সূচনাঃ- সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের অন্যতম তীর্থভূমি ছিল বাংলাদেশ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে যা সর্বভারতে বিস্তার লাভ করে। এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক নব অধ্যায়ের সূচনা করে এই সকল সন্ত্রাসবাদীগন স্বদেশিকতা ও গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করিয়া গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা বিদেশী শাসকবর্গকে ভারত হইতে বিতাড়িত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
বিপ্লবীরা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধঃ-
স্বামী বিবেকানন্দের নববেদান্তবাদ বাংলার যুবশক্তিকে আত্মবিশ্বাস, সাহস ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র, আনন্দমঠের “দেশমাতাই হলেন মা” এবং “দেশপ্রেমই হল ধর্ম” এই তত্ত্ব বিপ্লববাদের মানস ক্ষেত্রকে উর্বর করে।
রাজনারায়ন বসুর জাতীয়তা বাদ ও নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলা এই বিপ্লববাদে প্রেরনা দেয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন দমনে ইংরেজ পুলিশের প্রচন্ড দমন নীতি বাঙালী যুবকদের প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় করে। ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে রুশ জাপান যুদ্ধে ক্ষুদ্রকায় জাপানীদের হাতে রাশিয়ার পরাজয় ভারতবাসীকে চমকিত করে। এশিয়ার একদা পিছিয়ে পড়া শক্তি জাপান যদি দৈত্যের মত শক্তিশালী জার শাসিত রাশিয়াকে আত্মশক্তিতে পরাস্ত করতে পারে; তবে ভারতবাসী কেন ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে না, এই প্রশ্ন জাতির মনে দেখা দেয়। কবি অতুল প্রসাদ জাতিকে উদ্দীপনা দেন – “বল বল বল সবে, শত বীনা বেনু রবে, ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”।
তিনটি গোষ্ঠীঃ-
বিপ্লবীদের মধ্যে তিনটি উপদল ছিল। – (১) একদল মনে করতেন যে, কিছু সংখ্যক সরকারী কর্মচারীকে হত্যা করলে সরকারী প্রশাসন যন্ত্র অচল হয়ে যাবে। (২) অপর গোষ্ঠী মনে করতেন যে, ইংরেজদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হবে। (৩) তৃতীয় গোষ্ঠী মনে করত যে, ইংরেজ এর ভারতীয় বাহিনীকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করে সশস্ত্র বিপ্লব দ্বারা ক্ষমতা দখল করতে হবে।
অনুশীলন সমিতি ও অন্যান্য সমিতিঃ-
বাংলাদেশে বৈপ্লবিক উদ্দেশ্যে প্রথম গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন প্রমথ নাথ মিত্র। তিনি ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল শরীর চর্চা ও আত্মিক সাধনার মাধ্যমে একদল তরুন সৈনিক গঠন করা। এই সমস্ত তরুন সৈনিকরা দেশের জন্য প্রান বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখরা প্রথমদিকে এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে এঁরা এই সমিতির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে। পরে দয়ানন্দ সরস্বতী, নিবেদিতা ও অরবিন্দ সক্রিয়ভাবে এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। অরবিন্দের ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা বিপ্লবী মত প্রচার করতে থাকে। বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো বিলাত হতে বোমা তৈরীর কৌশল শিখে আসেন। পরে তাঁর ও উল্লাস কর দত্তের সহায়তায় বারীন্দ্রনাথ মানিকতলার মুরারীপুকুরে বোমা তৈরীর কারখানা স্থাপন করেন। বারীন্দ্রর নির্দেশে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্লচাকী অত্যাচারী শাসক কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে মুজফ্রপুর রওনা দেন। কিন্তু কিংসফোর্ডকে হত্যার বদলে দুর্ভাগ্যবশতঃ তারা দুজন ইংরেজ মহিলাকে হত্যা করেন। ধরা না দিয়ে প্রফুল্ল চাকী নিজের গুলিতে প্রান দেন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন। পরে তাঁর ফাঁসি হয়। এরপর ইংরেজরা মুরারীপুকুরের বোমের কারখানা ধরে ফেলেন এবং অরবিন্দ সহ ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করেন। শুরু হয় আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা। চিত্তরঞ্জনের চেষ্টায় অরবিন্দ মুক্তি পেলেও বারীন্দ্র সহ ১৬ জনের যাবজীবন দীপান্তর হয়।
সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনাঃ-
বিপ্লব এর পদ্ধতি নিয়ে বিপ্লবী মধ্যে মত বিরোধ দেখা দিলেও বিপ্লবীদের একাংশ বিদেশ হতে অস্ত্র জোগাড় করে সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন। এই গোষ্ঠীতে ছিলেন বাঘাযতীন, যদুগোপাল মুখার্জি প্রমুখ। জার্মানীর কাছ থেকে তারা অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পান। কলিকাতার অস্ত্র ব্যবসায়ী রন্ডা কোম্পানীর ২০ বাক্স মাউজার পিস্তল হাত করেন। এদিকে ইংরেজ সরকার জানতে পারায় জার্মান থেকে পাঠানো অস্ত্র জাহাজ মাভেরিক কলিকাতায় আসতে ব্যর্থ হয়। মাদ্রাজের সঙ্গে কলিকাতার রেল যোগাযোগ ছিন্ন করতে বাঘাযতীন বালেশ্বর যান। কিন্তু ইংরেজরা জানতে পেরে সেখানে সৈন্য পাঠান। সেখানে বুড়ীবালামের যুদ্ধে বীর শহিদ বাঘাযতীনের মৃত্যু হয়। এই ভাবে নাঙালী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে তরান্বিত করেছিল।
সশস্ত্র বিপ্লবঃ-
১৯২০ খ্রীঃ বিনয়, বাদল, দীনেশ এই তিন বিপ্লবী কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করেন এবং কারা বিভাগের অধ্যক্ষ অত্যাচারী সিমসনকে গুলি করেন। ধরা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে বিনয় নিজ মাথায় গুলি করেন। বাদল ঘটনাস্থলে বিষ খান এবং দীনেশের ফাঁসি হয়। মাস্টারদা সূর্যসেন ও বিপ্লবে সশস্ত্র ভূমিকা গ্রহন করেন। তিনি চট্ট গ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেন এবং টেলিগ্রাফ-টেলিফোন লাইন কেটে দিয়ে চট্টগ্রাম শহরকে বাংলাদেশের অপর অংশ হতে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠন করেন। বিপ্লবীদের অন্যতম কর্মকেন্দ্র ছিল মেদিনীপুর। এখানকার ব্রিটিশ অত্যাচারও ছিল অপরিসীম। অত্যাচারী জেলাশাসক পেডিকে বিমল দাশগুপ্ত গুলি করে হত্যা করেন। বিচারক গর্লিককে প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁর এজলাশে হত্যা করেন কানাই ভট্টাচার্য। শান্তি ও সুনিতী নামে দুটি অল্প বয়স্কা বালিকা কুমিল্লার জেলাশাসক স্টিভেনসনকে গুলি করে হত্যা করেন। বীনা দাস গর্ভনর স্ট্যানলিকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। ১৯৩২ খ্রীঃ প্রভাংশু পাল ও প্রদ্যোত ভট্টাচার্য্য মেদিনীপুরের জেলে ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে গুলি করে হত্যা করেন। এইভাবে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বহু বিপ্লবী অত্যাচারী ইংরেজদের হত্যা করতে থাকে আবার নিজেরাও প্রান বিসর্জন দিতে থাকেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য হাসতে হাসতে মৃত্যুকে বরন করে নিতে তাঁরা দ্বিধা করেন নি।
উপসংহারঃ-
এইভাবে বাংলায় বিপ্লবী সন্ত্রাসের প্রথম পর্যায়ের অবসান ঘটে। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটলে বিপ্লবী কার্যকলাপ সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে পড়ে। অবশ্য গোপনে বিপ্লবীদের প্রস্তুতি তখনও অক্ষুন্ন অবস্থায় চলতে থাকে।
– Points –
(১) সূচনা (২) প্রেরনার উৎস (বিপ্লবীরা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ) (৩) তিনটি গোষ্ঠী (৪) অনুশীলন সমিতি (৫) যুগান্তর দল (৬) অন্যান্য সংগঠন (৭) উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী (৮) সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা (৯) কার্যাবলী – (ক) কিংসফোর্ড হত্যার প্রচেষ্টা (খ) আলিপুর বোমার মামলা (গ) হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা (ঘ) মাভারিক জাহাজ (ঙ) বুড়িবালামের যুদ্ধ (চ) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন (ছ)জালালাবাদের যুদ্ধ (জ) লেম্যান হত্যা (ঝ) অলিন্দ যুদ্ধ (ঞ) বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের কার্যাবলী (১০) উপসংহার।
Leave a Reply