ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার নামে দেশভাগ এবং পরবর্তী দেশভাগ আর স্বাধীনতা দিবস :: কামনা দেব।।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা যখন লাভ করে , তা হয় ধর্মের বিভাজনে ভারত ও পাকিস্তান৷ এই বিভাজন এমনভাবে করা হয় যা এখনও দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে রয়ে যায়  সীমানা বিরোধ ও পারস্পরিক অবিশ্বাস৷ এই দেশভাগের ক্ষত এখনো শুখোয়নি ,বরং ক্যান্সারের মত ক্ষত বেড়েই চলছে।
যে অবিশ্বাস ব্রিটিশরা ধর্মের মাধ্যমে বীজ পুঁতে গেছে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে ,তা আজ বিরাট মহীরূহ রূপ ধারণ করেছে।

ঐ দেশভাগ ছিল স্বহিংস। তাতে দশ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল আরো কয়েক লক্ষ মানুষকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল নিজ জন্মস্থান৷ যা ঐশ্বর্যশালী নানা মত , নানা ধর্ম, নানা পরিধান ও সংস্কৃতির ভারত উপমহাদেশকে ভাগ করে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে, অবিশ্বাস ও অনৈক্যের যুক্তি দিয়ে জোর করেই জন্ম দিয়েছিল “পাকিস্তান” নামের দেশটি। যা জন্ম থেকেই দাঙ্গা,যন্ত্রণা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার। আর এই কষ্ট আজো  শেষ হয়নি৷ ঘা রয়ে গেছে, সেই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের মধ্যরাতের মতোই দগদগে৷

দেশভাগ ও স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যেই বোঝা গিয়েছিল,বিভাজিত নতুন দুই রাষ্ট্র ভারত আর পাকিস্তানের সম্পর্ক। যার শুরু হয় কাশ্মীর কার দখলে থাকবে এ নিয়ে দুই দেশের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাওয়া।


কাশ্মীর ছিল হিন্দু মহারাজার অধীনস্থ। তাই হিন্দু মহারাজার কাছ থেকে কাশ্মীরকে মুক্ত করতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সহযোগীরা স্থানীয় যোদ্ধাদের কাশ্মীরে পাঠান ৷ এর ফলশ্রুতিতে ভারত সৈন্য পাঠিয়ে কাশ্মীরের বেশিরভাগ দখলে নেয়। আর বাকিটা পাকিস্তান দখল করে। এই কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। আর সম্পর্ক উন্নয়নের প্রধান বাঁধাই এই কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ৷
পাকিস্তান ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদতে একসময়ের সেক্যুলারিজম এবং জাতিগত বিরোধকে ধর্মীয় বিরোধের রূপ দেয়৷ যা দেশভাগের আগুন হয়ে এখনো জ্বলছে দুই দেশের মধ্যে।

এরপর ১৯৪৮ সালে আফগানিস্তান নিয়েও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও পাকিস্তান ৷ ব্রিটিশরা সেই দেশটিতে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও প্রতিবেশীর দিকে নজর ছিল স্বাধীন দুই রাষ্ট্র ভারত পাকিস্তানের। তাই অন্য দেশকে চাপে রেখে আফগান সরকারকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছিল।
এদিকে পাকিস্তানের পশতুনরা জিন্নাহর কর্তৃত্বে ভীষণ রাগ ছিল, অন্যদিকে আফগানিস্তান ছিল পশতুন শাসিত৷ এই কারণে পাকিস্তানের ভয় ছিল, আফগানিস্তানে ভারতপন্থি সরকার এলে পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে৷ আফগান দ্বন্দ্বের শুরু সেখানই৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখলের পর সেই দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ ধরে।
শুরুর বছরগুলি দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতি তাদের অভ্যন্তরীণ নীতিতেও প্রভাব ফেলেছে৷ আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা, ইতিহাস, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা এমনকি মনোজগতেও অবিশ্বাস ধীরে ধীরে আসন গেঁড়ে বসে৷পশ্চিমে রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ হলেও পূর্বে তেমনটা হয়নি।

এদিকে আবার আরেক দেশভাগ! বর্তমানের বাংলাদেশের জন্ম। পূর্ব পাকিস্তানে যা বর্তমানে বাংলাদেশ, সেই বাঙালিরা তখন নিজেদের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছিল সোচ্চার। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শুরুতেই তাঁদের ‘ভারতের দালাল’ বলে আখ্যা দেয়৷


মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও ভারতের সীমান্তে অবস্থানরত, ভারতবর্ষের অংশে বাংলার এবং বাঙালি হিন্দুদের সাথে ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনে সন্দেহ গভীর করে তোলে৷ পশ্চিমে রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ হলেও পূর্বে তেমনটা হয়নি৷ মজার ব্যাপার হলো, সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এই বাংলাতেই৷ কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘুদের আইনি ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখা জিন্নাহের উত্তরসূরিরা হাঁটলেন ঠিক উল্টো পথে৷ পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ বাঙালিদের দাবি  মানতে অস্বীকৃত হলেন। বলপ্রয়োগে তাদের দমন করতে চাইলেন বাঙালিদের৷ এর ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ। আর এরই ফলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় বাংলাদেশ৷
ঠিক ২৪ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় দেশভাগ৷ এই রক্তক্ষয়ী দেশভাগে নিহত হয় প্রায় ত্রিশ লক্ষ  বাঙালির৷  লুঠতরাজ, ধর্ষণ করা হয় হাজার হাজার নারীকে, হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের, পুড়িয়ে দেয় ঘরবাড়ি৷
আর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কখনোই ক্ষমা চায়নি ইসলামাবাদ তথা পাকিস্তান। বরং ভারতকেই দায়ী করে পাকিস্তান ভাঙার জন্য আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে । দ্বিতীয় দেশভাগও ছিল পারস্পরিক ভীতির ফল৷ জিন্নাহ এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতারা ১৯৪৭ সালে যে ‘শত্রু’ তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন, ১৯৭১ সাল তারই ফল৷

এখন জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতার উদযাপন করছে৷ কিন্তু দেশের জনগণের তেমন কিছু নেই৷ দুই দেশই যখন পারমাণবিক শক্তি সামরিক ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রদর্শনে ব্যস্ত, তখন দেশের জনগণের অনেক মৌলক চাহিদাই পূরণ হয় নাই এখনো। এরপর তো যুদ্ধবাজি চলছেই, ভারতের ভাগ নিয়ে জনগণকে দিচ্ছে ভুল ইতিহাস৷
দেশভাগের এই ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবস। এই দেশ ভাগের ইতিহাস আর কখনোই পাল্টানো যাবে না, কিন্তু পরস্পরের মধ্যে ঘৃণার দেয়ালটা ভাঙা যাবে যদি রাষ্ট্রের নেতারা চায় আন্তরিক ভাবে।

১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতেই হলো ভারত বিভাজন বা দেশভাগ। ব্রিটিশ ভারত ভেঙে হয়ে যায় পাকিস্তান ও ভারতবর্ষ নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। পরবর্তীকালে আবারও পাকিস্তান দ্বিধাবিভক্ত বা বিভাজন  হয়ে হয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামে হয় দুটি রাষ্ট্র।

প্রতি বছরই ১৪ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে পাকিস্তান আর ভারতবর্ষ করছে ১৫ই আগস্ট।
(তথ্য ভিত্তিক)
——————————————————————-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *