মানুষের জীবনে “ভ্রমণ”এর প্রাসঙ্গিকতা : দিলীপ রায়।

ভ্রমণের ব্যবহারিক অর্থ নানান রকম । যেমন প্রাতকালীন ভ্রমণ, বৈকালিন ভ্রমণ, নদীর পারে ভ্রমণ, জ্যোৎস্নার আলোয় ফাঁকা রাস্তায় ভ্রমণ, ট্রেনে-বাসে-উড়োজাহাজে-জলযানে ভ্রমণ, ইত্যাদি । আক্ষরিক অর্থে আমরা যেটা বুঝি ভ্রমণ অর্থ বেড়ানো, ঘোরাঘুরি, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়া, অর্থাৎ পর্যটন করা । অন্য অর্থে দেশ ভ্রমণ । এছাড়া ভ্রমণ অর্থ যেটা বুঝি, সেটা হচ্ছে চিত্তবিনোদন, পর্যটন ও অবকাশ যাপন । ভ্রমণ মানুষের জীবনে আনে বৃহত্তের আহ্বান । আনে অজানা সৌন্দর্যের সংবাদ । অচেনার সান্ন্যিধে মানুষ পায় বিষ্ময়ের শিহরণ । তাই ভ্রমণ শুধুমাত্র দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিদেশ ভ্রমণও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য । তবে এটাও ঘটনা, মানুষের মধ্যে ভ্রমণের আবশ্যিক দিক নিজের দেশকে জানবার, বোঝবার, দেখার । নিজের জন্মস্থানের গাঁ-গঞ্জ-শহর-নগর থেকে বেরিয়ে দেশের ও বিদেশের অন্যত্র ভ্রমণের মাধ্যমে জানাটা ভ্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্য । তা ছাড়া দিনের পর দিন একই পরিবেশের জীবন যাপন থেকে ক্ষণিকের মুক্তি । একটু বৈচিত্রের আস্বাদনের উপলব্ধি, যে বৈচিত্র আমাদের দেয় অপরিসীম আনন্দ ।
যদি নিজের দেশ ভারতকেই ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে, একই দেশে বাস করা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারভেদ । আমাদের দেশে নানান ধর্ম, নানান জাতির মানুষের বসবাস । বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন বর্ণের মানুষ । প্রত্যেকের জাতিসত্বা, ভাষার প্রয়োগ, ধর্মের আচরণ, এমনকি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা আলাদা । যার জন্য ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের ভ্রমণের মাধ্যেমে দেশকে চেনার, দেশের মানুষদের আরও বেশী করে জানবার আকাঙ্ক্ষা প্রবল । দেশের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে নানাবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ও নতুন-নতুন জ্ঞান আহরণ সম্ভব । কিছু মানুষের ভাষায়, বিচিত্র আমাদের দেশ এবং তেমনি বিচিত্র তার অধিবাসী । আরও বিচিত্র তাদের সাংস্কৃতিক জীবন যাপন এবং সামাজিক রীতিনীতি । আমদের দেশে কতো অরণ্য, সমুদ্র, পাহাড়, পর্বত, ইত্যাদি । নিসর্গ প্রকৃতির কতো অফুরন বৈভব, কতো পশু-পাখী, জীবজন্তু । ভ্রমণের মাধ্যমে সেগুলির পূর্ণভাবে উপলব্ধি ঘটে ।
( ২ )
ভ্রমণের পরিধি নির্ধারণে অবশ্যই আর্থিক সঙ্গতির প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য । ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশ । এখানে মাথাপিছু আয় প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম । ফলে মানুষের যতোটুকু আয় প্রায় ততোটুকুই সংসার নির্বাহের জন্য ব্যয় । যার জন্য সংসারের খরচ থেকে বাঁচিয়ে উদবৃত্ত রাখাটা ভীষণ ভীষণ কষ্ট । তবুও ভ্রমণ পিপাসু মানুষ সংসারের খরচা বাঁচিয়ে ঐ নগন্য আয় থেকে ভ্রমণের জন্য আলাদা ক’রে পয়সা জমিয়ে রাখে । অভিজ্ঞতার নিরিখে এটা পরিষ্কার, চাকুরিজীবিদের মধ্যে ভ্রমণের নেশা তুলনামূলকভাবে বেশী । ভ্রমণের প্রতি তাঁরা বেশী সংবেদনশীল । দেখা গেছে চাকুরিজীবি মানুষ একনাগাড়ে ছয় মাস অফিস করলে হাঁফিয়ে ওঠেন । তখন তাঁদের শরীর-মন ক্ষণিকের জন্য একঘেয়েমি জীবনের অবসান ঘটানোর নিরিখে কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরা স্থানে নিরিবিলিতে সময় কাটাতে চান । সামর্থ্য অনুযায়ী তখন ব্যস্ততম কর্মজীবন থেকে ক্ষণিকের জন্য নিবৃত্তি । মুক্তির আস্বাদনের তাগিদে তাঁদের ভ্রমণ ।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে শারীরিক সুস্থতা ভীষণ জরুরি । আবার অনেকে ডাক্তারি পরামর্শ মতো হাওয়া বদলের জন্য ছোটেন । খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ বিশ্রাম নিতে বেড়ানোর দ্রষ্টব্যস্থানে বেড়াতে যান । কিছু ভ্রমণ পিপাসু মানুষের ধারনা, ভ্রমণের মাধ্যমে তাঁদের শরীরে তাজা অক্সিজেন ঢোকে । এইজন্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, রাজনীতিবিদ, বরিষ্ঠ নাগরিক, ইত্যাদি পেশার মানুষ সাময়িক বিশ্রামের তাগিদে বিভিন্ন দ্রষ্টব্যস্থানে ভ্রমণ করেন । সুতরাং ভ্রমণের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে দেখা যায়, ভ্রমণ শুধুমাত্র চিত্ত বিনোদনের জন্য নয় । ভ্রমণ মানুষের মধ্যে সংঘটিত হয় বিভিন্ন প্রয়োজনে । এছাড়াও শিক্ষামূলক ভ্রমণ, ব্যবসা-বাণিজ্যিক ভ্রমণ, রোগ চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ, সর্বজনবিদিত ।
ভ্রমণের স্থান, কাল, ইত্যাদির ব্যাপারে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের নিজস্ব চিন্তাভাবনাটা অগ্রগণ্য । কিছু মানুষের হিল স্টেশনে ভ্রমণের প্রতি দুর্বলতা । তাই তাঁরা বিভিন্ন হিল এলাকা ভ্রমণের জন্য বেছে নেন । যেমন দার্জিলিং, সিমলা, উটি, কাশ্মীরের পহেল গাঁও-সোনমার্গ-গুলমার্গ, লে-লাদাখ, মাউন্ট আবু, কোহিমা, নেপাল, ভূটান ইত্যাদি । শোনা যায়, হিল স্টেশনে বেড়ানোর আর একটা মজা সেটা হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য । সমতলভূমি থেকে পাহাড়ে উঠবার সময় রাস্তার দুধারে প্রকৃতির অকৃত্রিম সবুজের ভাণ্ডার । বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছালির অফুরন্ত সমারোহ । যা দেখলে চোখ সরানো দায় ! তার উপর এক পশলা বৃষ্টি হলে রাস্তার দুইধারে বৃষ্টি স্নাত গাছ-গাছালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মনোমুগ্ধকর । পাহাড়ি এলাকাতে প্রাকৃতিক সমারোহের ঘনঘটা থাকলে কী হবে, সেখানকার মানুষের দৈন্যদশা প্রকট । তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা তথৈ-ব-চ । শোচনীয় তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা । ক্ষেতি জমিতে ফসল উৎপাদনের হালহকিকৎ দুঃখজনক । যার জন্য তাঁরা পর্যটকের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল । প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ পর্যটন ব্যবসার উপর নির্ভরশীল । কিছু কিছু পাহাড়ি এলাকায় পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম । উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা যেমন কোহিমা, ইম্ফল, আইজল ইত্যাদি । অথচ এইসব হিল স্টেশনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য কোনো অংশে কম নয় । ভ্রমণ পিপাসু মানুষের সংখ্যা ঐ সমস্ত এলাকায় বেশী মাত্রায় ভিড় করলে এলাকার জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ত । সুতরাং ভ্রমণের ক্ষেত্রে দ্রষ্টব্যস্থানগুলির গুরুত্ব অপরিসীম ।
( ৩ )
সমুদ্রের তীরবর্তী শহরে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের চেয়ে বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষদের ভিড় নজরকাড়া । অনেক বাঙালি সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল হিসাবে প্রথমেই পুরীকে বেছে নেন । পুরীর সমুদ্র পারে ভ্রমণের আরও একটি উদ্দেশ্য, পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শণ এবং চাইলে পুজো দেওয়া । আবার পুরীতে রয়েছে ঐতিহাসিক কোনারক যেখানে প্রচুর মানুষ ভিড় করেন । ইদানীংকালে দীঘার সমুদ্র সৈকতেও মানুষের ভিড় উল্লেখযোগ্য । কেননা দীঘার সমুদ্রের পার আধুনিক সজ্জায় সুসজ্জিত । সরকারি দৃষ্টির সৌজন্যে দীঘার সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণ এখন ভীষণ জনপ্রিয় । ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হচ্ছে সমুদ্রের বীচ । সমুদ্রের বীচের বালিতে পর্যটকদের হেঁটে খুব আনন্দ । যার জন্য চেন্নাইয়ে ম্যারিনা বীচ, গোয়ার ক্যারাঙ্ঘুটে বীচ, মুম্বাইয়ের জুহু বীচ, কন্যাকুমারীর তিনটি সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের বীচ, কোভালামের বীচ, ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে আজও আকর্ষণীয় । তা ছাড়া রয়েছে সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের বাড়-বাড়ন্ত ।
মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, দর্শন ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য । অনেক ভ্রমণার্থী মন্দির দর্শনের পাশাপাশি মন্দিরের দেবতার পুজো দিতে উৎসাহী । ধর্মের প্রতি অনুরাগ মানুষের মধ্যে কমবেশী রয়েছে । সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই ধর্মীয় স্থানে ভ্রমণের ইপ্সা । তা ছাড়া জানারও আকাঙক্ষা প্রবল । যেমন দক্ষিণ ভারতে তিরুপতির তিরুমালায় বেঙ্কটেশ্বর মন্দির, অসমের গুয়াহাটিতে কামরুপ কামাক্ষার মন্দির, রাজস্থানের আজমির শরিফ দরগাহ, কোহিমায় ক্যাথিড্রাল চার্চ, মুম্বাইতে সিদ্ধি-বিনায়ক মন্দির, জম্মুতে কাটরায় বৈষ্ণদেবী মন্দির, ইত্যাদি ।
ভ্যালী এলাকায় ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ছুটছেন । শিমলার কিন্নর উপত্যকায় শতদ্রু ভ্যালী,পহেলগাও (শ্রীনগর) থেকে ১২ কিমি দূরে আরু ভ্যালী, লাদাখে নুব্রা ভ্যালী, মানুষের কাছে আকর্ষণীয় । বড় দ্বীপ বলতে অসমের মাজুলি দ্বীপ । শোনা যায় এই দ্বীপ এশিয়ায় বিখ্যাত । অসমের যোরহাট থেকে মাজুলি দ্বীপ যাওয়া সহজ । বিশাল ব্রহ্মপুত্রের মধ্যেখানে মাজুলি দ্বীপ। অনেকেই ছুটছেন মাজুলি দ্বীপ ভ্রমণে । এছাড়া আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে দেখার মতো অনেক দ্বীপ রয়েছে । উত্তর-পূর্ব রাজ্যে চা-বাগান উল্লেখযোগ্য । যেমন ডিব্রূগড়ের সন্নিহিত এলাকা জুড়ে চা-বাগান । মনে হয় প্রকৃতি সবুজ গালিচা পেতে রেখেছে । দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে জঙ্গলের সমারোহ । পশ্চিম বঙ্গের জলদাপাড়ার জঙ্গল, অসমের কাজিরাঙ্গার জঙ্গল, উল্লেখযোগ্য । কাজিরাঙ্গার জঙ্গলের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে । পশু, পাখী, জীব-জন্তুতে ভরা । কাজিরাঙ্গা জঙ্গলে এক শৃঙ্গযুক্ত গণ্ডারের বিচরণ অন্যতম ।
( ৪ )
জানার ও দেখার স্পৃহার শেষ নেই। সেটা রাঁচীর পাগলা গারদ হোক বা কারগিলের যুদ্ধস্থান হোক বা অমৃতস্বরের স্বর্ণমন্দির হোক । ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ছুটছেন সতত তাঁদের একটানা দম-বদ্ধ জীবন থেকে সাময়িক মুক্তির খোঁজে ।
মানুষের মধ্যে ভ্রমণের সময় নির্ধারন করা বড্ড কঠিন । ছেলে মেয়ের পড়াশুনার কথা মাথায় রাখতে হয় । পরীক্ষা বা পড়াশুনার ব্যস্ত সময়ে ভ্রমণের চঞ্চলতা কম । তেমনি চাষিদের চাষের মরশুম, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ধামাকার সময় যেমন দুর্গা পুজা, ইত্যাদির সময়, চাকুরিজীবিদের চাকরিস্থলে ছুটি গ্রান্ট না হলে, ভ্রমণের ইচ্ছা নৈব-নৈব-চ । এত কিছুর মধ্যও ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ভ্রমণের তাগিদে দেশ বিদেশ ছুটছেন । এতে একটা জিনিস পরিষ্কার, ভ্রমণ মানুষকে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখে ।

কলমেঃ দিলীপ রায় (৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *