায় থাকি। যদি তোমার কিছু হয়ে যায়? -হোক না। কী হবে বড়জোর মৃত্যু। কবি বলেছেন, জন্মালে মরিতে হবে অমর কে কোথা—-
নীতা আবীরের মুখটা চেপে ধরে।
– না ওকথা নয়, আমার অনুরোধ তুমি তোমার রাস্তা বদল করো।
-কি বলছো নীতা !
-হ্যাঁ, তুমি যে রাস্তায় হাঁটছো ও রাস্তা কোনদিনই তোমাকে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে না। তোমার ধারণা ভুল। তুমি জানোনা আসলে তুমি কী চাও। -আমি যে যৌথখামারের স্বপ্ন দেখি। একটা শ্রেণি ঐশ্বর্য্যের পাহাড়ে সুখ নিদ্রায় মগ্ন থাকছে আর একটা শ্রেণি এক মুঠো ভাতের জন্য হাহাকার করছে। একবাটি ফ্যানের জন্য মা তার শিশু সন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে —
– আসলে আমাদের টোটাল সিস্টেমটাতেই তো গলদ।
– এ সিস্টেম আমি বদলাতে চাই।
– তোমার একার দ্বারা কখনো তার সম্ভব নয়। -কে বলেছে আমি একা? এদেশের হাজার হাজার মানুষ আমার সঙ্গে আছে।
– তারা সবাই তোমার মতই লক্ষ্যবিহীন।
– কে বলেছে? প্রভাত দা? যে মানুষটা ফিজিক্সে ডক্টরেট, জীবনে প্রচুর টাকা -পয়সা গাড়ি -বাড়ি সবই করতে পারতো। সেইসবের মোহ ছেড়ে সেও কেন— ?
– আমি জানিনা, প্রভাতদা কী চান।কিন্তু আমি চাই একটা নির্ভরতা একটা স্থিতিশীলতা ছোট্ট মাটির ঘরের উঠোনে একটা তুলসীমঞ্চ।
মৃদু আলোতে আবীর দেখতে পাচ্ছে নবনীতার দুচোখ সজল। গলার স্বরে করুণ আর্তি।
– এ কী নীতা তুমি ভেঙে পড়ছো কেন? তুমি তো আমার এগিয়ে চলার গতি।
– জানিনা কতদিন এইভাবে থাকতে পারবো।
– এ কথা বলছো কেন? আমার উপর কি বিশ্বাস রাখতে পারছ না?
– তা কেন। আসলে সমাজে থাকতে গেলে কিছু সামাজিক রীতি নীতি কে অবলম্বন করে থাকতে হয় ।তাছাড়া লোকাল নেতৃত্ব আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে, তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে ওরা নাকি আমার অনেক ক্ষতি করে দেবে।
নবনীতার মুখে কথাগুলো শুনে আবীর এখন রাগে ফুঁসছে। ইচ্ছে করছে এখনই সেই শয়তানগুলোকে ভোগে পাঠিয়ে দিতে। কোন রকমে নিজেকে সংযত করে বলল,
– ঠিক আছে, আমি আর তোমার কাছে আসবো না।
নবনীতা নিরুত্তর। কেবল দু চোখের কোনণ জল চিকচিক করছে। রাত শেষ হয়ে কখন যে ভোর হয়ে গেছে দুজনেরই খেয়াল নাই। সকাল হওয়ার আগেই আবীরকে বেরিয়ে পড়তে হবে। প্রথমে দেখা করতে হবে প্রভাতদার সঙ্গে। হঠাৎ দরজায় টোকা মারার আওয়াজ শুনে নবনীতা এবং আবীর দুজনেই কেমন আঁতকে উঠলো। আবার টোকা। নবনীতা এবং আবীর একে অপরের দিকে তাকালো।
এক সময় দরজা খুলে দিয়ে নবনীতা দরজাটা আটকে দাঁড়ালো।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর জি পার্টির কিছু ষন্ডামার্কা যুবক। তাদের সঙ্গে আছে খাকি উর্দি পরা কয়েকজন মানুষ। সমবেতদের মধ্যে থেকে একজন কেউ বলে উঠলো,
– মাগীটা খুব সতীপনা দেখায়, এদিকে একজন দাগী মালকে নিয়ে সারা রাত ঘর বন্ধ করে ফস্টি নস্টি হচ্ছে। এতোই যদি শখ আমাদের কাছে গিয়ে বললেই পারতিস।শখটাও মিটতো আর পয়সাও ইনকাম হত।
নবনীতার সারা শরীর লাল হয়ে উঠছে। মাথার ভিতর একটা আগুনের আঁচ যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আবীরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মেঝেতে ফেলে রাখা ব্যাগটাতে হাত ঢুকিয়ে সে, কি যেন বের করার চেষ্টা করছে। নবনীতার ইশারায় আবীর নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
দুজন খাকি উর্দি পরা মানুষ তার দিকে এগিয়ে গেল।
এতোক্ষণে গায়ত্রী দেবী এবং তার ছেলের ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম জড়ানো চোখে বাইরে এসে দেখে নবনীতা উঠোনে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছে। একদল লোক সমানে কটুক্তি করে চলেছে। একটা পুলিশের জীপ লাল ধুলো উড়িয়ে মোরাম রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে।
রাস্তা : সমীর ঘোষ।

Leave a Reply