
বাংলার দক্ষিণ প্রান্তে, যেখানে গঙ্গা মিলেছে বিশাল বঙ্গোপসাগরের বুকে, সেখানেই অবস্থিত গঙ্গাসাগর। নামেই বোঝা যায়, এটি গঙ্গা নদীর শেষ প্রান্ত — সাগরে গঙ্গার মিশ্রণ। হিন্দু ধর্মের অতি পবিত্র তীর্থস্থানগুলির মধ্যে এটি একটি, যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী স্নান করতে আসেন মকর সংক্রান্তির পুণ্য লগ্নে। ধর্ম, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য মেলবন্ধন এই গঙ্গাসাগর।
যাত্রার সূচনা
গঙ্গাসাগর ভ্রমণের শুরু কলকাতা থেকে। প্রথমে কলকাতা থেকে নামখানা বা হাটখোলার দিকে যেতে হয় ট্রেনে বা বাসে। নামখানা থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত সড়কপথে পৌঁছে, সেখান থেকে বোটে বা লঞ্চে যেতে হয় মুরিগঙ্গা নদী পার হয়ে সাগরদ্বীপে। এরপর আবার গাড়ি বা ভ্যানে করে পৌঁছানো যায় বিখ্যাত কপিলমুনি আশ্রম এবং সাগরস্নান ঘাটে।
এই পথজুড়ে নদী, গ্রাম, নৌকা আর জলরাশির দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় বাংলার গ্রামীণ সৌন্দর্য।
️ কপিলমুনি আশ্রম ও পুণ্যস্নান
গঙ্গাসাগরের প্রধান আকর্ষণ হলো কপিলমুনি মন্দির। কিংবদন্তি আছে, এখানে মহান ঋষি কপিলমুনি তপস্যা করতেন। দেবভক্ত ভগীরথের প্রার্থনায় গঙ্গা স্বর্গ থেকে নেমে এসে তার পূর্বপুরুষদের মুক্তি দেন— সেই পবিত্র ভূমিই এই সাগরদ্বীপ।
প্রতি বছর মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী এখানে সমবেত হন, সাগরে স্নান করে কপিলমুনির আশ্রমে পূজা দেন। বলা হয়, এখানে একবার স্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টান
গঙ্গাসাগর শুধু তীর্থ নয়, এটি এক অপূর্ব প্রাকৃতিক স্থানও। সমুদ্রের তীরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য অবর্ণনীয়।
নোনা হাওয়া, বালুময় সৈকত, দূরে ভেসে বেড়ানো মাছ ধরার নৌকা — সব মিলিয়ে এক প্রশান্ত সৌন্দর্য ভরে থাকে পরিবেশে।
সন্ধ্যাবেলায় ঢেউয়ের শব্দে যখন বাতাস ভরে ওঠে, মনে হয় প্রকৃতিই যেন প্রার্থনা করছে ঈশ্বরের উদ্দেশে।
গঙ্গাসাগর মেলা
প্রতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে (১৪ বা ১৫ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হয় গঙ্গাসাগর মেলা — যা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় মেলা কুম্ভ মেলার পরেই।
এই মেলায় দেশ-বিদেশ থেকে লাখ লাখ ভক্ত আসেন। তীর্থযাত্রীরা নানা প্রদেশের, নানা ভাষার, নানা বর্ণের হলেও, এই মেলায় সকলেই এক সূত্রে বাঁধা পড়েন “ভক্তি” ও “ঐক্য”-র বন্ধনে।
মেলায় দেখা যায় বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসী, আখড়া, ধর্মীয় আলোচনা, এবং ভক্তিমূলক সংগীতের আসর — এক মহা আধ্যাত্মিক উৎসব।
স্থানীয় জীবন ও সংস্কৃতি
গঙ্গাসাগরের মানুষ মূলত জেলেজীবী ও কৃষিজীবী। তাদের সরল হাসি, অতিথিপরায়ণতা আর পরিশ্রমী মনোভাব পর্যটকদের হৃদয় জয় করে নেয়।
এখানকার স্থানীয় খাবারের মধ্যে তাজা মাছ, নারকেল জল, এবং চিংড়ির পদ ভ্রমণের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দেয়।
গ্রামীণ মেলা ও লোকনৃত্য এখানকার সংস্কৃতিকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
- কপিলমুনি মন্দির – তীর্থযাত্রার মূল কেন্দ্র।
- সাগর সৈকত – স্নান ও সূর্যোদয় দেখার আদর্শ স্থান।
- লটের লাইটহাউস – সমুদ্রের ধারে অবস্থিত প্রাচীন দিকনির্দেশক আলোঘর, যা থেকে সাগরের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।
- বার্নপুর ও হরিনামপুর গ্রাম – স্থানীয় জীবনযাত্রা দেখার জন্য চমৎকার স্থান।
কীভাবে যাবেন
- রেলপথে: কলকাতা থেকে নামখানা বা কাকদ্বীপ পর্যন্ত ট্রেন।
- সড়কপথে: এসপ্ল্যানেড বা ধর্মতলা থেকে সরাসরি বাসে নামখানা বা হারউড পয়েন্ট পর্যন্ত।
- নৌপথে: কাকদ্বীপ থেকে মুরিগঙ্গা নদী পার হয়ে সাগরদ্বীপে পৌঁছানো যায়।
- থাকার ব্যবস্থা: গঙ্গাসাগরে সরকারি ও বেসরকারি লজ, আশ্রম, এবং পর্যটন বাংলো সহজলভ্য।
উপসংহার
গঙ্গাসাগর ভ্রমণ শুধুই একটি পর্যটন নয়—এটি এক আধ্যাত্মিক যাত্রা।
এখানে এসে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, প্রকৃতির সান্নিধ্যে মন শান্ত হয়, আর ধর্মীয় আবেগে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়।
গঙ্গাসাগর যেন সত্যিই সেই স্থান, যেখানে “গঙ্গা মিলে গেছে সাগরের সাথে, আর ভক্ত মিলেছে ঈশ্বরের সাথে।”












Leave a Reply