শুশুনিয়া পাহাড় – প্রকৃতি, ইতিহাস ও অভিযানের এক মায়াময় রাজ্য ।

বাংলার পশ্চিমের দিকের প্রাচীন জনপদ বাঁকুড়া জেলা। এই জেলার বুক চিরে উঠে দাঁড়িয়েছে এক ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পাহাড় — শুশুনিয়া পাহাড় (Susunia Hill)। লাল মাটির দেশে, শাল-পিয়ালের বনে ঘেরা এই পাহাড় কেবল একটি প্রাকৃতিক নিদর্শন নয়, বরং ইতিহাস, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও ধর্মীয় ভাবনার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। যাঁরা প্রকৃতিপ্রেমী, ইতিহাসে আগ্রহী, বা রোমাঞ্চপ্রিয় ভ্রমণপিপাসু — তাঁদের সবার কাছেই শুশুনিয়া এক স্বপ্নের গন্তব্য।


অবস্থান ও যাত্রাপথ

শুশুনিয়া পাহাড় অবস্থিত বাঁকুড়া জেলার ছাতনা ব্লকে, বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে এবং দুর্গাপুর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। কলকাতা থেকে রেল বা সড়কপথে সহজেই পৌঁছানো যায়।

  • ট্রেনে গেলে বাঁকুড়া স্টেশন বা ছাতনা স্টেশন পর্যন্ত এসে টোটো বা গাড়ি ভাড়া করে পাহাড়ে পৌঁছানো যায়।
  • সড়কপথে চাইলে কলকাতা থেকে বাঁকুড়া পর্যন্ত NH-60 ধরে যাত্রা করলে শুশুনিয়া পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৫–৬ ঘণ্টা

পথে দেখা যায় লাল মাটির গ্রাম, কুয়াশায় মোড়া শাল-বন, আর পথে পথে মাটির ঘরের আঁচল মেলে থাকা হাসিমুখ মানুষ—সব মিলিয়ে যাত্রাই হয়ে ওঠে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা।


️ শুশুনিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

শুশুনিয়া একটি প্রাচীন আগ্নেয় শিলা পাহাড়, যার উচ্চতা প্রায় ১,২০০ ফুট। এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পুরাতন ভূতাত্ত্বিক গঠন, যার বয়স কয়েক কোটি বছর বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে শ্যাওলা, পাথরের স্তর, অরণ্য ও লাল মাটির মিলনে এক রূক্ষ অথচ আকর্ষণীয় সৌন্দর্য দেখা যায়।

পাহাড়ের পাদদেশে ঝরনা ও প্রাচীন জলধারা রয়েছে, যা গ্রীষ্মের তাপে ক্লান্ত ভ্রমণকারীর জন্য এক স্বর্গীয় আশ্রয়। পাহাড়ের উত্তর-পূর্ব ঢালে একটি ছোট গুহার মধ্যে অবস্থিত প্রাকৃতিক ঝরনা — এখানকার জল সর্বদাই ঠান্ডা ও স্বচ্ছ।


ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব

শুশুনিয়া কেবল প্রাকৃতিক নয়, ঐতিহাসিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ের গায়ে খোদিত রয়েছে গুপ্ত যুগের ব্রাহ্মী লিপি, যা প্রমাণ করে এই স্থানটি বহু প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষী। এখানে একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে, যাতে চন্দ্রবর্মা নামের এক প্রাচীন রাজাধিরাজের উল্লেখ রয়েছে — যিনি সম্ভবত গুপ্ত যুগের সমসাময়িক।

স্থানীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, একসময় শুশুনিয়া ছিল রাজা চন্দ্রবর্মার দুর্গনগরী, যেখানে দুর্গ, রাজপ্রাসাদ ও মন্দির ছিল। যদিও এখন সবই সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেছে, তবুও পাহাড়ের পাথুরে গঠন যেন সেই গৌরবময় অতীতের সাক্ষ্য বহন করে।


️ ধর্মীয় ঐতিহ্য

শুশুনিয়ার গায়ে রয়েছে নারায়ণ শিলাশুশুনিয়া মহাদেব মন্দির। স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করেন, প্রভু শিব এই পাহাড়ের গুহায় তপস্যা করেছিলেন। প্রতি বছর শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে এক বিরাট মেলা বসে — হাজার হাজার ভক্ত এসে প্রভুর পুজো দেন, আর পাহাড়ের আশেপাশে ভরে যায় ভক্তির সুরে।


‍♂️ রক ক্লাইম্বিং ও অভিযান

শুশুনিয়া পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় রক ক্লাইম্বিং ও ট্রেকিং কেন্দ্র। বিভিন্ন অভিযাত্রী সংস্থা এখানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনা করে।
পাহাড়ের খাড়া দিকগুলোতে ওঠার সময় পাথর ধরা, হুক লাগানো ও দড়ির ব্যবহার—সব মিলিয়ে অভিজ্ঞতাটি চরম রোমাঞ্চে ভরা।

চূড়ায় পৌঁছে যে দৃশ্যটি চোখে পড়ে তা একেবারে অপূর্ব—চারদিকে সবুজ শাল-পিয়াল বন, লাল মাটির গ্রাম, আর দূরের নীলচে দিগন্ত যেন মিশে গেছে এক রঙিন চিত্রপটে।


আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

শুশুনিয়া পাহাড় ঘুরতে গেলে আশেপাশের কয়েকটি স্থানও ঘুরে দেখা যায়—

  • বিষ্ণুপুর – বিখ্যাত টেরাকোটা মন্দিরের শহর, শুশুনিয়া থেকে প্রায় ৬০ কিমি দূরে।
  • ছাতনা শিব মন্দির – প্রাচীন শৈলশিল্প ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন।
  • মুকুটমনিপুর জলাধার – পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম বাঁধ, মনোমুগ্ধকর সূর্যাস্তের জন্য বিখ্যাত।
  • বাঁকুড়া শহর ও বিবি পাহাড় – স্থানীয় লোকসংস্কৃতি ও হস্তশিল্পের কেন্দ্র।

সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্য

শুশুনিয়া অঞ্চলে প্রধানত সাঁওতাল, কুরমি ও অন্যান্য উপজাতি জনগোষ্ঠী বসবাস করেন। তাঁদের ঢোল-মাদল, ঝুমুর নাচ, ছৌ নৃত্য ও গান এই অঞ্চলের প্রাণ। বিশেষত উৎসবের সময় পাহাড়ের পাদদেশে সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের নৃত্য-গান দেখে মন আপনা থেকেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।


ভ্রমণের সেরা সময়

শুশুনিয়া ভ্রমণের আদর্শ সময় হলো অক্টোবর থেকে মার্চ। এই সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে, আকাশ থাকে পরিষ্কার, আর ট্রেকিং বা ক্যাম্পিংয়ের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকে।
বর্ষাকালে পাহাড় সবুজে মোড়া থাকলেও পাথর পিচ্ছিল হওয়ায় তখন ওঠা কিছুটা বিপজ্জনক।


️ ভ্রমণ পরামর্শ

  • আরামদায়ক ট্রেকিং জুতো ও হালকা পোশাক পরুন।
  • পাহাড়ে ওঠার সময় জল ও শুকনো খাবার সঙ্গে রাখুন।
  • স্থানীয় গাইডের সহায়তা নিন, বিশেষত রক ক্লাইম্বিং করলে।
  • প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখুন—প্লাস্টিক বা বর্জ্য ফেলবেন না।

উপসংহার

শুশুনিয়া পাহাড় কেবল এক পাহাড় নয়, এটি এক প্রকৃতি ও ইতিহাসের জীবন্ত অধ্যায়। এখানে এসে মানুষ প্রকৃতির কাছে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, আবার ইতিহাসের গহিন থেকে নতুন কিছু শেখে।

যাঁরা শহরের কোলাহল থেকে দূরে নিরিবিলি অথচ রোমাঞ্চে ভরা পরিবেশ খুঁজছেন, তাঁদের জন্য শুশুনিয়া হতে পারে এক আদর্শ গন্তব্য। পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যোদয় দেখা, মন্দিরে ধূপের গন্ধে ভরা প্রার্থনা, আর রাত্রে অরণ্যের নীরবতা — সব মিলিয়ে শুশুনিয়া সত্যিই এক অমলিন অভিজ্ঞতা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *