স্বাস্থ্যকর্মী হলেও দীর্ঘ ষোল বছর ধরে পটচিত্রের দুর্গা গড়ছেন মেদিনীপুরের এক শিল্পী সুজিত দাস,চক্রবর্তী পরিবারে শোভা পাবে পটচিত্রর দুর্গা।

পশ্চিম মেদিনীপুর, নিজস্ব সংবাদদাতা:-  একদিকে তিনি স্বাস্থ্যকর্মী,আবার আরেক দিকে শিল্পী। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ক্ষীরপাই হাসপাতালে কর্মরত তিনি।পেশা এবং নেশার টানে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরেই ছবি এঁকে যান ওই শিল্পী। বাড়িতে এক ছেলে ও স্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে ছবি আঁকার পারদর্শিতায় পরিচিত মুখ মেদিনীপুর শহরে।তৈরি করা এই পটের দুর্গা শোভা পাবে ঐতিহ্যশালী পুরানো রাখাল চক্রবর্তীর বংশধরের পূজোতে। তবে এই দুর্গা আর দশটা মা দুর্গার মত কাঠ,খড়,মাটির প্রলেপ দিয়ে সুসজ্জিত দুর্গা নয়।এই দুর্গাকে বইতে গাড়ি ঘোড়া আনতে হয় না।এই দুর্গা হয় পটের এবং ৬ ফুট বাই ৬ ফুট আকর্লিক কাগজ দিয়েই এই প্রতিমা তৈরি করেন শিল্পী নিজের হাতে।এবারে সেই কাগজের ওপর তুলির টানে ফুটে উঠেছে মা দুর্গার রূপ।এক মেড়ের মধ্যেই থাকছে মা দুর্গা।দুর্গার পাশাপাশি লক্ষী,গণেশ কার্তিক সরস্বতী এবং অসুর।এবারের এই মেড়ে কিছু গহনার কাজও করেছেন নিজে হাতে, বাবার কাজে হাত মিলিয়েছে তার ছেলে। দীর্ঘকাল ধরেই করে আসছেন এই পটের দুর্গা।তবেও এই দুর্গা মূলত শোভা পাবে মেদিনীপুর শহরের মিঞা বাজারের রাখাল চক্রবর্তী পরিবারে। ইতিহাস সম্বন্ধে বলতে গেলে এই ঐতিহ্যশালী পূজো নিয়ে বলা যায় মেদিনীপুর শহরের পরিচিত মুখ হলো মিঞা বাজারের রাখাল চক্রবর্তীর বাড়ি। তাঁদের বাড়ির এই পুজো শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর অধিক আগে।রাজ আমলের এই পুজো কিন্তু প্রতিমা গড়ার অনুমতি ছিল না পরিবারের। তাই পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুটের পটচিত্রে প্রথম পুজো শুরু করেন রাখাল চক্রবর্তী।তিনি নিজেই ছিলেন রাজপুরোহিত।এই পুজোর বৈশিষ্ট্য হলো আমিষ ব্যঞ্জনে মায়ের ভোগ নিবেদন থেকে প্রসাদে ল্যাটা মাছ পোড়া।অন্যান্য দুর্গার থেকে এই বাড়ির দুর্গা সিংহবাহিনী। আর পাঁচটা জায়গার মতোই এই বাড়ির পুজো শুরু হয় ষষ্ঠীতে।ওই দিন পুজোর প্রধান নৈবেদ্য হল ভাত, রুই মাছের ঝোল-সহ পঞ্চব্যঞ্জন ৷এরপর সপ্তমীর ভোরে সাতটি কুয়োর জল দিয়ে অভিষেক করিয়ে মাকে মন্দিরে ঢোকানো হয়।সকল সন্তানের মঙ্গল কামনায় বলির প্রচলন থাকলেও চক্রবর্তী বাড়ির পুজোয় ছাগল বা অন্য কোনও পশুর বলি দেওয়া হয় না।এখন পশু বলির পরিবর্তে চালকুমড়ো বলি দিয়ে নিয়মরক্ষা করা হয় চক্রবর্তী পরিবারে ।সপ্তমী থেকে নবমী টানা তিনদিন ধরে চলে মহাযজ্ঞ।অষ্টমীতে ১০৮টি নীলপদ্ম অর্পণ করে মায়ের পুজো হয়।নবমীর দিন মাকে নিরামিষ অন্নের ভোগ দেওয়া হয়।শেষ দশমীতে ফল-মূল ও ফুল দিয়ে পুজো করা হয়।এই দিনই মাকে নৈবেদ্য হিসাবে ঝিঙ্গে পোড়া আর ল্যাটা মাছ,শোল মাছ পোড়া অর্পণ করা হয়।যদিও প্রথা মেনে পটের দুর্গার বিসর্জন হয় দশমীতেই। পুরানো রাজ আমলে মহা ধুমধাম করে বিসর্জন করা হত চক্রবর্তী বাড়ির এই পুজো।ঝলমলে শোভাযাত্রায় থাকত সুসজ্জিত হস্তিবাহিনী।আজ আর অবশ্য বিসর্জনে হাতি আনা হয় না। তবে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে আজও মা দুর্গার নিরঞ্জন হয়।গত ১৫০ বছরের অধিক ধরে এভাবেই পুজোয় কিছু কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে এই দিন শিল্পী সুজিত বাবু জানান জীবনের উদ্দেশ্য হল ছবি আঁকা আর শুধু আঁকায়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরেই চক্রবর্তী পরিবারে এই কাগজের পটচিত্রের ছবি করে আসছি।তবে এবারে আকর্লিক পেপার এর উপর রংয়ের প্রলেপ দিয়ে এবং ডাকের গহনা নতুন করে ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষকে স্বাস্থ্যের পাশাপাশি ছবি শেখানোটাই মূল উদ্দেশ্য আমার। এই দুর্গার পাশাপাশি আমার ছবি মুম্বাই ও তেলেঙ্গানায় গিয়েছে সম্প্রতি।ডাক পেয়েছি বেনারস থেকে ছবি আঁকার জন্য। তবে ঐতিহ্যশালী রাখাল চক্রবর্তীর বর্তমান বংশধর নন্দন চক্রবর্তী বলেন পুরানো রীতি-নীতি অনুযায়ী পুজো হয়। ওই বাঁশ মাটি দিয়ে ঠাকুর গড়ে নয়,বরং কাগজের পটচিত্রের মাধ্যমে এবং এই ঠাকুরই বিসর্জন হয় শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে।তবে আগের মতন রাজার রাজড়াদের আধিপত্য নেই কিন্তু রীতিনীতি রয়ে গেছে সেই আমলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *