
Glimpses of Pran Pratishtha ceremony of Shree Ram Janmaboomi Temple in Ayodhya, Uttar Pradesh on January 22, 2024. PM presents on the occasion.
ভূমিকা
ভারতের ধর্মীয় মানচিত্রে এমন কিছু স্থান আছে, যা শুধু মাটির নয় — বিশ্বাসের প্রতীক। অযোধ্যা ঠিক তেমনই এক শহর। এই শহর শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, এটি এক অনুভূতির নাম, এক আস্থার কেন্দ্র। আর সেই অযোধ্যার হৃদয়ে অবস্থিত রাম জন্মভূমি — ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের জন্মস্থান, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক পরম তীর্থ।
যে স্থানে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রূপে রামচন্দ্র এই ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেখানে দাঁড়ানো মানে এক অনন্ত আধ্যাত্মিক শক্তির সংস্পর্শে আসা।
️ রাম জন্মভূমির ঐতিহাসিক পরিচয়
পুরাণ অনুযায়ী, ত্রেতা যুগে অযোধ্যা ছিল ইক্ষ্বাকু বংশের রাজধানী, আর রাজা দশরথের প্রাসাদেই জন্ম নেন রামচন্দ্র। এই স্থানই আজকের রাম জন্মভূমি মন্দির।
মধ্যযুগে মুঘল আক্রমণ ও ধর্মীয় সংঘাতের সময়ে এখানে নির্মিত হয়েছিল একটি মসজিদ, যা ইতিহাসে “বাবরি মসজিদ” নামে পরিচিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভূমি নিয়ে নানা আন্দোলন, বিতর্ক ও মামলা চলেছে।
অবশেষে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই ভূমি হিন্দুদেরই প্রাপ্য বলে ঘোষণা হয়। তার পর ২০২০ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র হাত ধরে রাম জন্মভূমি মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
নবনির্মিত রাম মন্দির – স্থাপত্যের এক বিস্ময়
২০২4 সালের জানুয়ারিতে উদ্বোধিত নতুন রাম জন্মভূমি মন্দির ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য উদাহরণ।
- স্থাপত্য রীতি: নাগর শৈলী (উত্তর ভারতের ঐতিহ্যবাহী মন্দির স্থাপত্য)
- নির্মাণ উপাদান: সম্পূর্ণ বেলেপাথর দিয়ে নির্মিত, কোনো ইস্পাত বা সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি।
- উচ্চতা: প্রায় ১৬১ ফুট
- দৈর্ঘ্য: ৩৬০ ফুট
- প্রস্থ: ২৩৫ ফুট
- স্তম্ভ সংখ্যা: প্রায় ৩৯২টি সূক্ষ্ম খোদাই করা স্তম্ভ
- গর্ভগৃহ: কেন্দ্রে স্থাপিত রামলালার মূর্তি (রামচন্দ্রের শিশু রূপ), যা অযোধ্যার হৃদয়স্পন্দন।
মন্দিরের ভেতরের দেয়াল ও স্তম্ভে খোদাই করা আছে রামায়ণের বিভিন্ন দৃশ্য — রামের জন্ম, সীতার স্বয়ম্বর, বনবাস, রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ, এবং অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন।
আমার অযোধ্যা ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
ভোরবেলায় সারযূ নদীর তীরে পৌঁছে প্রথম যে শব্দটি কানে এলো, তা হল “জয় শ্রী রাম”। গঙ্গার মতোই পবিত্র সারযূ নদীর জলে স্নান করে মনে হল, সমস্ত ক্লান্তি যেন মিলিয়ে গেল।
এরপর মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল এক মহিমাময় দৃশ্য — সোনালি পাথরে সূর্যের আলো ঝলমল করছে, ভক্তদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে “রাম নাম সত্য হ্যায়”।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব কড়া, কিন্তু ভেতরে এক অপার শান্তি। সারি সারি ভক্ত হাতে ফুল, তুলসি ও প্রণাম নিবেদনের থালা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন গর্ভগৃহের দিকে। শিশুরূপ রামলালার দর্শন মুহূর্তেই মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দেয়।
মন্দিরের চারপাশে রয়েছে চমৎকার রামপথ ও ভক্তি পথ করিডর, যেখানে দোকান ও বিশ্রামস্থল সাজানো অত্যন্ত সুন্দরভাবে। মন্দিরের পেছনে রয়েছে সীতার রান্নাঘর, হনুমানগড়ী, এবং রামকোট দুর্গ, যা ভ্রমণকারীদের জন্য অতুলনীয় অভিজ্ঞতা।
ধর্মীয় তাৎপর্য
রাম জন্মভূমি কেবল একটি তীর্থস্থান নয় — এটি ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক। এখানে আসলে বোঝা যায়, কীভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এক বিশ্বাস কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
যে ভূমিতে ভগবান রাম জন্মেছিলেন, সেই ভূমিতে দাঁড়িয়ে মনে হয় —
“ধর্মের পথ কখনও হারায় না, সত্যের জয় অনিবার্য।”
কীভাবে পৌঁছানো যায়
- রেলপথে: অযোধ্যা জংশন (Ayodhya Dham Junction) ভারতের প্রায় সব বড় শহরের সঙ্গে সংযুক্ত।
- বিমানপথে: মহারাজা দশরথ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (Ayodhya Airport) — এটি নবনির্মিত এবং লখনৌ বা দিল্লি থেকে সহজেই ফ্লাইট পাওয়া যায়।
- সড়কপথে: লখনৌ (১৩৫ কিমি), বারাণসী (২০০ কিমি) বা প্রয়াগরাজ থেকে নিয়মিত বাস ও ট্যাক্সি পরিষেবা পাওয়া যায়।
️ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
অযোধ্যা ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় অক্টোবর থেকে মার্চ।
বিশেষ উৎসবের সময় যেমন রাম নবমী, দীপাবলি, বা অযোধ্যা দীপোৎসব-এর সময় শহরটি আলো, ভক্তি ও আনন্দে ভরে ওঠে। লক্ষাধিক প্রদীপে সাজানো অযোধ্যা যেন তখন এক জীবন্ত স্বর্গের রূপ নেয়।
ভ্রমণ পরামর্শ
- মন্দিরে প্রবেশের আগে মোবাইল, ক্যামেরা ও ব্যাগ নির্দিষ্ট স্থানে জমা দিতে হয়।
- আরামদায়ক পোশাক ও পায়ের জুতো খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়।
- স্থানীয় গাইড নিলে মন্দিরের ইতিহাস, প্রতিটি অংশের প্রতীকী অর্থ বোঝা সহজ হয়।
- সারযূ নদীর ঘাটে ভোর বা সন্ধ্যায় আরতি দর্শন এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
উপসংহার
অযোধ্যার রাম জন্মভূমি শুধুই এক তীর্থ নয় — এটি ভারতের আত্মার প্রতিচ্ছবি।
এখানে এসে মনে হয়, বিশ্বাস, সহিষ্ণুতা ও প্রেম — এই তিনেই আছে মানবজীবনের প্রকৃত অর্থ।
যে ভূমিতে রাম জন্মেছিলেন, সেখানে আজও শোনা যায় —
“জয় শ্রী রাম! জয় জয় রঘুবীর সমরথ!”
এই ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয় ভারতের হৃদয়, যা অযোধ্যার মতোই অনন্ত, অক্ষয়, অবিনশ্বর।
Leave a Reply