বাঁকুড়ার অন্যতম প্রাচীন পুর শহর সোনামুখীর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ‘হটনগর’ কালী পুজো।

বাঁকুড়া, নিজস্ব সংবাদদাতা:-  ‘কালী-কার্তিকের দেশ’ হিসেবে পরিচিত বাঁকুড়ার অন্যতম প্রাচীন পুর শহর সোনামুখী। তাঁর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ‘হটনগর’ কালী পুজো। সারা বছর এখানে নিত্য পুজো হলেও কার্তিক মাসের অমাবস্যায় তিথি মেনে বিশেষ বাৎসরিক পুজোর আয়োজন করা হয় এখানে।

বাঁকুড়ার প্রাচীন কালী পুজোর মধ্যে ‘হটনগর কালী’কে নিয়েও নানা লোককথা প্রচলিত আছে। তাঁর মধ্যে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। সাড়ে চারশো বছর আগে সোনামুখী ছিল জঙ্গলে ঘেরা। সোনামুখীতে তারিণী সূত্রধর নামে এক বৃদ্ধা প্রতিদিন জঙ্গল পথ পেরিয়ে ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বড়জোড়ার নিরশা গ্রামে চিড়ে বিক্রি করতে যেতেন। আবার পায়ে হেঁটে ফিরতেন সোনামুখীতে। বৃদ্ধা তারিণী সূত্রধর বাড়ি ফেরার পথে একটি খালের ধারে বসে বিশ্রাম নিতেন। সেখানে প্রায় দিনই লাল পাড় শাড়ি পরা একটি ছোট্ট শ্যামাঙ্গী মেয়ে তাঁর সঙ্গে সোনামুখী যাওয়ার জন্য বায়না করতো। বৃদ্ধা প্রতিদিনই কিছু না কিছু বলে ওই ছোট্ট কন্যা শিশুটিকে ভুলিয়ে রাখতেন। শেষে এক দিন সে জেদ ধরে বসল। বৃদ্ধার সঙ্গে সে সোনামুখী যাবেই যাবে। তখন নিরুপায় তারিণী সূত্রধর তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে সম্মত হলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর ঐ ছোট্ট মেয়েটি জানায় সে আর হাঁটতে পারছে না। কোলে নিতে আবদার জানায়। কিন্তু বৃদ্ধার মাথায় আর কোলে তো ধানের ঝুড়ি আর বস্তা। কী ভাবে তাঁকে কোলে নেওয়া সম্ভব। বৃদ্ধা নিজের অসহায়তার কথা জানালে ছোট্ট মেয়েটি বৃদ্ধার মাথায় থাকা ঝুড়িতে চাপার কথা বলে। নিরুপায় তারিণী সূত্রধর তাই করেন।পরে তিনি বাড়ি ফিরে দেখেন ঝুড়িতে ওই ছোট্ট মেয়েটি নেই। তার বদলে রয়েছে দুটি পাথর। সেদিন রাত্রেই বৃদ্ধা তারিণী সূত্রধর স্বপ্নে হাজির হয় ছোট্ট মেয়েটি। মেয়েটি জানায় সে মা কালী। বৃদ্ধাকে পুজোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়। ভয় পেয়ে পরের দিন সকালে ওই বৃদ্ধা লালবাজার এলাকার মানুষকে সব কথা জানান। শুধু তাই নয়, সেই সময় ছোঁয়া-ছুঁয়ি আর জাতপাতের ঘটনা এতটাই তীব্র ছিল পুরোহিত পুজো করতে অস্বীকার করেন। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন সেই পুরোহিতও। পরে তিনিও স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজো করতে রাজী হন। সব কিছু জানার পর স্থানীয় জমিদার পত্নী কাদম্বরী দেবী মন্দির নির্মাণের জন্য এক খণ্ড জমি দান করেন। বর্তমানে বর্ধমানের এক সমাজসেবী অজিত সিংহ সুদৃশ্য মন্দির তৈরি করে দিয়েছেন। মূল মন্দিরের সামনে রাখা রয়েছে, তারিণী সূত্রধরের মাথায় ধানের ঝুড়িতে চেপে মা আসছেন। অন্য দিকে সিদ্ধপুরুষ হট যোগীর মূর্তি। সবার উপরে শিব। এছাড়াও মূল মন্দিরের উপরে রয়েছে একটি পদ্ম ফুল। যা অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। আজও প্রাচীন প্রথা মেনে সূত্রধররাই কেবল ঘট আনার অধিকারী। ‘হটনগর কালী’র নামকরণ নিয়ে এলাকায় দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলেন, হট নামে এক যোগী পুরুষ এই কালীর পুজার্চণা করতেন। তাই এরূপ নামকরণ। আবার কেউ বলেন, মা কালী হঠাৎ এসেছিলেন। তাই হটনগর কালী নামকরণ হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মা কালীর নির্দেশে যে আকড় গাছের নীচে পাথর দু’টি রাখা হয়েছিল সেই গাছ আজও আছে। আশ্চর্য্যের বিষয় সেই গাছে কোন কাঁটা নেই। এমনকি ঐ গাছের আদি মূলের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর পাথর দু’টি আজও সেই আকড় গাছের নীচে রেখে পুজার্চণা করা হয়। আশ্চর্য্যের বিষয় ঐ পাথর দু’টির ঋতুভেদে রং পরিবর্তন হয়। এমনটাই দাবী স্থানীয়দের।