
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, হিমালয়ের কোলে এক অনিন্দ্য সুন্দর জেলা কালিম্পং। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির বুক জুড়ে ছড়িয়ে আছে দুই অপূর্ব গ্রাম – লাভা ও লোলেগাঁও। এ যেন দু’টি সবুজ পরীর রাজ্য, যেখানে পাহাড়, মেঘ, অরণ্য ও পাখির ডাক মিলেমিশে তৈরি করেছে এক জাদুকরী শান্তির আবহ।
লাভা – মেঘে মোড়া বনপাহাড়ের দেশ
কালিম্পং শহর থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম লাভা। ৭,২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই গ্রামটি নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। এখানে পৌঁছানোর পথে যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা সত্যিই মুগ্ধকর— ঘন দেবদারু আর পাইন গাছের সারি, কুয়াশায় মোড়া রাস্তা, আর হঠাৎ মেঘের ফাঁকে দেখা পাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝলক।
️ লাভা মনাস্টেরি
লাভার সবচেয়ে বিখ্যাত আকর্ষণ হলো জং ডগ পালরি ফোডং-এর ছোট সংস্করণ—লাভা বৌদ্ধ মঠ। তিব্বতীয় স্থাপত্যে গড়া এই মঠটির ভিতরে রয়েছে শান্ত প্রার্থনাকক্ষ, বুদ্ধমূর্তি, প্রার্থনার চাকা ও রঙিন পতাকার সারি। পাহাড়ের নীরবতার মাঝে যখন ভিক্ষুরা প্রার্থনা শুরু করেন, তখন মনে হয় স্বয়ং স্বর্গ যেন নেমে এসেছে মঠে।
প্রকৃতির রূপ
লাভার আশেপাশে রয়েছে নেওরা ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য স্বর্গরাজ্য। এখানে দেখা যায় লাল পান্ডা, মনাল পাখি, নানা প্রজাতির অর্কিড আর অসংখ্য প্রজাপতি। পাখির কলতান, ঝরনার সুর আর মেঘের নরম স্পর্শ মিলিয়ে এক অনন্য প্রশান্তি অনুভূত হয় এখানে।
️ আবহাওয়া
লাভার আবহাওয়া সারা বছরই মনোরম। বর্ষাকালে কুয়াশা ও বৃষ্টি মিলিয়ে চারপাশের বন ভিজে ওঠে সবুজে, আর শীতকালে মাঝে মাঝে তুষারপাতও হয়— যা পাহাড়ি গ্রামটিকে পরিণত করে এক ছবির দেশে।
লোলেগাঁও – প্রকৃতির নিঃশব্দ অলিন্দ
লাভা থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে আরেকটি অপরূপ গ্রাম লোলেগাঁও, যা কালিম্পং জেলার অন্যতম শান্ত ও পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি গ্রাম। এটি প্রায় ৫,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এবং এখানকার প্রধান আকর্ষণ হলো ক্যানোপি ওয়াক ও সানরাইজ পয়েন্ট।
ক্যানোপি ওয়াক
লোলেগাঁওয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান হলো ক্যানোপি ওয়াক (Canopy Walk)— প্রায় ১৮০ মিটার দীর্ঘ একটি দুলতে থাকা দড়ির সেতু, যা উঁচু গাছের মাথার উপর দিয়ে গেছে। হাঁটার সময় নিচে দেখা যায় গভীর বন, চারপাশে পাখির ডাক, আর উপরে মেঘের আস্তরণ। এই সেতু পেরোনো মানেই প্রকৃতির সঙ্গে একান্ত সংলাপের অভিজ্ঞতা।
সানরাইজ পয়েন্ট
লোলেগাঁওয়ের জান্দি ধুরা বা টিপটপ ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের সোনালি সূর্যোদয়। সকালে যখন সূর্যের প্রথম আলো বরফে পড়ে, পুরো আকাশ যেন জ্বলজ্বল করে ওঠে। এই দৃশ্য একবার দেখলে জীবনের সব ক্লান্তি যেন মিলিয়ে যায়।
গ্রামজীবন ও নিস্তব্ধতা
লোলেগাঁও খুবই শান্ত ও ধীর-গতির এক পাহাড়ি গ্রাম। এখানে এখনো মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাঁচে। পাথরের বাড়ি, টিনের ছাদ, গরুর ঘণ্টা, আর দূরে মেঘে ঢাকা পাহাড়— এমন দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় এক হারিয়ে যাওয়া যুগের কথা।
️ যাত্রাপথ ও থাকার ব্যবস্থা
কালিম্পং বা নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) স্টেশন থেকে লাভা ও লোলেগাঁও সহজেই পৌঁছানো যায় গাড়িতে।
- কালিম্পং থেকে লাভা: প্রায় ২ ঘণ্টার পথ
- লাভা থেকে লোলেগাঁও: প্রায় ১ ঘণ্টা
থাকার জন্য রয়েছে বহু হোমস্টে, রিসোর্ট ও ফরেস্ট বাংলো, যেখানে পাহাড়ি আতিথেয়তা ও ঘরোয়া খাবারের স্বাদ সত্যিই অনন্য।
ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
লাভা ও লোলেগাঁও এমন দুটি জায়গা, যেখানে ভ্রমণ মানেই নিজেকে প্রকৃতির হাতে সঁপে দেওয়া। এখানে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, নেই শহরের শব্দ— আছে কেবল কুয়াশা, বৃষ্টি, পাখির ডাক, আর পাহাড়ের নীরবতা।
লাভায় সূর্যাস্তের পর ধোঁয়াটে বনপথে হাঁটতে হাঁটতে মঠের ঘণ্টাধ্বনি শোনা, বা লোলেগাঁওয়ের ক্যানোপি ব্রিজে দাঁড়িয়ে মেঘের নিচে তাকানো— এই সব মুহূর্ত মনকে এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরে দেয়।
সমাপ্তি
লাভা ও লোলেগাঁও শুধু ভ্রমণস্থল নয়— এটি এমন এক অভিজ্ঞতা, যা মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করে দেয়। আধুনিক জীবনের যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে, এই দুটি পাহাড়ি গ্রাম আপনাকে শেখাবে নিঃশব্দতার মানে এবং প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্যের মূল্য।
যে একবার এখানে আসে, সে ফেরার সময় শুধু ছবি নয়, সঙ্গে নিয়ে যায় পাহাড়ের গন্ধ, মেঘের ছোঁয়া আর এক অমলিন প্রশান্তির স্মৃতি। ️












Leave a Reply