“মোবাইলে মগ্ন বাবা-মা, শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত! সম্পর্কের শূন্যতায় গড়ে উঠছে এক নিঃসঙ্গ প্রজন্ম ✍✍

ভূমিকা—–‘

আজকের দিনে মোবাইল ফোন ও সোস্যাল মিডিয়া মানুষের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি এক অদৃশ্য বন্ধনের মধ্যে আটকে ফেলেছে আমাদের চিন্তা, সময় এবং সম্পর্ককে। পরিবারে যখন বাবা মা দিনের অধিকাংশ সময় মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন, তখন সন্তানের উপর তার কী প্রভাব পড়ে, তা আমরা সচরাচর ভাবি না। অথচ এই ছোট ছোট অভ্যাসই গড়ে তোলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যত। এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করব, কিভাবে বাবা মায়ের মোবাইল-নির্ভর জীবনধারা সন্তানের মানসিকতা, আচরণ ও জীবনের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

বাবা মায়ের মোবাইল-নির্ভরতা: একটি বাস্তব চিত্র—

বর্তমানে বহু বাবা মা কাজের চাপ, অবসর, কিংবা বিনোদনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সময় মোবাইলে কাটান। সোস্যাল মিডিয়া অ্যাপ যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ তাঁদের সময়ের বড়ো একটি অংশ দখল করে রেখেছে।
সাধারণত দেখা যায়:

সকাল উঠেই মোবাইল চেক করা,

খাবারের টেবিলে স্ক্রল করা,

সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোর সময়েও ফোনে মগ্ন থাকা,

খেলার মাঠ নয়, মোবাইলে কার্টুন চালিয়ে সন্তানকে বসিয়ে রাখা।

এই অভ্যাসগুলি প্রথমে মনে হয় নিরীহ, কিন্তু শিশুর মন এবং মনোবিকাশের দিক থেকে তা ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

শিশুর মনোবিকাশের সূচনালগ্নে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—–

বিজ্ঞান বলে, একটি শিশুর ০–৬ বছর বয়সই তার মূল মানসিক গঠনের সময়। এই সময়ে সে শেখে:

ভাষা

আচরণ

সামাজিকতা

অনুভূতির প্রকাশ

সম্পর্কের মূল্যবোধ

এই শেখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তার অভিভাবকরা। কিন্তু যদি সে দেখে, বাবা-মা তার দিকে তাকাচ্ছেন না, উত্তর দিচ্ছেন না, বরং মোবাইলে মগ্ন—তাহলে শিশুর ভিতরে একটি শূন্যতা তৈরি হয়। সে হয়তো মুখে কিছু বলে না, কিন্তু সে বুঝতে শেখে, “মানুষের মনোযোগ পাওয়ার জন্য কিছু করতে হয়”—এবং সেই “কিছু” মাঝে মাঝে হয়ত খারাপ অভ্যাসও হতে পারে।

শিশুর উপর প্রভাব: বিস্তারিত বিশ্লেষণ—

১. ভাষা বিকাশে ব্যাঘাত

শিশুরা কথা শিখে তার পরিবেশ থেকে। যদি সে দেখে বাবা মা কথা বলছেন না, সারাদিন ফোনে মাথা গুঁজে রয়েছেন, তাহলে শিশুর কথার ভান্ডার গড়ে ওঠে না। সে হয়ত অল্প শব্দে কথা বলে, কখনো কথাই বলে না, বা ভুলভাল শব্দ ব্যবহার করে।

২. আচরণগত সমস্যা

শিশুরা লক্ষ্য করে, বাবা-মা নিজেরা মোবাইলে মগ্ন, কিন্তু শিশুকে মোবাইল ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। এতে দ্বৈত মানসিকতা তৈরি হয়।

অনেক সময় শিশু মনোযোগ পেতে মারধর, চিৎকার, জেদ, কান্না ইত্যাদি অবলম্বন করে।

৩. সোশ্যাল স্কিলের অভাব

শিশু যদি দেখেই না যে বাবা মা কিভাবে মেলামেশা করেন, কিভাবে একজন আরেকজনের কথা শোনেন, কিভাবে হাসেন ও আবেগ ভাগ করেন, তাহলে সেই শিশুর মাঝেও এই সামাজিক দক্ষতা তৈরি হয় না। সে সমাজে সহজে মিশতে পারে না।

৪. আত্মবিশ্বাসের সংকট

যে সন্তান বাবা মার মনোযোগ পায় না, তাকে মনে হয় সে মূল্যহীন। সে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস হারায়। তার মধ্যে “আমি পারি না”, “আমার কোনো গুরুত্ব নেই” — এই মনোভাব জন্ম নেয়।

৫. মোবাইল আসক্তি

যেহেতু সে দেখে বাবা মা মোবাইলকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, সেও মনে করে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। ফলে শিশুরাও খুব অল্প বয়সেই স্ক্রিনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব——

১. শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যর্থতা

মোবাইল আসক্ত শিশুদের মনোযোগ কমে যায়। ক্লাসে পড়া বোঝে না, সহজে বিরক্ত হয়, মন দিয়ে পড়তে পারে না। ফলে পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়।

২. নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে অক্ষমতা

শিশুরা যখন নিজের পরিবারে উষ্ণতা ও ভালোবাসা পায় না, তারা অন্য জায়গায় (অনলাইন বা বাইরের সমাজে) ভালোবাসা খোঁজে। এতে তারা ভুল পথে চলে যেতে পারে।

৩. মানসিক চাপ ও হতাশা

মনোযোগের অভাবে, সামাজিক বন্ধনহীনতায় এবং ভালোবাসার ঘাটতিতে শিশুর মনে তৈরি হয় এক ধরনের চাপ, যা পরে ডিপ্রেশন, ঘুমের সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি সমস্যা ডেকে আনে।

বাস্তব উদাহরণ—–

ঘটনা ১:

কলকাতার এক প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষক বলছেন, “আজকাল অনেক শিশুই ক্লাসে একা থাকে, বন্ধু বানাতে পারে না, কথা কম বলে। যখন খোঁজ নিই, দেখি তাদের বাবা মা সবসময় ফোনে ব্যস্ত।”

ঘটনা ২:

এক মনোবিদ জানিয়েছেন, “১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে নিজেই জানিয়েছে—ওর মা সারাদিন রিল দেখে আর বাবা খবরের ভিডিও দেখে। ও বুঝতে পারে, ওদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। তখন ওও ফোন নিয়ে বসে যায়।”

সমাধান ও করণীয়——-

১. ‘নো ফোন টাইম’ নির্ধারণ করুন

অন্তত সকালে উঠে ও রাতে ঘুমানোর আগে ১ ঘণ্টা পুরো পরিবার মোবাইল ছাড়াই কাটাক।

খাবারের সময়, সন্তানের হোমওয়ার্কের সময় মোবাইল একেবারেই না ধরুন।

২. ‘ফ্যামিলি টাইম’ পরিকল্পনা করুন

একসঙ্গে গল্প বলুন, বই পড়ুন, পিকনিক বা হাটে যাওয়া।

একদিন মোবাইল ছুটি দিন — ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ দিন হিসেবে।

৩. সন্তানের সামনে মোবাইল ব্যবহার কমান

শিশু যা দেখে, তাই শেখে। আপনি যদি ফোনের ব্যবহার সীমিত করেন, আপনার সন্তানও সেটাই শেখে।

৪. শিশুর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন

ও কী ভাবছে, কী করছে, কী চাইছে — এগুলো বোঝার চেষ্টা করুন। সম্পর্ক গড়ে তুলুন।

উপসংহার:—

প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অগ্রগতিতে সহায়ক হলেও, এর ব্যবহারে সচেতন না হলে তা হয়ে উঠতে পারে এক অভিশাপ। বিশেষ করে, বাবা মা যদি সন্তানের পরিবর্তে মোবাইলে বেশি সময় দেন, তবে তা শিশুর মানসিক, সামাজিক ও ভবিষ্যতের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমরা যদি চাই আমাদের সন্তান সুস্থ, সুন্দর, আত্মবিশ্বাসী ও মানসিকভাবে দৃঢ় হোক, তবে এখনই সময় মোবাইল ছেড়ে তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার, ভালোবাসা দেওয়ার। আজকে যে সময় আমরা তাদের দিচ্ছি না, আগামীতে তার মূল্য আমাদের সকলকে চোকাতে হতে পারে।

সমাপ্তি

শিশু শেখে দেখে। সে কথা নয়, আচরণ অনুসরণ করে। তাই বাবা মা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, শুধু খাবার, পোশাক বা শিক্ষা দেওয়া নয়, ভালো অভ্যাসও শেখানো। আর তা শুরু হয় আমাদের নিজেদের থেকে। মোবাইলের পর্দা নয়, সন্তানের চোখে তাকান — ওখানেই ভবিষ্যৎ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *