
ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আরব সাগরের বুকে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জের নাম লাক্ষাদ্বীপ (Lakshadweep)। নামের অর্থই — “এক লক্ষ দ্বীপ”, যদিও বাস্তবে এটি মাত্র ৩৬টি ছোট-বড় প্রবাল দ্বীপের সমষ্টি। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে অগ্নত্তি (Agatti) ও কদমত (Kadmat) তাদের অপার্থিব সৌন্দর্য, স্নিগ্ধ নীরবতা এবং নীলাভ জলের মায়াবী ছোঁয়ায় পর্যটকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
লাক্ষাদ্বীপ যেন সমুদ্রের বুকে লুকিয়ে থাকা এক নীল রত্ন — যেখানে প্রকৃতি নিজেই তার স্বপ্ন রচনা করেছে।
ভূগোল ও পরিবেশ
লাক্ষাদ্বীপ ভারতের সবচেয়ে ছোট কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, যার আয়তন মাত্র ৩২ বর্গকিলোমিটার। এর দ্বীপগুলি মূলত প্রবাল (coral atoll) দ্বারা গঠিত — অর্থাৎ এটি সামুদ্রিক জীবের তৈরি প্রাকৃতিক কাঠামো।
সব দ্বীপ ঘিরে আছে গাঢ় নীল সমুদ্র, চকচকে সাদা বালির সৈকত, আর বাতাসে নারকেল ও লবণের গন্ধ। এখানে সূর্যাস্তের লাল আভা যেন মিশে যায় সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে।
অগ্নত্তি দ্বীপ — লাক্ষাদ্বীপের প্রবেশদ্বার
অগ্নত্তি (Agatti Island) লাক্ষাদ্বীপের সবচেয়ে সুন্দর ও জনপ্রিয় দ্বীপগুলোর একটি। এখানেই লাক্ষাদ্বীপের একমাত্র বিমানবন্দর অবস্থিত, তাই একে বলা হয় দ্বীপমালার “প্রবেশদ্বার”।
বিমান থেকে নামতেই চোখে পড়ে নীলের নানান ছায়া — হালকা ফিরোজা থেকে গভীর নীল, যেন রঙতুলির ছোঁয়ায় আঁকা কোনো স্বপ্নের ছবি।
অগ্নত্তির সৈকতগুলি বিশেষ করে Agatti Beach ও Lagoon Beach, অসাধারণ শান্ত ও স্বচ্ছ জলের জন্য বিখ্যাত। আপনি চাইলে এখানে snorkeling, scuba diving, kayaking, বা glass-bottom boat ride করে দেখতে পারেন সমুদ্রের নিচের বর্ণিল জগৎ — প্রবাল, সামুদ্রিক মাছ, ও ছোট কচ্ছপের মনোমুগ্ধকর নাচ।
অগ্নত্তি দ্বীপে স্থানীয়রা অত্যন্ত আন্তরিক ও অতিথিপরায়ণ। নারকেল, মাছ ও সীফুড তাদের জীবনের প্রধান অংশ। এখানে গিয়ে আসল মালদ্বীপীয় সৌন্দর্যের স্বাদ পাওয়া যায়, কিন্তু ভারতীয় মাটিতে।
কদমত দ্বীপ — শান্তির আশ্রয়
কদমত দ্বীপ (Kadmat Island) লাক্ষাদ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ। অগ্নত্তি থেকে মাত্র ৭৭ কিলোমিটার দূরে এই দ্বীপে পৌঁছানো যায় জাহাজ বা স্পিডবোটে।
এখানকার প্রকৃতি একেবারে শান্ত ও নিস্তব্ধ — যেন সময় থমকে গেছে। একদিকে নীল লেগুন, অন্যদিকে সাদা বালির প্রসারিত সৈকত।
কদমত দ্বীপটি ৮ কিলোমিটার লম্বা, কিন্তু মাত্র অর্ধেক কিলোমিটার চওড়া। এই সরু ভূমি যেন সমুদ্রের বুকের ওপর টানানো এক সরু সেতু — দুই পাশে অসীম নীল জলের বিস্তার।
এখানেও আপনি উপভোগ করতে পারেন snorkeling, water skiing, scuba diving, বা সাধারণভাবে সৈকতের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা — যেখানে আকাশের রঙ ধীরে ধীরে সোনালি থেকে লাল হয়ে যায়, আর সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে যায় পায়ের কাছে।
জলজ জগতের রাজ্য
অগ্নত্তি ও কদমত দুটোই জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার। প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে বাস করে শতাধিক প্রজাতির রঙিন মাছ, স্টারফিশ, কচ্ছপ ও সী অ্যানিমোন।
বিশেষ করে, Agatti Lagoon-এ snorkeling করলে দেখা যায় নীল ও কমলা রঙের প্রবালের অদ্ভুত গঠন — যা ফটোগ্রাফারদের জন্য এক স্বপ্নরাজ্য।
️ ভ্রমণ ও থাকার ব্যবস্থা
পৌঁছানোর উপায়:
- প্রথমে কোচি (Kochi) থেকে বিমানযোগে সরাসরি অগ্নত্তি পৌঁছানো যায়।
- কদমতের জন্য জাহাজ বা স্পিডবোট ব্যবস্থাও রয়েছে।
তবে লাক্ষাদ্বীপে প্রবেশের আগে পর্যটকদের জন্য Special Entry Permit (লাক্ষাদ্বীপ প্রশাসনের অনুমতি) নিতে হয়।
থাকার ব্যবস্থা:
অগ্নত্তি ও কদমতে সরকার পরিচালিত Tourist Resort এবং কিছু বেসরকারি রিসর্ট রয়েছে। সৈকতের ধারে কটেজে রাত কাটানো এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা — জানালার ওপারে ঢেউয়ের শব্দে ঘুম আসে, আর সকালে সূর্যের আলোয় চোখ খুললেই দেখা যায় নীল লেগুন।
️ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল।
এই সময় সমুদ্র শান্ত থাকে, আকাশ পরিষ্কার, আর জলক্রীড়ার উপযুক্ত পরিবেশ থাকে। বর্ষাকালে (জুন-সেপ্টেম্বর) প্রবল বৃষ্টি ও সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের কারণে দ্বীপে যাতায়াত বন্ধ থাকে।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
- Agatti Lagoon — প্রবাল ও জলজ প্রাণীর সৌন্দর্যে ভরপুর
- Agatti Beach — সাদা বালি ও স্বচ্ছ জলের সৈকত
- Kadmat Marine Wealth Awareness Centre — সামুদ্রিক প্রাণীর প্রদর্শনী কেন্দ্র
- Lagoon View Point, Kadmat — সূর্যাস্ত দেখার আদর্শ স্থান
- Diving Spot, Kadmat — জলের নিচে প্রবালের রাজ্য
️ শেষকথা
লাক্ষাদ্বীপের অগ্নত্তি ও কদমত যেন প্রকৃতির এক নরম ফিসফিসানি — যেখানে নীল জল, সবুজ নারকেল গাছ, আর নিস্তব্ধতার সুর একত্রে গেয়ে ওঠে এক মায়াবী গান।
এখানে নেই কোলাহল, নেই শহরের দৌড়ঝাঁপ — আছে শুধু প্রকৃতির শান্তি, স্বপ্নের মতো স্বচ্ছতা আর আত্মার মুক্তি।
সমুদ্রের ধারে বসে যখন সূর্য ডুবে যায়, মনে হয় — এই পৃথিবীর সব ক্লান্তি যেন এই নীল জলে ধুয়ে যায়।
লাক্ষাদ্বীপ শুধু একটি ভ্রমণ নয়, এটি এক অন্তর্জাগতিক অভিজ্ঞতা, যা চিরকাল হৃদয়ে থেকে যায়।












Leave a Reply