মহাকাশে নিখুঁত নজরদারি! নাসা-ইসরোর যৌথ উদ্যোগে সফল উৎক্ষেপণ ‘নিসার’ উপগ্রহ।

শ্রীহরিকোটা, নিজস্ব সংবাদদাতা, ৩০ জুলাই ২০২৫
বিশ্ব মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে আরেকটি গৌরবময় অধ্যায় সংযোজন করল ভারত ও আমেরিকা। নাসা (NASA) ও ইসরো (ISRO)-র যৌথ উদ্যোগে তৈরি হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কৃত্রিম উপগ্রহ ‘নিসার’ (NISAR) বুধবার সন্ধ্যায় সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হল ভারতের শ্রীহরিকোটা’র সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র (Satish Dhawan Space Centre) থেকে।

উৎক্ষেপণের নির্ধারিত সময় ছিল সন্ধ্যে ৫টা ১০ মিনিট, তবে ৩০ মিনিট বিলম্বে ঠিক ৫টা ৪০ মিনিটে GSLV-F16 রকেটের মাধ্যমে নিসারকে কক্ষপথে পাঠানো হয়। উৎক্ষেপণের মুহূর্তের ভিডিও ইসরোর অফিসিয়াল এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডেলে পোস্ট করে জানানো হয় —
“লঞ্চ! নিসারকে সঙ্গে নিয়ে GSLV-F16 সফলভাবে মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছে।”


নিসার: প্রযুক্তির যুগান্তকারী সাফল্য

নাসা ও ইসরো’র এই যুগলবন্দিতে তৈরি নিসার প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ₹১২,৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ₹৭৮৮ কোটি টাকা বহন করেছে ইসরো। নিসার হল এমন একটি উপগ্রহ যা পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ, সমুদ্রপৃষ্ঠ, বরফাবৃত অঞ্চল এবং অরণ্য অঞ্চলের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণে বিশেষ দক্ষ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদিও ব্যয়বহুল এই প্রকল্প প্রথম দর্শনে বিশাল বিনিয়োগ মনে হতে পারে, তবুও এই প্রকল্প আগামী দিনে গবেষণা, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্লেষণ এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় অমূল্য অবদান রাখবে


নিসার-এর প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্ষমতা

  • প্রতি ৯৭ মিনিটে একবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করবে নিসার
  • মাত্র ১২ দিনের মধ্যে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ও বরফাবৃত অঞ্চলগুলির সম্পূর্ণ ও উচ্চ-রেজোলিউশন মানচিত্র তৈরি করতে পারবে।
  • ‘Synthetic Aperture Radar’ (SAR) প্রযুক্তির সাহায্যে মেঘ, অন্ধকার বা ধোঁয়ার আড়ালে থাকা জায়গাও নিখুঁতভাবে স্ক্যান করতে পারবে নিসার।
  • এই উপগ্রহে রয়েছে L-band ও S-band রাডার — যা প্রথমবারের মতো একই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করা হয়েছে।

নিসার-এর ব্যবহারিক প্রয়োগ

নিসার-এর মাধ্যমে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে সবচেয়ে সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এই ডেটাগুলি বিনামূল্যে পাওয়া যাবে বিজ্ঞানী ও জলবায়ু গবেষকদের জন্য। এটি বিশেষভাবে সহায়ক হবে—

  • প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম পূর্বাভাসে:
    যেমন অসম বা বিহারে প্রতি বছর ঘটে যাওয়া বন্যা সম্পর্কে আগেভাগেই তথ্য দেওয়া।
  • হিমবাহ গলন পর্যবেক্ষণে:
    হিমালয়ের গ্লেশিয়ার গলে যাওয়ার হার এবং তা কীভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রভাব ফেলছে, তা বিশ্লেষণে সাহায্য করবে নিসার।
  • ভূমিকম্প, ভূমিধস ও অরণ্য ধ্বংসের নজরদারিতে:
    নিসার প্রতিনিয়ত জমির অবস্থান এবং উচ্চতার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করবে, যা ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকি বিশ্লেষণে সাহায্য করবে।

নিসার কবে থেকে কাজ শুরু করবে?

উৎক্ষেপণের পরপরই নিসার উপগ্রহ কাজ শুরু করবে না। প্রথম ৯০ দিন চলবে সেটআপ ও ক্যালিব্রেশন পর্ব। এই সময়ের মধ্যে রাডার ও অন্যান্য সেন্সরগুলিকে কার্যক্ষম করে তোলা হবে এবং ডেটা প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি স্থাপন করা হবে। তারপর ২০২৫ সালের শেষে থেকে পুরোদমে ডেটা পাঠানো শুরু করবে নিসার


আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসা

নাসা ও ইসরো’র এই যৌথ প্রয়াস বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত সহযোগিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকটকালে বিশ্বমানের ‘আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট’ হিসাবে নিসার ভবিষ্যতের অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি হতে চলেছে।


উপসংহার

নিসার শুধু একটি উপগ্রহ নয়, এটি পৃথিবীর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগলবন্দি, ভারত-আমেরিকার সহযোগিতা এবং ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্ববোধের নিদর্শন নিসার। আগামী দিনে এই উপগ্রহের তথ্য ব্যবহার করে জলবায়ু, কৃষি, ভূতাত্ত্বিক বিপর্যয় ও বনাঞ্চল সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি আশা করা যায়

ইতিমধ্যেই এই উৎক্ষেপণকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে বিজ্ঞানীদের মধ্যে উৎসাহ তৈরি হয়েছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, নিসার ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে আরেকটি ‘মাইলস্টোন’।


স্থান: শ্রীহরিকোটা, ভারত
তারিখ: ৩০ জুলাই ২০২৫


ছবি: GSLV-F16 উৎক্ষেপণের মুহূর্ত ও নিসার স্যাটেলাইটের চিত্র ইসরো এক্স হ্যান্ডেল থেকে সংগৃহীত।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *