বাংলার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পশ্চিমবঙ্গের এক বিস্ময়কর অঞ্চল। এখানে যেমন আছে গভীর অরণ্যের রহস্য, তেমনি আছে সমুদ্রের নীল আভা; যেমন আছে ধর্মীয় তীর্থ, তেমনি আছে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য মনোমুগ্ধকর গন্তব্য। দক্ষিণ ২৪ পরগনা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক জেলা নয় — এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির আশ্চর্য মেলবন্ধন।
ভৌগোলিক পরিচিতি
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সদর শহর আলিপুর। জেলার পূর্বে বাংলাদেশ, পশ্চিমে পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তরে কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনা, আর দক্ষিণে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি। জেলার অনেকটা অংশ জুড়েই রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি আর উপকূলবর্তী বনভূমি। গঙ্গা নদীর নানা শাখা–প্রশাখা এই অঞ্চলের মাটিকে উর্বর করে তুলেছে, আর সেইসঙ্গে গড়ে তুলেছে এক অনন্য জীববৈচিত্র্যপূর্ণ ইকো-সিস্টেম।
সুন্দরবন – বাঘের দেশ, প্রকৃতির বিস্ময়
দক্ষিণ ২৪ পরগনার নাম উঠলেই প্রথমেই মনে আসে সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্ক-এর কথা। এটি UNESCO World Heritage Site এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর মোহনায় বিস্তৃত এই বনই রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার-এর রাজত্ব।
এখানে আরও দেখা মেলে হরিণ, বুনো শূকর, মনিটর লিজার্ড, কুমির এবং অসংখ্য প্রজাতির পাখির। শীতকালে সুন্দরবন পাখি পর্যবেক্ষকদের স্বর্গে পরিণত হয়।
কীভাবে পৌঁছাবেন: কলকাতা থেকে ক্যানিং হয়ে গদখালি, সেখান থেকে নৌকায় সুন্দরবন ভ্রমণ করা যায়।
বকখালি – সমুদ্রের শান্ত সুর
দক্ষিণ ২৪ পরগনার অন্যতম জনপ্রিয় সমুদ্রতীরবর্তী শহর হল বকখালি। এই সৈকতের সৌন্দর্য শান্ত, নিরিবিলি ও হৃদয়স্পর্শী। সূর্যাস্তের সময় সোনালি রঙে ভরে ওঠে আকাশ ও সমুদ্রের জল, আর হালকা বাতাসে মন ছুঁয়ে যায়।
এখানে বকখালি লাইট হাউস, বেণুবন মন্দির, এবং কাছেই হেনরি আইল্যান্ড একদিনের সফরে ঘুরে দেখা যায়।
কাকদ্বীপ – গঙ্গাসাগরের প্রবেশদ্বার
কাকদ্বীপ দক্ষিণ ২৪ পরগনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর, যা মূলত গঙ্গাসাগর তীর্থযাত্রার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। এখান থেকেই হাজার হাজার তীর্থযাত্রী নৌকায় সাগরদ্বীপের উদ্দেশে রওনা দেন। গঙ্গা ও সমুদ্রের মিলনক্ষেত্রের এত কাছে দাঁড়িয়ে কাকদ্বীপে এক অনন্য শান্তি ও ধর্মীয় আবহ পাওয়া যায়।
️ সাগরদ্বীপ – আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রবিন্দু
গঙ্গাসাগর মেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনার সবচেয়ে বিখ্যাত ধর্মীয় উৎসব। প্রতি বছর জানুয়ারিতে লক্ষ লক্ষ ভক্ত কপিলমুনির আশ্রমে পুণ্যস্নানের জন্য আসেন। গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের মিলনস্থলে এই স্নানকে হিন্দুধর্মে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়।
“সব তীর্থ বার বার, গঙ্গাসাগর একবার” — এই প্রবাদই বোঝায় গঙ্গাসাগরের মাহাত্ম্য।
ইকো-ট্যুরিজম ও স্থানীয় জীবনযাত্রা
দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামীণ ও উপকূলীয় জীবনে এক বিশেষ ছন্দ আছে। এখানে মানুষ নদীর সঙ্গে, জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঁচে। ইকো-ট্যুরিজমের জন্য সুন্দরবনের নানা দ্বীপে যেমন সজনেখালি, দুদহারি, লোধা খালি প্রভৃতি জায়গা এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এছাড়া স্থানীয় মৎস্যজীবী সংস্কৃতি, হস্তশিল্প, মধু সংগ্রহ ইত্যাদি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
খাদ্য ও আতিথেয়তা
দক্ষিণ ২৪ পরগনার খাবারে প্রধানত মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও মধুর স্বাদ পাওয়া যায়। সুন্দরবনের “মৌচাক মধু” এবং “নদীর চিংড়ি” সত্যিই অনন্য। স্থানীয় হোমস্টেগুলোতে অতিথিরা পান বাংলার গ্রামীণ আতিথেয়তার উষ্ণ স্বাদ।
কীভাবে পৌঁছাবেন
কলকাতা থেকে রেলপথে ক্যানিং, নামখানা, কাকদ্বীপ, বা লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত পৌঁছে সেখান থেকে স্থানীয় ভ্যান, বাস বা নৌকায় জেলার নানা পর্যটনকেন্দ্রে যাওয়া যায়।
উপসংহার
দক্ষিণ ২৪ পরগনা একদিকে যেমন প্রকৃতির নিবিড় কোলে শান্তি খুঁজে দেয়, তেমনি ইতিহাস, ধর্ম ও সংস্কৃতির স্পর্শও ছড়িয়ে রাখে সর্বত্র। এখানে ভ্রমণ মানে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা নয়—এখানে ভ্রমণ মানে প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থান অনুভব করা।
বাংলার হৃদয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা আজও জীবন্ত এক কবিতা—যেখানে নদী, বন, সাগর আর মানুষ একসঙ্গে গেয়ে চলে জীবনের অনন্ত সুর।













Leave a Reply