
উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি সৌন্দর্যের এক অপরূপ রত্ন হল রিশপ (Rishyap)। পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলার অন্তর্গত এই ছোট্ট গ্রামটি যেন মেঘ, বন, পাখি আর নীরবতার এক জাদুময় আবাস। যারা শহরের কোলাহল থেকে কিছুদিনের জন্য পালাতে চান, প্রকৃতির কোলেই হারিয়ে যেতে চান— রিশপ তাঁদের জন্য স্বপ্নের স্থান।
রিশপ কোথায় ও কীভাবে যাবেন
রিশপ কালিম্পং শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, উচ্চতা প্রায় ৮,১০০ ফুট। নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) বা বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে প্রায় ৫-৬ ঘণ্টার পথ। লাভা থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় অনেকে লাভা, লোলেগাঁও ও রিশপ একসঙ্গে ঘুরে দেখেন।
রিশপের পথে যেতে যেতে চারপাশে যে দৃশ্য চোখে পড়ে— তা যেন স্বপ্নের মতন। পাইন ও দেবদারুর সারি, ঢালু পাহাড়ে ছোট ছোট গ্রাম, আর দূরে মেঘে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা— পথের প্রতিটি বাঁকে এক নতুন ছবি।
️ রিশপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
রিশপে পৌঁছানো মানেই প্রকৃতির এক নিরবচ্ছিন্ন সান্নিধ্য লাভ। এখানে কোনো বাজারের ভিড় নেই, নেই গাড়ির শব্দ— আছে কেবল বাতাসে পাইন গাছের ঘ্রাণ, পাখির কলতান, আর মাঝে মাঝে মেঘের ছোঁয়া।
সকালে ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে, আর জানালা খুললেই চোখে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতমালার বিশাল বিস্তার। রোদ পড়লে পর্বতের বরফ ঝলমল করে উঠে, আর সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের রঙে পাহাড় রাঙিয়ে তোলে সোনালি আলোয়।
রিশপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও দেখা যায় মাউন্ট পান্ডিম, কাব্রু, নর্সিং ও সিনিয়লচু পর্বত— যা একে করে তুলেছে আলোকচিত্রপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য।
রিশপের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
রিশপে থাকার পাশাপাশি আশেপাশে আরও কিছু মনোমুগ্ধকর স্থান ঘোরা যায় –
- তিফিন দারা ভিউ পয়েন্ট: রিশপ থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট পাহাড়ের চূড়া। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশাপাশি সমগ্র দার্জিলিং, কালিম্পং ও সিকিমের পাহাড় দেখা যায়। ভোরবেলা এখানে সূর্যোদয় দেখা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
- নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক: রিশপের খুব কাছে অবস্থিত এই জঙ্গল উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রধান জৈববৈচিত্র্য কেন্দ্র। এখানে দেখা যায় লাল পান্ডা, মাউন্টেন গোঅ্যাট, নানা রঙের পাখি ও অর্কিড।
- লাভা মনাস্টেরি: রিশপ থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে, লাভার বিখ্যাত বৌদ্ধ মঠটি একবার অবশ্যই দেখা উচিত। এখানকার শান্ত পরিবেশ মনকে প্রশান্ত করে তোলে।
- লোলেগাঁও: প্রকৃতি আর নীরবতার মেলবন্ধন দেখতে চাইলে রিশপ থেকে ঘুরে আসা যায় লোলেগাঁও। এর ক্যানোপি ব্রিজে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে, আপনি যেন মেঘের মধ্যে ভাসছেন।
থাকা ও খাওয়া
রিশপে থাকার জন্য অনেক সুন্দর হোমস্টে ও ছোট রিসোর্ট রয়েছে। পাহাড়ের ঢালে কাঠের তৈরি ঘর, বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন— এ এক অপূর্ব অনুভূতি।
খাবার হিসেবে এখানে মূলত পাহাড়ি রান্না, যেমন— থুকপা, মোমো, ভাত-ডাল-সবজি ও দেশি মুরগির ঝোল। পাহাড়ি হাওয়ায় বসে গরম স্যুপ বা চা খাওয়া সত্যিই অনন্য স্বাদ দেয়।
️ আবহাওয়া
রিশপের আবহাওয়া সারা বছরই মনোরম, তবে মার্চ থেকে মে ও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। শীতে তাপমাত্রা নেমে যায় ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত, আর কখনও কখনও তুষারপাতও দেখা যায়।
বর্ষাকালে (জুন-আগস্ট) বৃষ্টি ও কুয়াশা রিশপকে আরও রহস্যময় করে তোলে, তবে রাস্তাঘাট ভেজা ও পিচ্ছিল হয়ে পড়ে।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
রিশপ এমন এক জায়গা, যেখানে সময় যেন ধীরে চলে। এখানে রাতের আকাশে দেখা যায় অসংখ্য তারা, আর সকালে সূর্যের আলোয় পাহাড় রাঙিয়ে ওঠে সোনালি আভায়।
যে কেউ একবার রিশপে গেলে ফিরে এসে বুঝতে পারেন— প্রকৃত শান্তি মানে কী। কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, নেই শহরের শব্দ— আছে শুধু প্রকৃতির মৃদু সুর ও নৈঃশব্দ্যের সান্ত্বনা।
সমাপ্তি
রিশপ শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়— এটি এক অনুভূতি, এক প্রশান্তির দেশ। এখানে এসে মানুষ বুঝতে পারে, পাহাড়ের নীরবতায় কত কথা লুকিয়ে থাকে, মেঘের আড়ালে কত সৌন্দর্য ঘুমিয়ে আছে।
যে একবার রিশপে আসে, সে আর শহরের ধুলোবালিতে আগের মতো থাকতে পারে না— কারণ তার মন চিরদিনের জন্য মিশে যায় এই মেঘে মোড়া পাহাড়ের কোলে। ☁️












Leave a Reply