
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা বরাবরই প্রকৃতিপ্রেমী ও অভিযাত্রীদের জন্য এক অজানা রত্নভাণ্ডার। এখানে পাহাড়, ঝরনা, বন, লোকসংস্কৃতি—সবই মিশে গেছে এক সুরেলা সিম্ফনিতে। সেই পুরুলিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হল জয়চণ্ডী পাহাড় (Joychandi Pahar)। প্রকৃতি, পুরাণ, ইতিহাস ও রোমাঞ্চ—সবকিছু মিলিয়ে এটি এক অসাধারণ ভ্রমণস্থল, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে অনুভব করা যায় বাংলার অরণ্য-পাহাড়ের স্বাদ।
️ অবস্থান ও যাত্রাপথ
জয়চণ্ডী পাহাড় পুরুলিয়া জেলার ঝালদা শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে এবং জেলা সদর পুরুলিয়া থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কলকাতা থেকে ট্রেনে পুরুলিয়া জংশন পর্যন্ত এসে সেখান থেকে ট্যাক্সি বা বাসে সহজেই পৌঁছানো যায়। আবার চাইলে সরাসরি জয়চণ্ডী পাহাড় রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনেও আসা যায়—এটি একটি ছোট অথচ মনোরম স্টেশন, পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।
পথের দুই ধারে লাল মাটির রাস্তা, শাল-পিয়াল বনের ঘ্রাণ আর স্থানীয় জনজীবনের দৃশ্য—এই সব মিলিয়ে ভ্রমণপথটি নিজেই এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
️ পাহাড়ের সৌন্দর্য ও গঠন
জয়চণ্ডী পাহাড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এটি মূলত গ্রানাইট পাথরের গঠিত একটি বিশাল শিলাস্তূপ, যার গায়ে গায়ে গাছপালা ও শ্যাওলার ছোঁয়া যেন প্রকৃতির তুলিতে আঁকা এক শিল্পকর্ম। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে প্রায় ৪৬০টিরও বেশি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়।
উপরে উঠতে উঠতে যখন নীচের সবুজ উপত্যকা, শালবন, লাল মাটির গ্রামগুলো ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র হয়ে আসে, তখন মন ভরে যায় এক অন্যরকম প্রশান্তিতে। পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখা যায় চারপাশের অসাধারণ দৃশ্য—সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সেই দৃশ্য একেবারে অপার্থিব।
জয়চণ্ডী মন্দির ও কিংবদন্তি
পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে জয়চণ্ডী দেবীর মন্দির, যাঁকে স্থানীয় মানুষ শক্তিরূপে পূজা করেন। কথিত আছে, প্রাচীন কালে এখানে রাজা চণ্ডী দেবীর আরাধনা করতেন, এবং তাঁর নামেই পাহাড়ের নামকরণ—“জয়চণ্ডী”।
মন্দিরটি ছোট হলেও অত্যন্ত শান্ত ও পবিত্র। প্রতি বছর চৈত্র মাসে এখানে “চৈত্র মেলা” অনুষ্ঠিত হয়। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা মা জয়চণ্ডীর দর্শনে আসেন। মেলার সময় পাহাড়ের চারপাশ লোকনৃত্য, ঝুমুর গান, ছৌ নাচ, ও গ্রামীণ মেলায় মুখরিত হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্র ইতিহাসে জয়চণ্ডী পাহাড়
বাংলা চলচ্চিত্র জগতে জয়চণ্ডী পাহাড়ের বিশেষ স্থান রয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র “হীরক রাজার দেশে”-র কিছু দৃশ্য এখানে চিত্রায়িত হয়েছিল। সেই স্মৃতি আজও পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। অনেকেই এই পাহাড়কে “হীরক রাজার পাহাড়” বলেও চেনেন।
♂️ রক ক্লাইম্বিং ও অভিযান
অভিযাত্রীদের কাছে জয়চণ্ডী পাহাড় এক স্বপ্নের জায়গা। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য যুবকল্যাণ দপ্তর এবং বিভিন্ন ট্রেকিং সংস্থা এখানে রক ক্লাইম্বিং ক্যাম্প আয়োজন করে থাকে। খাড়া শিলাস্তরে ওঠা, ক্যাম্পিং, এবং পাহাড়ি পথ ধরে হাইকিং—সবকিছুই এখানে রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদের কাছে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
চূড়ায় উঠার পর যে বিস্তীর্ণ দিগন্ত চোখে পড়ে, তা যেন প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া এক পুরস্কার।
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
জয়চণ্ডী পাহাড়ের আশেপাশে ঘুরে দেখা যেতে পারে আরও অনেক সুন্দর স্থান—
- আয়োধ্যা পাহাড় ও মারবন জলপ্রপাত – প্রকৃতির রূপলাবণ্য উপভোগের জন্য আদর্শ।
- পাঞ্চেত জলাধার – নদী ও পাহাড়ের মিলনে গঠিত এক মনোরম জলাশয়।
- ঝালদা মন্দির – স্থানীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
- বাঘমুন্ডি ও বন্ডি পাহাড় – ছৌ নৃত্যের উৎসস্থল ও লোকসংস্কৃতির কেন্দ্র।
উৎসব ও সংস্কৃতি
চৈত্র মাসের জয়চণ্ডী মেলা ছাড়াও এখানে সারাবছর নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। স্থানীয় সাঁওতাল, কুরমি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পাহাড়ের পরিবেশকে জীবন্ত রাখে। ঢোল, মাদল, ঝুমুর গানের তালে তালে ভক্তি ও আনন্দের এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটে।
ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
জয়চণ্ডী পাহাড়ে ভ্রমণ মানে কেবল পাহাড়ে ওঠা নয়—এ এক আত্মিক যাত্রা। পাহাড়ের পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় যেন প্রকৃতি ও মানবজীবনের মধ্যে এক নীরব সংলাপ চলছে। উপরে পৌঁছে যখন বাতাস মুখে লাগে, তখন মনে হয় সমস্ত ক্লান্তি উড়ে গেছে।
সন্ধ্যাবেলা সূর্য যখন লাল আভায় পাহাড়ের গায়ে শেষ রঙ মেখে দেয়, তখন নিচের গ্রামগুলো যেন লাল-সোনালি আলোর ছোঁয়ায় রূপকথার রাজ্যে পরিণত হয়।
উপসংহার
জয়চণ্ডী পাহাড় কেবল পুরুলিয়ার গর্ব নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক। ইতিহাস, পুরাণ, অভিযান ও সংস্কৃতি—সবকিছুই এখানে মিশে গেছে এক অদ্ভুত মায়াবী আবেশে।
যে কেউ যদি একদিকে শান্ত প্রকৃতির কোলে নিজেকে হারাতে চান, আবার অন্যদিকে চ্যালেঞ্জিং অভিযানে মন ভরাতে চান—তবে জয়চণ্ডী পাহাড় ভ্রমণ হবে তাঁর জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়।












Leave a Reply