ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য’র প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

0
36

বাংলা সাহিত্যে নারীর নিজস্ব পরিচয় আদায় করে নেওয়া এক জেদী লেখিকা, সুচিত্রা ভট্টাচার্য।

বাংলা সাহিত্যের জগতে এক উল্লেখযোগ্য নাম সুচিত্রা ভট্টাচার্য।  সাহিত্যে তাঁর আবাদান আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।  ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি ভারতের বিহারের ভাগলপুরে মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সুচিত্রা ভট্টাচার্যরা মোট পাঁচ ভাই-বোন ছিলেন- দুই বোন ও তিন ভাই। সুচিত্রা ছিলেন সবার বড়। ছোটবেলায় নাচ শিখতেন তিনি। ছয় বছর বয়েসে তপন সিনহা পরিচালিত বিখ্যাত ‘কাবুলিওয়ালা’ চলচ্চিত্রে ছোট্ট মিনির বন্ধুর চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন তিনি।

ইউনাইটেড মিশনারি গার্লস হাইস্কুলে তাঁর প্রথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। সেখানেই স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম ছড়া বের হয়, ‘চড়ুই’। তার স্কুল ও কলেজ জীবন কাটে কলকাতা শহরে ।  কলকাতা শহরের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে স্নাতক হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সময় তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।

ছোটোখাটো বিভিন্ন বেসরকারি অফিসে চাকরির মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।  বিভিন্ন স্থানে চাকরি করার পর তিনি সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু লেখার প্রতি তাঁর অমোঘ টান ছিল সর্বদা। তাঁর পরিচিতি সাহিত্য রচনার মাধ্যমে। চাকরির অবসরে গল্প লিখতে লিখতেই তাঁর বড় হওয়া। তাই সাহিত্যেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে, লেখিকা হিসেবে সম্পূ্র্ণ রূপে সময় দিতে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।

সমকালীন সামাজিক ঘটনাগুলির ওপর ভিত্তি করে তার কাহিনীগুলি রচিত হয়। শহুরে মধ্যবিত্তদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, বর্তমান যুগের পরিবর্তনশীল নীতিবোধ, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে নৈতিক অবক্ষয়, নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণা তার রচনাগুলির মূল উপজীব্য ছিল। তিনি বাংলা সাহত্যে মিতিন মাসি নামক মহিলা গোয়েন্দা চরিত্রের স্রষ্টা, এবং এই সিরিজে তিনি অনেকগুলি কিশোর উপন্যাস রচনা করেন। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে তিনি বহু ছোট গল্প ছাড়াও চব্বিশটি উপন্যাস রচনা করেছেন।  বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষের দিকে ছোট গল্প ও আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে উপন্যাস রচনায় মনোনিবেশ করেন।

   বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর ‘দহন’ নামক বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া, শিবপ্রসাদ মুখার্জি এবং নন্দিতা রায়ের পরিচালনায় ‘ইচ্ছে’; ‘রামধনু’; ‘অলীক সুখ’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলি সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস অবলম্বনেই নির্মিত হয়েছে।তাঁর রচনা বারেবারেই হয়ে উঠেছে টলিউডের বহু ব্যবসা-সফল ছবির চিত্রনাট্য৷‌

সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কলম বারেবারেই কথা বলেছে নারী মনস্তত্ত্ব নিয়ে৷‌ নারীদের এক জন হয়ে তাদের নিজস্ব জগতের কথা, যন্ত্রণা, সমস্যা আর উপলব্ধির কথাই তিনি তাঁর লেখায় শোনাতেন পাঠকদের। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্কের নানা দিক উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।

নারীর জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, অনুভূতিগুলোও হল তাঁর লেখা গল্প ও উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। ছোটগল্প রচনার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেছিলেন। পরবর্তিতে তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো তাঁকে লেখক হিসেবে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।

সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল-

কাচের দেওয়াল, হেমন্তের পাখি, নীল ঘূর্ণি, কাছের মানুষ, দহন, অলীক সুখ, গভীর অসুখ, অন্য বসন্ত, উড়ো মেঘ, ছেঁড়া তার, আলোছায়া, পরবাস, পালাবার পথ নেই, ভাঙ্গন কাল, আয়নামহল, মারণ বাতাস, তৃষ্ণা মারা গেছে, সহেলী, আমি রাইকিশোরী, রঙিন পৃথিবী, জলছবি, যখন যুদ্ধ।


পুরস্কার–

সাহিত্যসাধনার সম্মান হিসেবে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন।

নঞ্জাগুডু থিরুমালাম্বা জাতীয় পুরস্কার, ব্যাঙ্গালোর (১৯৯৬); কথা পুরস্কার (১৯৯৭),  ত্রিবৃত্ত পুরস্কার (১৯৯৮), সাহিত্যসেতু পুরস্কার (১৯৯৯), তারাশংকর পুরস্কার (২০০০), দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কার (২০০১),  শরৎ পুরস্কার (২০০২),  ভুবনমোহিনী মেডেল (২০০৪), শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (২০০৪), ভারত নির্মাণ পুরস্কার (২০০৪), সাহিত্য সেতু পুরস্কার (২০০৪), মতি নন্দী স্মৃতি পুরস্কার (২০০৯)।

মূলত মধ্যবিত্ত সমাজ সংসারে বড় হওয়া মেয়েদের জীবন যন্ত্রণার প্রতিটা ঘটনা, আক্ষরিকভাবে তাঁদের জীবন সংগ্রামের ইতিবৃত্ত সাহিত্যের মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরার মহান কাজটি তিনি নিরলসভাবেই করেছেন তিনি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। ২০১৫ সালের ১২ই মে রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে তার বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়।

।।তথ্য : সংগৃহীত উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট।।