বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দির – ইতিহাস, স্থাপত্য ও আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব সংমিশ্র।

বাংলার মাটিতে ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের মিলনে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী তীর্থস্থান। কিন্তু যেই স্থানে একসঙ্গে ১০৮টি শিব মন্দির সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে, এমন দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও খুব একটা দেখা যায় না। সেই অসাধারণ স্থাপনাই হলো বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দির, যা একদিকে ইতিহাসের সাক্ষী, অন্যদিকে ভক্তির পবিত্র প্রতীক।

বর্ধমান শহরের প্রাণকেন্দ্রে, রাজবাড়ির একেবারে সামনে অবস্থিত এই মন্দিরসমষ্টি। এখানে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন দেবলোকের কোনো প্রাঙ্গণে এসে পড়েছি— শিবের ত্রিশূল, ঘণ্টাধ্বনি, ধোঁয়া ওঠা ধুনুচি আর গঙ্গাজলের গন্ধে ভরে থাকে সমগ্র পরিবেশ।


ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন রাজা তেজচন্দ্র মহাতাব-এর পত্নী রানী বাল্লভময়ী দেবী, ১৭৮৮ সালে। তিনি ছিলেন পরম ধর্মপরায়ণা ও শিবভক্তা। একদিন স্বপ্নাদেশে শিব স্বয়ং তাঁকে নির্দেশ দেন ১০৮টি শিবমন্দির নির্মাণের, যাতে সমস্ত জ্যোতির্লিঙ্গের প্রতিফলন একসাথে ঘটতে পারে।

এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন রানী বাল্লভময়ী। প্রায় দশ বছর ধরে চলে নির্মাণকাজ। সেই সময়ে ত্রিবেণী সংঘম থেকে গঙ্গার পবিত্র জল এনে প্রতিটি মন্দিরের শিবলিঙ্গে অভিষেক করা হয়েছিল বলে কথিত আছে।


স্থাপত্যের সৌন্দর্য

বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দির এক অনন্য স্থাপত্যের নিদর্শন। এখানে শিব মন্দিরগুলো দুই সারিতে, একদম অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো— ঠিক যেন এক বৃহৎ অমৃতমণ্ডল।

  • প্রতিটি সারিতে ৫৪টি মন্দির, মোট ১০৮টি মন্দির নিয়ে গঠিত এই শিবমণ্ডল।
  • প্রতিটি মন্দিরের ভিতরে রয়েছে এক একটি শিবলিঙ্গ, কিছু কালো পাথরের, কিছু সাদা মার্বেল পাথরের।
  • মন্দিরগুলির ছাদে বাংলার ঐতিহ্যবাহী আটচালা ও দোচালা ছাদের নকশা ব্যবহার করা হয়েছে।
  • মন্দিরগুলির মাঝে একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গণ, যেখানে শিবরাত্রির সময় অজস্র ভক্ত জমায়েত হয়।

সকালের প্রথম আলো যখন মন্দিরের চূড়ায় পড়ে, আর ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে, তখন মনে হয় যেন একসাথে ১০৮ শিবই এখানে বিরাজ করছেন।


আধ্যাত্মিক অনুভব

এখানে পা রাখামাত্রই এক পবিত্র শান্তি নেমে আসে মনে। ১০৮টি মন্দিরের চারপাশ ঘুরে ‘পরিক্রমা’ দেওয়া শিবভক্তদের মধ্যে একটি অলৌকিক তৃপ্তির অনুভূতি দেখা যায়। অনেকে বলেন, একবার এই ১০৮ মন্দিরে একযোগে প্রণাম করলে জীবনের সকল অমঙ্গল দূর হয় এবং আত্মা পায় মুক্তির পথ।

শিবরাত্রি, শ্রাবণ মাস এবং মহাশিবরাত্রির পূজার সময় এখানে যে ভক্তের ঢল নামে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তখন পুরো প্রাঙ্গণ জুড়ে হাজারো প্রদীপ জ্বলে ওঠে, ধুনুচির ধোঁয়া আর বেলপাতার গন্ধে বাতাস ভরে ওঠে।


রাজপরিবার ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া

বর্ধমান রাজবংশের শাসকগণ শিবপূজায় গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। আজও রাজপরিবারের উত্তরসূরিরা শিবরাত্রির দিনে বিশেষ পূজা ও আরতি করেন। রাজবাড়ির পুরোহিত পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মন্দিরগুলির পূজার দায়িত্ব পালন করে আসছে।

এই ১০৮ শিব মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি বর্ধমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও গর্ব। বহু শিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পী ও লেখক এই স্থানের সৌন্দর্য ও ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন।


যাওয়ার উপায়

  • কীভাবে যাবেন:
    কলকাতা থেকে ট্রেনে প্রায় আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় বর্ধমান স্টেশন। সেখান থেকে অটো বা রিকশায় ১০ মিনিটের পথ বর্ধমান রাজবাড়ি এলাকা, যেখানে অবস্থিত এই শিব মন্দিরসমষ্টি।
  • কোথায় থাকবেন:
    বর্ধমান শহরে রয়েছে নানা শ্রেণির হোটেল, লজ ও পর্যটন অতিথিশালা। রাজবাড়ির কাছেই কিছু আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
  • ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময়:
    নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়টি ভ্রমণের উপযুক্ত। তবে মহাশিবরাত্রি বা শ্রাবণ মাসে সোমবারে গেলে এই মন্দিরসমষ্টির চূড়ান্ত রূপ দেখতে পাওয়া যায়।

চিত্রোপম পরিবেশ

বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দির শুধু ধর্মীয় তীর্থ নয়, এটি এক অপূর্ব ফটোস্পটও বটে। শিবমন্দিরগুলির সারিবদ্ধ সাদা রঙের গম্বুজ, নীল আকাশের নিচে সবুজ লনের পটভূমিতে— যেন এক জীবন্ত পেইন্টিং। সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপের আলোয় ঝলমল করে ওঠে মন্দিরসমূহ, তখন মনে হয় যেন আকাশ নেমে এসেছে এই প্রাঙ্গণে।


উপসংহার

বর্ধমানের ১০৮ শিব মন্দির কেবল ইতিহাসের সাক্ষ্য নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার উৎস। এখানে এসে মানুষ শুধু দর্শনই পায় না, পায় আত্মশান্তি, পায় ভক্তির পরম তৃপ্তি।

যিনি শিবভক্ত, তাঁর জন্য এই স্থান এক পরম তীর্থ। আর যিনি ইতিহাস ও স্থাপত্য ভালোবাসেন, তাঁর জন্য এটি এক অমূল্য সম্পদ।

তাই বলা যায়—
“যেখানে একসাথে ১০৮ শিবের আশীর্বাদ, সেখানেই বর্ধমানের আত্মা।”
️✨

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *