কাশী বিশ্বনাথ মন্দির – চিরন্তন বিশ্বাসের পবিত্র কেন্দ্র।

ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী বলা হয় যে শহরটিকে, তার নাম বারাণসী বা কাশী। এই নগরীর প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ঘাট, প্রতিটি মন্দির যেন ঈশ্বরভক্তির নিরব সাক্ষী। কিন্তু এই শহরের প্রাণকেন্দ্র যে মন্দিরটি, তা হল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির — মহাদেবের এক পবিত্রতম আসন, যেখানে যুগে যুগে কোটি ভক্ত মাথা নত করেছেন।


কাশী – বিশ্বের প্রাচীনতম নগরী

‘কাশী’ নামটি সংস্কৃত শব্দ “কাশ” থেকে এসেছে, যার অর্থ “প্রকাশ” বা “আলো”। অর্থাৎ, কাশী হল সেই স্থান, যেখানে আত্মা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়।
বলা হয়, এই নগরী নিজেই মহাদেবের সৃষ্টি। পুরাণ মতে, প্রলয়ের সময়ও কাশী ধ্বংস হয় না — কারণ এটি মহাদেবের প্রিয় ভূমি। যিনি কাশীতে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি নাকি নিজ হাতে মহামৃত্যুঞ্জয় শিবের মোক্ষপ্রাপ্ত হন।


কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ইতিহাস

কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের ইতিহাস প্রায় ৩৫০০ বছরের পুরোনো। এটি বারবার ধ্বংস হয়েছে এবং পুনর্নির্মিত হয়েছে — কিন্তু শিবের মহিমা কখনও ম্লান হয়নি।

প্রথম মন্দিরটি ছিল গুপ্ত যুগে, পরে মহম্মদ ঘোরী ও কুতুবউদ্দিন আইবক আক্রমণের সময় ধ্বংস হয়। ১৫৮৫ সালে রাজা টোডরমল এটি পুনর্নির্মাণ করেন, কিন্তু ১৬৬৯ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব সেটি ভেঙে সেখানে গড়ে তোলেন গিয়ানভাপি মসজিদ

বর্তমান কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরটি নির্মিত হয় ১৭৮০ সালে। মহারাষ্ট্রের মহারানী আহিল্যাবাই হোলকার (ইন্দোর রাজ্যের রানি) নিজের অর্থে নতুন করে গড়ে তোলেন মন্দিরটি। পরে শিখ রাজা রঞ্জিত সিংহ ১৮৩৫ সালে মন্দিরের গম্বুজে ৮০০ কেজি সোনার প্রলেপ দান করেন। সেই থেকেই একে বলা হয় “সোনার কাশী”।


মন্দিরের স্থাপত্য ও শিবলিঙ্গ

মন্দিরের প্রধান দেবতা বিশ্বনাথ — অর্থাৎ “বিশ্বের ঈশ্বর”। এটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম।
মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত কালো পাথরের শিবলিঙ্গটি প্রায় ৬০ সেন্টিমিটার উঁচু, এবং চতুর্দিক দিয়ে রূপার আবরণে ঘেরা। শিবলিঙ্গটি দক্ষিণমুখী, যা অত্যন্ত বিরল।

মন্দিরের চারপাশে রয়েছে অনেক ক্ষুদ্র দেবদেবীর মন্দির, যেমনঃ

  • কালভৈরব
  • অন্নপূর্ণা দেবী
  • গণেশ
  • কার্তিক
  • অবিমুক্তেশ্বর

বিশেষত অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দির এখানেই অবস্থিত, যাঁকে কাশীর “জননী” বলা হয়।


আমার কাশী ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

ভোরবেলায় গঙ্গার ঘাট থেকে শুরু হয়েছিল আমার যাত্রা। গঙ্গার জলে সূর্যের প্রথম আভা পড়তেই মনে হল — যেন দেবতার আবির্ভাব। নৌকায় চড়ে মণিকর্ণিকা ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট পার হয়ে পৌঁছলাম বিশ্বনাথ গলিতে। গলিগুলি সরু, কিন্তু তাতে জীবন ও ভক্তির স্রোত থেমে নেই।

গলির শেষে দেখা পেলাম সোনালি গম্বুজের মন্দির। প্রহরীদের নিরাপত্তা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই ঘন্টার ধ্বনি, ধূপের গন্ধ আর “হার হার মহাদেব” ধ্বনিতে চারপাশ ভরে গেল। ভক্তদের উচ্ছ্বাসে মনে হচ্ছিল, আমি যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছি।

মন্দিরের গর্ভগৃহে পৌঁছে যখন মহাদেবকে দর্শন করলাম, মনে হল যেন সময় থেমে গেছে। সেই মুহূর্তে কেবল অনুভব — “এখানেই চিরন্তন শান্তি।”


গঙ্গার ঘাট ও বিশ্বনাথ করিডর

মন্দিরের পাশেই নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে কাশী বিশ্বনাথ ধাম করিডর, যা সরাসরি গঙ্গার ঘাটের সঙ্গে যুক্ত। এই করিডরটি আধুনিক স্থাপত্য ও প্রাচীন ঐতিহ্যের এক চমৎকার সংমিশ্রণ। প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, সাদা মার্বেলের পথ, ভাস্কর্য আর গঙ্গার বাতাসে মিশে থাকা ধূপের গন্ধ — সব মিলিয়ে এটি এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা।

রাতে গঙ্গার ঘাটে গঙ্গা আরতি দেখতে গেলে সত্যিই মনে হয়, দেবতারা যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন। হাজারো প্রদীপের আলোয় গঙ্গার ঢেউ ঝলমল করে ওঠে, আর মহাদেবের নামধ্বনি আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়।


কীভাবে পৌঁছানো যায়

  • রেলপথে: বারাণসী জংশন ও ক্যান্ট রেলস্টেশন দেশের প্রায় সব বড় শহরের সঙ্গে যুক্ত।
  • বিমানপথে: লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (বারাণসী) থেকে মন্দির প্রায় ২৫ কিমি দূরে।
  • সড়কপথে: লখনউ, প্রয়াগরাজ, পাটনা প্রভৃতি শহর থেকে নিয়মিত বাস ও ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

অক্টোবর থেকে মার্চ মাস কাশী ভ্রমণের জন্য শ্রেষ্ঠ।
বিশেষ উৎসবের সময় — মহা শিবরাত্রি, কার্তিক পূর্ণিমাদীপাবলি — কাশীর সৌন্দর্য ও ভক্তি উভয়ই চরমে পৌঁছায়।


ভ্রমণ পরামর্শ

  • মন্দিরে প্রবেশের আগে মোবাইল ও ব্যাগ বাইরে রাখার ব্যবস্থা আছে।
  • ভোর ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দর্শন খোলা থাকে।
  • স্থানীয় পণ্ডিত বা গাইডের সহায়তা নিলে প্রতিটি স্থানের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব বোঝা যায়।
  • গঙ্গায় নৌকাভ্রমণ মিস করবেন না — এটি কাশী দর্শনের অপরিহার্য অংশ।

উপসংহার

কাশী বিশ্বনাথ মন্দির কেবল একটি উপাসনাস্থল নয়, এটি আত্মার মুক্তির দরজা। এখানে এসে মনে হয় — জীবনের সব ক্লান্তি, সব দুঃখ, সব ভয় যেন বিলীন হয়ে যায় মহাদেবের চরণে।

বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির আমাদের শেখায় —

“শিবই অনাদি, শিবই অনন্ত।
যেখানে বিশ্বাস, সেখানেই মুক্তি।”

যে একবার কাশীতে আসে, সে আর আগের মানুষ থাকে না। গঙ্গার পবিত্র জল, শিবের আশীর্বাদ, আর কাশীর চিরন্তন আলো — মিলেমিশে আত্মাকে ছুঁয়ে যায় গভীরতম স্থানে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *