ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আগ্রা জেলার এক প্রান্তে পাহাড়ি ভূমির উপর গড়ে উঠেছিল এক অনন্য নগরী — ফতেহপুর সিকরি। ইতিহাস, স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও রাজকীয় গৌরবের এক অমর প্রতীক এই শহর আজও আগন্তুকদের মুগ্ধ করে রাখে। সম্রাট আকবরের হাত ধরে ষোড়শ শতকে যেভাবে এই শহরের জন্ম হয়েছিল, তার প্রতিটি ইট আজও যেন কথা বলে — মুঘল ঐশ্বর্য, ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনা ও ভারতীয় স্থাপত্যকলার শ্রেষ্ঠ উদাহরণের কথা।
ফতেহপুর সিকরির ইতিহাসের শুরু
১৫৬৯ সালে সম্রাট আকবর তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন ফতেহপুর সিকরি শহর। কথিত আছে, আকবরের কোনো উত্তরসূরি ছিল না। তিনি সন্তান লাভের আশায় সুফি সাধক শেখ সলিম চিস্তির আশ্রমে যান, যিনি সেই সময় এই সিকরি অঞ্চলে বাস করতেন। তাঁর আশীর্বাদেই জন্ম নেয় আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর (সেলিম)। সেই আশীর্বাদের স্মৃতিতে আকবর এই শহরটির নাম দেন “ফতেহপুর সিকরি”, অর্থাৎ বিজয়ের শহর।
১৫৭১ থেকে ১৫৮৫ সালের মধ্যে এই শহর ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। তবে জলের অভাব ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রাজধানী পরে আগ্রা ও লাহোরে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ফতেহপুর সিকরির স্থাপত্য আজও অমলিন — যেন এক রাজকীয় জাদুঘর।
স্থাপত্যের রাজমহিমা
ফতেহপুর সিকরির প্রতিটি স্থাপত্যের মধ্যে রয়েছে ভারতীয়, ইসলামিক ও পারস্য স্থাপত্যশৈলীর মিলিত সৌন্দর্য।
১. বুলন্দ দরওয়াজা:
শহরের প্রধান প্রবেশপথ। এটি ভারতের অন্যতম বৃহত্তম দরওয়াজা, যার উচ্চতা প্রায় ৫৪ মিটার। পারস্য ভাষায় খোদাই করা লেখাগুলি আজও সেই সময়ের জ্ঞানচর্চা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতীক।
২. জামা মসজিদ:
বুলন্দ দরওয়াজার ঠিক পাশে অবস্থিত এই মসজিদটি এক বিশাল প্রাঙ্গণ ঘিরে গড়ে উঠেছে। এটি আকবরের ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার নিদর্শন — যেখানে ইসলামিক ও হিন্দু শিল্পশৈলীর মিশেল লক্ষ্য করা যায়।
৩. শেখ সলিম চিস্তির দরগা:
সাদা মার্বেলে তৈরি এই দরগা ফতেহপুর সিকরির প্রাণকেন্দ্র। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে মনোবাসনা পূরণের আশায়। বিশ্বাস করা হয়, যাঁরা এখানে সাদা সুতো বেঁধে প্রার্থনা করেন, তাঁদের ইচ্ছা পূর্ণ হয়।
৪. পঞ্চমহল:
একটি পাঁচতলা খোলা ভবন, যেখানে প্রতিটি তলায় স্তম্ভের নান্দনিক বিন্যাস চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বলা হয়, এটি আকবরের স্ত্রী জোধাবাই ও অন্যান্য রাজকীয় নারীদের অবকাশযাপনের স্থান ছিল।
৫. দিওয়ান-ই-খাস ও দিওয়ান-ই-আম:
দুটি রাজকীয় দরবার — প্রথমটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় আলোচনার জন্য এবং দ্বিতীয়টি প্রজাদের সঙ্গে সম্রাটের সাক্ষাৎ করার স্থান। দিওয়ান-ই-খাসে “সিংহাসন স্তম্ভ” বিশেষভাবে দর্শনীয়।
শহরের পরিকল্পনা ও নিসর্গ
ফতেহপুর সিকরির পরিকল্পনা ছিল পরিপূর্ণভাবে রাজকীয়। চওড়া রাস্তা, জলাধার, বাগান, প্রাসাদ ও মসজিদের নিখুঁত সমন্বয় সেই সময়ের উন্নত নগর পরিকল্পনার সাক্ষ্য দেয়। চারপাশে লাল বেলেপাথরে তৈরি দেয়াল ঘেরা শহরটি এখন এক ঐতিহাসিক নিসর্গে পরিণত হয়েছে। সূর্যাস্তের সময় যখন বেলেপাথরের গায়ে রোদের শেষ আভা পড়ে, তখন ফতেহপুর সিকরি যেন লাল সোনার আভায় জ্বলজ্বল করে ওঠে।
ফতেহপুর সিকরির ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
আমার ফতেহপুর সিকরি ভ্রমণ শুরু হয়েছিল আগ্রা শহর থেকে। প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে যখন ফতেহপুর সিকরির দরজায় পৌঁছলাম, তখনই অনুভব করলাম — আমি ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছি।
বুলন্দ দরওয়াজার বিশালতা, মার্বেলের ঠান্ডা ছোঁয়া, আর সেই প্রাচীন নিস্তব্ধতা — সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল, সময় থেমে গেছে।
শেখ সলিম চিস্তির দরগায় গিয়ে আমি দেখেছি মানুষের অগাধ বিশ্বাস। অনেকে ফুল, চাদর, সুতো নিয়ে প্রার্থনা করছেন। দরগার ভেতরে ধূপের গন্ধ, আয়না-লাগানো ছাদ, আর কোরান পাঠের সুর — সব কিছু মিলে যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
পঞ্চমহলের উপরে উঠে যখন দূরের দৃশ্য দেখছিলাম, মনে হচ্ছিল, আমি যেন মুঘল যুগের কোনো সম্রাটের শহরে এসে দাঁড়িয়েছি।
কীভাবে পৌঁছানো যায়
- রেলপথে: আগ্রা ক্যান্ট রেলস্টেশন থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে। ফতেহপুর সিকরি রেলস্টেশন থেকেও সহজে পৌঁছানো যায়।
- সড়কপথে: আগ্রা থেকে গাড়ি বা বাসে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ।
- বিমানপথে: নিকটতম বিমানবন্দর আগ্রা ও দিল্লি। দিল্লি থেকে প্রায় ২০০ কিমি দূরত্ব।
ভ্রমণের সেরা সময়
অক্টোবর থেকে মার্চ মাস ফতেহপুর সিকরি ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে, গরমের তীব্রতা কম থাকে এবং পর্যটক সংখ্যাও যথেষ্ট।
ভ্রমণ পরামর্শ
- আরামদায়ক জুতো পরুন, কারণ প্রাসাদগুলি ঘুরে দেখতে অনেকটা হাঁটতে হয়।
- স্থানীয় গাইড নিন — তাতে প্রতিটি স্থানের ঐতিহাসিক কাহিনি ভালোভাবে জানা যায়।
- সূর্যাস্তের সময় বুলন্দ দরওয়াজার সামনে থাকুন, দৃশ্যটি সত্যিই মোহময়।
উপসংহার
ফতেহপুর সিকরি কেবল একটি ঐতিহাসিক স্থান নয়, এটি ভারতের গৌরবময় অতীতের প্রতীক। এখানে গিয়ে বোঝা যায়, কীভাবে এক সম্রাট ধর্ম, সংস্কৃতি ও শিল্পকে একসূত্রে বেঁধে এক মহিমান্বিত নগর গড়ে তুলেছিলেন।
আজও সেই রাজকীয় দরবারের নিস্তব্ধতা, সেই মিনারের আভা, আর সেই বুলন্দ দরওয়াজার উচ্চতা — যেন মনে করিয়ে দেয়, “সাম্রাজ্য মুছে যায়, কিন্তু ইতিহাস অমর থাকে।”
Leave a Reply