রাজা মানসিংহের সঙ্গে অগ্রদাসজী কেমন আচরণ করলেন ? : ড. রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।।

‘ভক্তমাল’ গ্রন্থের লেখক শ্রীনাভাজীর গুরুদেব ছিলেন শ্রীঅগ্রদাসজী । তিনি রামানন্দী সম্প্রদায়ের ভক্ত-মহাত্মা ছিলেন। অগ্রদাসজী অনুক্ষণ হরিসেবায় মত্ত থাকতেন। তাঁর ভজন জীবনটি ছিল তৈলধারার ন্যায় । অর্থাৎ, তেলের প্রবাহের ন্যায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে সারাদিনরাত্রি ব্যাপী তিনি নিবিষ্ট থাকতেন ভজনে। সদাচারী তো ছিলেনই , তার সঙ্গে সাধুমার্গে যা যা করণীয়—- সেই সকল ভজন অনুকূল প্রসঙ্গেই তাঁর ছিল ঐকান্তিক চেষ্টা। হরিভক্তির মূল যে সকল কর্মে প্রবেশ করতো সেসব কর্মেই কেবল তাঁর আগ্রহ থাকতো । প্রেমরাগেই কেবল তাঁর হৃদয়তন্ত্রীতে ঝংকার উঠতো। অন্য কোন রসের আভাস সেখানে অনুমাত্রও স্থান পেত না। তাঁর নির্মল রসনা সদা সর্বদা কেবল রাম নামে মত্ত থাকত। আর নয়নে বর্ষার বারির ন্যায় প্রেমনীর নির্গত হতে থাকতো। তাঁর শুদ্ধাভক্তি বড়ই অনুপম ও অপ্রতিম ছিল।

*

জয়পুরের নরেশ তখন রাজা মানসিংহ। তিনি মহাত্মা অগ্রদাসজীর ভক্তিগুণের কথা লোকমুখে শুনেছেন। সেসব শুনে তাঁর সাধ হয়েছে একবার অগ্রদাসজীকে দর্শন করার। একদিন তাই তিনি এলেন অগ্রদাসজীর সাথে দেখা করতে। চরণদর্শন করে তাঁর আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবেন—এই বাসনা। এখন, তিনি তো রাজা ! তাই, বিবিধ প্রকার পূজানৈবেদ্য ও উপঢৌকন নিয়ে অনেক দাস-দাসী , সেনাসহ সুসজ্জিত হয়ে বিশাল বৈভব প্রদর্শন করে এসে হাজির হলেন অগ্রদাসজীর আশ্রম প্রাঙ্গণে।

*

অগ্রদাসজীর আশ্রমটি ছায়া সুনিবিড় অরণ্যরাজীর মধ্যে এক নির্জন বিস্তীর্ণ প্রান্তরে । প্রতিদিনই অরণ্যের বৃক্ষের পত্র ঝরে পড়ে অঙ্গনে । অপূর্ব সুস্নিগ্ধ পরিবেশ । সেসময় অগ্রদাসজী মুখে রামনাম নিতে নিতে লীলাস্মরণ করছিলেন আর একটি ঝুড়ি হাতে নিয়ে তাতে অঙ্গনে পড়ে থাকা গাছের পাতাগুলি কুড়িয়ে নিয়ে রাখছিলেন। ঝুড়িটি ভরে গেলে সেটি দূরবর্তী একটি গর্তে উপুর করে এসে পুনরায় পাতা কুড়োচ্ছিলেন। ঠিক এই সময় মানসিংহের আগমন। অগ্রদাসজী বৈভব দেখে বুঝলেন, কোন রাজা এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থান ত্যাগ করে দূরের একটি বৃক্ষতলে গিয়ে অন্য দিকে মুখ করে বসে পড়লেন।

*

রাজা মানসিংহ বিচক্ষণ। তাঁর অনুধাবন করতে অসুবিধা হলো না যে তাঁর আগমনে অগ্রদাসজী এতটুকুও আনন্দ পান নি । মানসিংহের সাহসে কুলোলো না দূরে ওই বৃক্ষতলে গিয়ে প্রণাম নিবেদন করার অগ্রদাসজীকে। তিনি তাই আপন স্থানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। স্বভাবতঃই, তাঁর সঙ্গের দাসদাসী, সেনাও স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে। বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হয়ে গেল। আগ্রদাসজীও আসেন না , মানসিংহও যান না।

*

এমন সময় নাভাজী সেইস্থানে এসে উপস্থিত। কোন কার্যবশতঃ তিনি বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন । রাজা মানসিংহকে সেনাসহ ওভাবে নিথর ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন অত্যন্ত। মানসিংহ জানালেন যে, আসলে তিনি আসামাত্র তাঁকে দেখেই অগ্রদাসজী দূরে ওই বৃক্ষতলে চলে গিয়েছেন । এ কথা শুনেই নাভাজী অনুভব করলেন নিজের গুরুদেবের এমন আচরণের কারণ কী হতে পারে। তিনি বললেন, আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন মহারাজ । আমি আপনার কথা ওঁনাকে গিয়ে জানাচ্ছি । যদি ইঙ্গিত দেই তবে আসবেন নিকটে। মানসিংহ হেঁটমুণ্ডকে সম্মতি জানালেন ।

*

নাভাজী বৃক্ষতলে এসে অগ্রদাসজীকে প্রণাম নিবেদন করে বললেন , “গুরুদেব, আপনাকে প্রণাম জানাতে, আপনার দর্শনকৃপা পেতে জয়পুরনরেশ স্বয়ং মানসিংহ এসেছেন কতদূর থেকে। আপনি যদি একটিবারের জন্য অন্ততঃ তাঁকে কৃপা না করেন , রাজা বড় ব্যথিত হবেন। আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি গুরুদেব, আপনি রাজাকে একটু আশীর্বাদ করুন অন্ততঃ।” এ কথা বলেই নাভাজী সাষ্টাঙ্গে পুনরায় প্রণাম অর্পণ করলেন অগ্রদাসজীকে ।

*

প্রিয় শিষ্যের কথায় মন নরম হল অগ্রদাসজীর । তিনি মানসিংহের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। মানসিংহ এতক্ষণ চাতক পক্ষীর ন্যায় তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে ছিলেন স্বামী অগ্রদাসজীর দিকে , যদি একবার চোখ ফেরান— এই আশায়। তাই অগ্রদাসজী তাকাতেই ভূমিতে শুয়ে পরে প্রণাম নিবেদন করলেন তিনি। চোখ ও ভ্রূ-র ভঙ্গীতে প্রণাম গ্রহণ এবং আশীর্বাদ করলেন অগ্রদাসজীও। কিন্তু ,নিকটে গেলেন না, বা, এই আদেশও কলেন না যে মানসিংহকে কাছে আসার। অতঃপর, জয়পুর নৃপ মানসিংহ সকলকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন ।

*

এখন, প্রশ্ন হচ্ছে যে, অগ্রদাসজী রাজা মানসিংহের সঙ্গে এমন আচরণ করলেন কেন? ঠিক এমনই আচরণ আমরা করতে দেখেছি শ্রীমন্‌ কৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুকেও । তিনিও উৎকলরাজ প্রতাপাদিত্যকে দর্শন দিতে চান নি। আসলে , বিষয়ী লোকেদের সংস্রবে মনে বিষয়ের প্রভাব পরে। তাই, সন্ন্যাসীদের রাজদর্শন নিষিদ্ধ। সাধু মহাত্মাদের চরিত্রের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁরা সকল মানুষকে সমান ভাবে দেখেন। বিত্তবানদের প্রতি কোন পক্ষপাত থাকে না ব্যবহারে ।

*

আজ অগ্রদাসজীর কথা যা আমরা জানলাম, এমনই নিরপেক্ষ হয় সাধুর স্বভাব। রাজ অনুরোধ-উপরোধ-অনুগ্রহ কোন আশাই তাঁরা করেন না। তাঁদের কাছে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিও যা আবার একজন দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষও তা। আপন-পর-ভেদ নেই ভাবনায়। রাজা, প্রজা বা দাস বলে কোন বিশেষ সমীহ সম্মান জ্ঞান বা অবহেলাও থাকেনা আলাদা ভাবে , আচরণে। সকলেই সমাসনে এক সম্মান পান তাঁদের থেকে। ঠিক যেমন স্বামী অগ্রদাসজীর চরিত্র ! শ্রীহরি ভজন লালসাই তাঁদের একমাত্র উপজীব্য। আর তাই , বিষয়ের বৈভব দেখলে তাঁরা দূরে সরে যান।

অগ্রদাসজীর মতন এমন ভক্ত মহাত্মার শ্রীচরণে শত কোটি প্রণাম অর্পণ করে এমন বিষয়-স্পৃহাহীনতার প্রার্থনা জানালাম।